৩ জুলাই ২০২৪, বুধবার, ৪:৫৫

ঋণ গ্রহণে সতর্কতা প্রয়োজন

-এম এ খালেক

যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রাথমিক পর্যায়ে বিদেশি ঋণের প্রয়োজন পড়ে। বিশে^ সম্ভবত একটি দেশও নেই যারা কোনো না কোনো পর্যায়ে বিদেশি সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণ করেনি। তবে এক পর্যায়ে ঋণ গ্রহণের মাত্রা কমিয়ে দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার চেষ্টা করে এবং সেটাই নিয়ম। কোনোভাবেই ঋণগ্রস্ত দেশে পরিণত হওয়া মঙ্গলজনক নয়। অতিমাত্রায় বিদেশি ঋণ গ্রহণ এবং তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে কী পরিণতি ঘটে তার জ¦লন্ত উদাহরণ হচ্ছে দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। এক সময় শ্রীলঙ্কাকে দক্ষিণ এশিয়ার রাইজিং টাইগার হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। সেই শ্রীলঙ্কা ঢালওভাবে বিদেশি ঋণ গ্রহণ করে তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারায় ২০২২ সালে দেশটি আন্তর্জাতিকভাবে ঋণ খেলাপি দেশে পরিণত হয়। অর্থাৎ তাদের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে পড়ে যে বিদেশি সূত্র থেকে গৃহীত ঋণের কিস্তি তারা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়। কোনো দেশ আন্তর্জাতিকভাবে ঋণ খেলাপির তকমা অর্জন করা যে কতটা লজ্জাজনক তা শ্রীলঙ্কা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। শ্রীলঙ্কা বিদেশ থেকে যে ঋণ গ্রহণ করেছে তা এমন সব প্রকল্পে ব্যয় করা হয়েছে যার কোনো উপযোগিতা ছিল না। বিদেশি ঋণ গ্রহণ করে তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে কী অবস্থা হয় তা শ্রীলঙ্কার মানুষ অনুধাবন করতে সমর্থ হয়েছে। এক পর্যায়ে শ্রীলঙ্কার গৃহীত ঋণের হার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এমনকি লোন-জিডিপি রেশিও ১০৩ শতাংশে উন্নীত হয়। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কার মোট জিডিপির পরিমাণ যদি ১০০ টাকা হয় তাহলে গৃহীত ঋণের পরিমাণ ছিল ১০৩ টাকা।

এমন এক সময় বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরশাসন প্রচলিত ছিল। সেই সময় প্রতি বছর কত পরিমাণ বিদেশি ঋণ গ্রহণ করতে পারছে তার উপর সরকারের সাফল্য নির্ভর করতো। অর্থাৎ মনে করা হতো যে সরকার যত বেশি পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ আনতে পারবে সেই সরকারের প্রতি বিদেশিদের আস্থা তত বেশি। এটাকেই সাফল্য হিসেবে মনে করা হতো। এভাবে ঢালাও ঋণ গ্রহণের ফলে এমন অবস্থা হয়েছিল যে, আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থাগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতিমাত্রায় প্রভাব বিস্তার করতে পারতো। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিরা যেভাবে আর্থিক নীতি-কৌশল গ্রহণ করতে পরামর্শ দিতো সরকার ঠিক সেভাবেই কাজ করতো।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকারের সূচনা হয়। অনেকেই মনে করেছিলেন, গণতান্ত্রিক সরকার আমলে নিশ্চিতভাবেই উন্নয়ন সহযোগীদের দাপট হ্রাস পাবে। কিন্তু তা হয়নি। এখনো সরকার নানাভাবে বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শ নামক আদেশ নেমে চলছে।

উন্নয়ন সহযোগী যারা ঋণদান করে তারা নানাভাবে তাদের এজেন্ডা সরকারের উপর চাপিয়ে দেয়। কিন্তু একবারও প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় না যে, আমরা ঋণ গ্রহণ করবো। ঋণের কিস্তি সুদ সমেত নির্দিষ্ট সময়ে ফেরৎ দেবো। তাহলে সেই ঋণের অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা কেনো থাকবে না? উন্নয়নশীল দেশগুলো বিদেশি ঋণের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল বলে তারা উন্নয়ন সহযোগীদের পরমার্শ না মেনে চলতে পারে না। উন্নয়নশীল দেশগুলো ঋণদানের নামে উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন নীতিমালা ঋণ গ্রহীতা দেশের ওপর চাপিয়ে দেয়। উন্নয়ন সহযোগীরা ঋণ দান করে। এর বিপরীতে তারা সুদসমেত নির্ধারিত সময়ে ঋণের কিস্তি আদায় করে থাকে।

