১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, রবিবার, ৯:২৮

অরফানেজের বিচার : কেঁচো খুঁড়তে সাপ

শুধুমাত্র বিএনপি নয়, সর্বশ্রেণীর জনগণ বলছেন যে এতিমখানা মামলা যতটা না দুর্নীতি ও আইনগত বিষয় তারচেয়ে বেশি রাজনৈতিক বিষয়। রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে বিএনপি তথা বেগম খালেদা জিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য এই মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল এবং ইলেকশনের আগেই এই মামলার মাধ্যমে বেগম জিয়াকে কারাবন্দী করা হয়েছে। অবশ্য আওয়ামী লীগ বলছে যে এটি রাজনৈতিক বিবেচনা প্রসূত মামলা নয়, বরং আইন তার নিজস্ব পথে এগিয়েছে এবং বেগম জিয়ার জেল হয়েছে। তারা আরো বলেন, বেগম জিয়ার সাজা হওয়ায় আওয়ামী লীগ খুশিও নয়, বেজারও নয়। কিন্তু এসব কথা তারা জনগণকে বিশ্বাস করাতে পারেনি। কারণ জনগণ দেখেছে যে তাদের কথা এবং কাজ সম্পূর্ণ উল্টা। বেগম জিয়ার রায় ঘোষিত হওয়ার সাথে সাথে আওয়ামী লীগারদের মধ্যে পড়েছিল মিষ্টি খাওয়া এবং মিষ্টি বিতরণের ধুম। এসব চিত্র টেলিভিশনে এসেছে। যেনতেন প্রকারে তারা যে বেগম জিয়াকে জেল খাটাতে চেয়েছিল এবং এখনো যে যেনতেন প্রকারে তাকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে চায় সেটিও সর্বশেষ ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। নাহলে রায়ের সত্যায়িত নকল দিতে ১০ দিন লাগছে কেন? রায় হওয়ার পর কপি পেতে ১১ দিন, ফাইল করতে আরেক দিন এবং জামিন সংক্রান্ত রায় হতে আরো দুই দিন- মোট ১৪ দিন লাগবে কেন? জামিন হবে কিনা সেটি বিচারপতির ব্যাপার। যদি জামিন না হয় তাহলে সেটি হবে ভিন্ন ব্যাপার। তখন আমাদের আলোচনা অন্যখাতে প্রবাহিত হবে। আর যদি জামিন হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে যে তিনি ১৫ দিনের মাথায় জামিন পাবেন। তাহলে তাকে এই ১৪ দিন জেল খাটতে হবে কেন? অথবা জেল খাটতে হলো কেন? এটি কি ইচ্ছে করে করানো হয়নি?

এখন শিক্ষিত মানুষ, এমনকি অর্ধ-শিক্ষিত মানুষও জেনে গেছেন যে রায় এখনকার জামানায় আর জজ সাহেবরা হাতে লেখেন না। তিনি ডিক্টেশন দেন এবং সেটি কম্পিউটারে লেখা হয়। তারপর কম্পিউটার থেকে তার প্রিন্ট আউট নেওয়া হয়। প্রিন্ট আউটের কপিতে বড়জোর আদালতের একটি মোহর লাগাতে হয়। এই প্রিন্ট আউট বের করা এবং মোহর লাগানোতে সর্বোচ্চ ২ দিন লাগার কথা। সেখানে ১৩ দিন লাগছে কেন? এ ব্যাপারে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিকদল নেতা, কল্যাণ পার্টির প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ ইব্রাহিম গত বৃহস্পতিবার একটি চমৎকার কিন্তু যুক্তিগ্রাহ্য মন্তব্য করেছেন। বৃহস্পতিবার রাত ১১ টায় যমুনা টেলিভিশনের ২৪ ঘন্টা নামক টকশো অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, একটি রায়ের নকল দিতে এত দেরী লাগবে কেন? তিনি বলেন, আমার তো মনে হয় রায়টি আসলে লেখাই হয়নি। অথবা আগে ভাগেই তার শাস্তির অংশটুকু লেখা ছিল। ৮ তারিখে রায় ঘোষণার পর আগে পিছের বাকি অংশটুকু এখন লেখা হচ্ছে। সেই জন্যই এত দেরী হচ্ছে।
জেনারেল ইব্রাহিমের কথা যদি গ্রহণযোগ্য হয় তাহলে ব্যাপারটি কি দাঁড়াচ্ছে? জেনারেল সাহেব নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন এটি হলো একটি ঞধরষড়ৎ সধফব াবৎফরপঃ. অর্থাৎ দর্জিকে অর্ডার দেয়া ফরমায়েসি প্যান্ট শার্ট। দর্জি আপনার মাপ নেয়। তারপর আপনার মাপ মোতাবেক প্যান্ট বা শার্ট বানায়। এখানেও হয়তো তাই ঘটেছে।

॥দুই॥
কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন যে জেনারেল ইব্রাহিম তো কোনো আইনজ্ঞ নন। এই ধরনের কথা তিনি বলতেই পারেন। তবে সেইসব কথাকে সিরিয়াসলি নেয়া যায় না। যদি যুক্তির খাতিরে এসব কথা মেনেও নেয়া হয় তাহলে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ আইনজীবী, যিনি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন, তার কথা আনছি। তিনি হলেন ব্যারিস্টার কামাল হোসেন। ব্যারিস্টার কামাল হোসেন কি বলেছেন? বৃহস্পতিবার রাতে অনলাইন নিউজ পোর্টাল আমাদের সময় ডট কমে তার মন্তব্য দেখলাম। বৃহস্পতিবার দিনের বেলায় তিনি একটি আলোচনা সভায় বক্তৃতা করছিলেন। সেই বক্তৃতাটি রাতে একাধিক অনলাইন নিউজ পেপারে ছাপা হয়। পত্রিকাটিতে ড. কামাল হোসেন যা বলেছেন সেটি আমরা হুবহু তুলে দিচ্ছি। আমাদের সময় অনলাইনে বলা হয়, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, দেশে প্রতিদিন মিছিল হচ্ছে, মোবারকবাদ দেয়া হচ্ছে। এখানে একজনকে দু’কোটি টাকার জন্য জেল দেয়া হয়েছে। তিন দিনের মধ্যে তাকে জামিন দেয়ার কথা। অথচ বলা হচ্ছে রায় সংশোধন করা হচ্ছে। অবাক লাগছে। রায় দেয়া হয়ে গেছে তবে কপি দেয়া যাচ্ছে না, কারণ কপি সংশোধন করা হচ্ছে। দুই কোটি টাকার জন্য যদি সাড়ে ছয় শ’ পাতা লাগে, তাহলে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার জন্য কয় লাখ পাতা লাগবে? আর তা কত বছর লাগবে তা লিখতে? আর কয় বছর লাগবে তা সংশোধন করতে? আর তখন কয় বছর লাগবে এর কপি দিতে? এই যে কপি কপি দেব কপি দেব বলা হচ্ছে... কী প্রহসন হচ্ছে..। আইনকে নিয়ে খেলা করা হচ্ছে।

ঐ আলোচনা সভায় ড. কামাল হোসেন শুধুমাত্র বেগম জিয়ার মামলা, রায়ের কপি এবং জামিনের মধ্যেই তার বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি আওয়ামী সরকারের অন্যান্য অপকর্ম এবং অব্যবস্থার কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দেশের মানুষ কার্যকর গণতন্ত্র দেখছে না। তিনি বলেন, এরা যদি নিজেদের গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে থাকে তাহলে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে না কেন ? এ ব্যাপারে রাষ্ট্র নিশ্চুপ। এ ব্যাপারে কী কোনো মামলা শুরু হয়েছে- প্রশ্ন রাখেন তিনি। তিনি বলেন, দেশে যেভাবে হত্যা গুম চলছে তা নিয়ে সবাইকে মুখ খুলতে হবে। জজ সাহেবদের এ ব্যাপারে অসহায়দের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এরা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলে কেন তারা দেশে গুম হত্যা অপহরণের বিরুদ্ধে কথা বলছেন না। তারা যদি গুম হত্যার বিরুদ্ধে কিছু করতে না পারে তাহলে বেরিয়ে যাক ক্ষমতা থেকে।

৮ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার বেগম খালেদা জিয়ার রায় ঘোষণার ৩/৪ দিন পর একটি টেলিভিশন টকশোতে আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং নাগরিক ঐক্যের আহ্বাবয়ক মাহমুদুর রহমান মান্না সর্বপ্রথম আওয়াজ তুলেছিলেন যে ২ কোটি টাকা অনিয়মের জন্য যদি বেগম জিয়ার বিচার হয় এবং ৫ বছরের সাজা হয় তাহলে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক এবং শেয়ার বাজার থেকে লুট করেছে এবং লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে তাদের বিচার হবে না কেন? তিনি বলেন, বেগম জিয়া ২ কোটি টাকার তহবিল তসরুপ করেছেন, সেটি প্রমাণিত হয়নি। বরং দেখা যায় যে ব্যাংকে সেই টাকা তিন গুন বৃদ্ধি পেয়ে ৬ কোটি টাকা হয়েছে। তার পরেও তার ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে। এই তহবিলের টাকার একটি অংশ আরেকটি একাউন্টে ট্রান্সফার হয়েছিল। পরে সেই টাকা আবার মূল এ্যাকাউন্টে ফেরত আনা হয়েছে। কিন্তু ২ কোটি টাকার এক পয়সাও তসরুপ করা হয়নি। তার পরেও যদি তার ৫ বছরের কারাদণ্ড হয়ে থাকে তাহলে বিভিন্ন ব্যাংকে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করলো তাদের কত শত বছরের কারাদণ্ড হবে? কারাদণ্ড তো দূরের কথা, তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলাও করা হয়নি, কাউকে প্রেফতারও করা হয়নি।