উন্নয়নশীল দেশগুলো যদি এই ঋণ গ্রহণ না করে তাহলে কথিত উন্নয়ন সহযোগীদের কার্যক্রম বন্ধ বা সীমিত হয়ে যেতো। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো বিদেশি সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণ করতে বড়ই তৎপর। তারা যে কোনোভাবেই হোক উন্নয়ন সহযোগীদের নিকট থেকে ঋণ পেতে আগ্রহী। একটি দেশের অর্থনীতিতে যত ধরনের দুর্নীতি সংঘটিত হয় তার একটি বড় অংশই হয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিকট থেকে গৃহীত ঋণের অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো গ্রহীতা দেশগুলোকে বেশি বেশি করে ঋণ গ্রহণের জন্য নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করে। এমনকি দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের এরা নানাভাবে আর্থিক সুবিধাও দিয়ে থাকে। গৃহীত ঋণ যেসব প্রকল্পে ব্যবহার করা হয় সেই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ, আর্থিক উপঢৌকন প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের মনোরঞ্জন করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের অনেকেই এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি হন না। পৃথিবীতে সম্ভবত একটি দেশের উদাহরণও দেয়া যাবে না যারা বিশ^ব্যাংক এবং ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড’র (আইএমএফ) মতো সংস্থাগুলোর নিকট থেকে ঢালাও ঋণ গ্রহণ করে কাক্সিক্ষত মাত্রায় জাতীয় উন্নয়ন সাধন করতে পেরেছে। বিশেষ করে আইএমএফ কখনোই শর্তহীন ঋণদান করে না। তাদের দেয়া ঋণের শর্ত কখনোই একটি দেশের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সাধন করে না। তাদের দেয়া শর্তাদি মূলত সা¤্রাজ্যবাদি দেশগুলোর উদ্দেশ্য সাধন করে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সরকার আমলে ব্যাপক মাত্রায় বিদেশি ঋণ গ্রহণ করে চলেছে। এসব ঋণের অর্থ ব্যবহার করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের চেষ্টা করা হচ্ছে। উন্নয়ন হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সেই উন্নয়ন কতটা টেকসই তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। বৈদেশিক ঋণের অর্থ ব্যবহার করে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় তা সমাপ্ত হতে অস্বাভাবিক সময় ক্ষেপন হয়। এতে প্রাক্কলিত ব্যয়ের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। এ জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। ইউটিউবের কল্যাণে একটি ছবি বিভিন্নভাবে আমাদের দেখার সুযোগ হয়েছে। এতে দেখা যায়, একজন আফগানমন্ত্রী রাস্তার নির্মাণ কাজ তদারকি করছেন। তিনি সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, আগামী এক বছরের মধ্যে যদি এই রাস্তার কার্পেটিং উঠে যায় তাহলে আপনার মাজার এখানে তৈরি করা হবে। অর্থাৎ তাকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে এখানেই কবরস্থ করা হবে। আমাদের দেশে কি রাস্তাঘাট নির্মাণ কাজের জন্য এমন তদারকি প্রত্যাশা করা যায়? আমাদের দেশে লোহার রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করে অবকাঠামো নির্মাণ করলেও কোনো অসুবিধা হয় না। বাংলাদেশে বিদেশি ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়ন অর্থই হচ্ছে কিছু মানুষের ভাগ্য খুলে যাওয়া। দেখা যায়, অধিকাংশ প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়িত হয় না। ফলে প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। একটি প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন সম্পন্ন না হলে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী, যিনি প্রকল্পের ডিজাইন তৈরি করেন এবং যে ঠিকাদার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্বে থাকেন তাদের উভয়কেই শাস্তির আওতায় আনা যেতে পারে। কারণ তারা রাষ্ট্রীয় অর্থে বেতন-ভাতা নিয়ে প্রকল্পের ডিজাইন তৈরি করেন। সেই ডিজাইন অনুযায়ী যদি সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা না যায় এবং ব্যয় বৃদ্ধি পায় তাহলে তার দায়ভার কেনো সাধারণ মানুষের উপর বর্তাবে?