॥তিন॥
একটি ব্যাংকের অন্যতম মালিক হলেন মুনতাসির মামুন। এই ব্যক্তি ইতিহাসের অধ্যাপক, দৈনিক জনকণ্ঠের নিয়মিত কলামিস্ট এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিতে শাহরিয়ার কবিরের দক্ষিণ হস্ত। তিনি একটি ব্যাংকের মালিক হওয়ার মত শত কোটি টাকা পেলেন কোথা থেকে? আরেকজন মালিক হলেন সিদ্দিকী নাজমুল। এই ব্যক্তি এই সেদিনও অর্থাৎ গণজাগরণ মঞ্চ নাটকের সময়ও ছাত্র লীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২ দিন আগে যিনি ছিলেন ছাত্র, তিনি একটি ব্যাংকের মালিক হওয়ার মত শত কোটি টাকা পেলেন কোথা থেকে? ১০ জন রাঘব বোয়ালের মধ্যে তিনটি নাম ইতোমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। অবশিষ্ট ৭ জনের নামও পত্রপত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে। ঘুষ, লুণ্ঠন ও দুর্নীতির জন্য ব্যাংকটিতে লালবাতি জ্বলেছে। এই গুরুতর আর্থিক অপরাধের জন্য যাদের লাল দালানে থাকার কথা তাদের কারো বিরুদ্ধে কোনো এ্যাকশন নেওয়া হয়নি।
আওয়ামী লীগ আমলে সংঘটিত হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির যে সংক্ষিপ্ত রেফারেন্স সেদিন মাহমুদুর রহমান মান্না দিয়েছেন, আজ সেই সব অভিযোগই অসংখ্য কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল এ ব্যাপারে তার ফেসবুক পাতায় যে স্ট্যাটাস দিয়েছেন সেটি দেশবাসী তো বটেই, বিশেষ করে আওয়ামী লীগারদের পড়া উচিত। কারণ তিনি কোদালকে কোদাল বলেছেন। আসিফ নজরুল লিখেছেন, এ সরকারের আমলে দুর্নীতির খনি পাওয়া গেলেও তাদের কোনো বিচার হচ্ছে না। টিভিএনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, এ সরকারের আমলে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। যেখানে সরকারপন্থীরা জড়িত থাকার প্রমাণ থাকলেও তাদেরকে কখনো গ্রেফতারও করা হয়নি। সেখানে দুই কোটি টাকার মামলায় বেগম জিয়ার সাজা হয়েছে। অথচ সে টাকা এখনো ব্যবহারও করা হয়নি।

আসিফ নজরুল বলেন, দেশের সিংহভাগ মানুষ যদি মনে করতো, খালেদা জিয়ার যে সাজা হয়েছে সেটার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাহলে বিএনপির জন্য বড় ধরনের সমস্যা হতো। কিন্তু এই ধরনের রাজনৈতিক মামলা বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখে। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির মামলা হয়েছিল। যে মামলায় তার কারাদণ্ডও হয়েছিল। দণ্ড ভোগের পর তিনি বেরিয়ে এসে আগের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় নেতা হয়েছিলেন। অথচ তখনো এইরকম প্রচারণা চালানো হয়েছে যে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যে দুর্নীতি মামলা হয়েছে সেটা সত্যি। কিন্তু মানুষের উপলব্ধিতে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। বেগম খালেদা জিয়ার মামলাও মানুষ সত্য হিসেবে বিশ্বাস করছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, সরকার যদি মনে করে, দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপের অংশ থেকেই বেগম জিয়ার সাজা হয়েছে। তাহলে সাধারণ মানুষের কাছে এটা আরো হাস্যকর হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ যে সময়ে এই মামলা হয়েছে সে সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও অনেকগুলো মামলা হয়েছিল। একই সময়ে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো চলমান থাকলেও ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রীর সব মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
আসলে ৮ ফেব্রুয়ারি যেটা ঘটেছে সেটি বেগম জিয়ার কারাবন্দীত্বের রায় নয়। ৮ ফেব্রুয়ারি এই রায়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ভিমরুলের চাকে ঢিল দিয়েছে। ইতোমধ্যেই তাদের দুর্নীতির কিসসা কাহিনী বেরিয়ে আসছে। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসবে ততই এসব কিসসা কাহিনী গর্ত থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসবে।
Email: asifarsalan15@gmail.com

http://www.dailysangram.com/post/319535