অনেকেই বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখনো সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। কাজেই বাংলাদেশ কখনোই শ্রীলঙ্কার মতো হবে না। এটি অস্বীকার করা যাবে না যে, বাংলাদেশের গৃহীত বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখনো তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু যেভাবে ঋণ গ্রহণ করা হচ্ছে তাতে আগামীতে যে কোনো সময় বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণের ফাঁদে পড়ে যেতে পারে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৫৩ বছরে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করেছে। গত ডিসেম্বর মাস শেষে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণের স্থিতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ১১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন টাকা। এর মধ্যে ৮৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৮২ শতাংশই হচ্ছে প্রকল্প ঋণ। ঋণদানের ক্ষেত্রে সবার শীর্ষে রয়েছে বিশ^ব্যাংক। দ্বিতীয় অবস্থানে জাপান। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে চীন। চীন থেকে যেভাবে বর্ধিত হার ঋণ গ্রহণ করা হচ্ছে তাদের আগামীতে চীন বাংলাদেশকে ঋণদানের ক্ষেত্রে শীর্ষ অবস্থানে চলে যেতে পারে। চীনের দেয়া ঋণের সবচেয়ে সুবিধা হচ্ছে তারা সাধারণত ঋণদানের ক্ষেত্রে তেমন কোনো কঠিন শর্তারোপ করে না। বর্তমান সময়ে অনেক দেশই চীন থেকে বর্ধিত পরিমাণে ঋণ গ্রহণ করছে। এভাবে দেশগুলো চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কাও চীনের ঋণ ফাঁদে পড়েছে। বাংলাদেশ যেভাবে চীন থেকে ঋণ গ্রহণ করছে তা আগামীতে এক সময় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিদেশি ঋণের পরিমাণ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি ঋণের সুদ এবং আসল পরিশোধের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল বাবদ বাংলাদেশকে ১৭৩ কোটি মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। ২০২০-২০২১ সালে এটা ছিল ১৯১ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে ২০১ কোটি মার্কিন ডলার এবং পরের বছর ২৬৮ কোটি মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে ঋণের আসলে ও সুদ বাবদ। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে এটা ছিল ১২৯ কোটি মার্কিন ডলার। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের (২০২৩-২০২৪) প্রথম ১১ মাসে বাংলাদেশকে বৈদেশিক ঋণের সুদ এবং আসল বাবদ ৩০৭ কোটি মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে প্রথম ১১ মাসে অনুমোদিত বৈদেশিক ঋণের অর্থ ছাড় পাওয়া গেছে ৭০২ কোটি মার্কিন ডলার। আগের বছর এটা ছিল ৬৯৮ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ৭৯২ কোটি মার্কিন ডলার। আগের বছর এটা ছিল ৫৯৭ কোটি মার্কিন ডলার।

আগামীতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণপ্রাপ্তি বাংলাদেশের জন্য কঠিন হবে। কারণ বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে তুলনামূলক কম সুদে এবং সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উন্নীত হলে এই সুবিধা আর থাকবে না। তখন উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণ করতে হবে। সেই ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও থাকবে কম। বাংলাদেশ যেভাবে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করছে তাতে আগামীতে নতুন করে ঋণ নিয়ে আগের ঋণের কিস্তি এবং সুদ পরিশোধ করতে হতে পারে। কাজেই বাংলাদেশকে এখনই বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। ঋণ গ্রহণ করে যে সব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বা গ্রহণ করা হচ্ছে তা জাতীয় স্বার্থে কতটা প্রয়োজন তা ভালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। বর্তমানে যে ঋণ গ্রহণ করা হচ্ছে তার দায়ভার বা পরিশোধের দায়িত্ব বর্তাবে আগামী প্রজন্মের উপর। আমরা নিশ্চয়ই আগামী প্রজন্মকে ঋণগ্রস্ত হিসেবে রেখে যেতে পারি না।

https://dailysangram.com/post/560184