৩ জুলাই ২০২৪, বুধবার, ৫:০০

দেশজুড়ে বাড়ছে পানি ডুবছে জনপদ, আতঙ্কে মানুষ

ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের অধিকাংশ নদ-নদীতে বাড়ছে পানি। বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। টানা বৃষ্টিতে ইতোমধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার প্রধান নদ নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। তলিয়ে গেছে অনেক অঞ্চলের নদী তীরবর্তী এলাকা। এর মধ্যে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক অবস্থানে রয়েছে। সাম্প্রতিক বন্যায় এই দুই জেলার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই ধেয়ে আসা তৃতীয় দফার বন্যার কারণে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, সারাদেশে চলমান বৃষ্টিপাত চলতি সপ্তাহে আরও বাড়তে পারে। ফলে দেশের উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীগুলোর পানি বেড়ে এসব জেলায় স্বল্পমেয়াদি বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা সতর্কীকরণ ও পূর্বাভাস কেন্দ্র বলছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পেয়ে কয়েকটি পয়েন্টে বিপৎসীমা ছাড়াতে পারে। এর ফলে এসব এলাকার নি¤œাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বৃষ্টিপাত ও বন্যা সংক্রান্ত এ পূর্বাভাস দিয়েছে পাউবো। অপরদিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তিন জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার নি¤œাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে এবং মৌলভীবাজারের বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকবে বলে জানিয়েছে বন্যা সতর্কীকরণ ও পূর্বাভাস কেন্দ্র।

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মুহুরী, ফেনী, হালদা, সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হতে পারে।

জানা গেছে, ইতোমধ্যে দুই জেলার বিভিন্ন উপজেলার নি¤œাঞ্চল তলিয়ে গেছে। সুনামগঞ্জে অনেক অভ্যন্তরীণ সড়কে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন নি¤œাঞ্চলের মানুষ। নতুন করে দেখা দিয়েছে ভাঙন আতঙ্ক। পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও মধ্যাঞ্চল শেরপুরের বিভিন্ন নদীতেও পানি বাড়ছে। অন্যদিকে পার্বত্য জেলাগুলোর কোথাও কোথাও ভূমিধসের শঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। আজ ভোরে খাগড়াছড়ির আলুটিলার সাপমারায় পাহাড় ধসে ঢাকা-খাগড়াছড়ি ও ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।

এদিকে দ্বিতীয় দফা বন্যার পানি নামতে না নামতে তৃতীয় দফা বন্যায় আক্রান্ত সিলেটবাসী। সোমবার সকাল থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত অতিবৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলে তৃতীয়বারের মতো প্লাবিত সিলেটের নি¤œাঞ্চল। জেলার জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট ও গোয়াইনঘাট উপজেলার নি¤œাঞ্চলের মানুষ ইতোমধ্যে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানি বেড়েছে সুরমা, কুশিয়ারা ও সারি নদীতে। সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মোহাম্মদ সজীব হোসেন জানান, সোমবার সকাল ছয়টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত ২৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আগামী কয়েকদিন আরও বৃষ্টি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় আবারও বাড়তে শুরু করেছে সিলেট ও সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি। এরই মধ্যে নি¤œাঞ্চলে পানি প্রবেশ করে অনেক এলাকা পুরোপুরি ডুবে গেছে। গতকাল সোমবার সকালে সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করে বলে জানিয়েছে সিলেট পাউবো। আবার পাহাড়ি ঢলের কারণে পানি যাদুকাটা নদী হয়ে তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়কের আনোয়ারপুরের একটি অংশ প্লাবিত করেছে। পানি বৃদ্ধির এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। ফলে খেয়া নৌকা ব্যবহার করছেন স্থানীয়রা।

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানিয়েছেন, বন্যার শঙ্কা করা হচ্ছে। পানি বাড়তে থাকলে আবারও বন্যা হবে। গতকাল সোমবার সিলেটে ১৭৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে জানান সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন।

অন্যদিকে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, উজানের ঢল আর ভারী বৃষ্টিতে সুনামগঞ্জের অনেক নিচু সড়ক প্লাবিত হয়েছে। এতে স্বল্পমেয়াদি বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুরে দেখা দিয়েছে বন্যা। তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়কের আনোয়ারপুর-বালিজুড়ি রাস্তা, শক্তিয়ারখলা ১০০ মিটার রাস্তা ও লালপুর সড়কটি এখন ৩ ফুট পানির নিচে। এ রাস্তায় চলাচলকারী লোকজন নৌকা কিংবা বিকল্প যানবাহনে চলাচল করছেন।

শুরু সিলেট সুনামগঞ্জেই নয়, দেশের উত্তরাঞ্চলের সব নদ-নদীর পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রংপুর বিভাগের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কিছু কিছু এলাকায় বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করবে আগামী বুধবার থেকে। সব মিলিয়ে সামনের এক সপ্তাহ দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদী তীরবর্তী মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকবে না।

ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে রংপুরে তিস্তা নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। কাউনিয়ার তিস্তা রেলসেতু পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। দু’দিনের বৃষ্টি এবং উজানের ঢলে গাইবান্ধার প্রধান চার নদনদীর পানি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। সেখানকার তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। তবে ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া ও ঘাঘট নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। টানা বৃষ্টিতে নেত্রকোনার প্রধান নদী উব্ধাখালী নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমা ছাড়িয়ে গেছে। এ ছাড়া সোমেশ্বরী ও কংশের পানিও বেড়ে চলেছে।

ভারতীয় আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুসারে গত শনিবার সকাল থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পর্বত এলাকায় ৮০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের উজানে ভারতীয় এলাকায় হওয়া বৃষ্টির পুরো পানিটাই নেত্রকোনা, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার নদীগুলো দিয়ে নিচে নেমে আসবে। বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে থাকবে।

আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মাঝারি থেকে ভারী এবং আগামী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। ফলে এ সময় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদীগুলোর পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে। একইসঙ্গে আগামী ৭২ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা, কুশিয়ারা, পুরাতন-সুরমা, সারিগোয়াইন নদীর পানি সমতল দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার কতিপয় নি¤œাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। অপরদিকে বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তায় আগামী কয়েকদিন বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে।

গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার চেল্লাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ২৪৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একইসঙ্গে বেড়েছে ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশি ও সোমেশ্বরী এবং নালিতাবাড়ী উপজেলার ভোগাই, সদর উপজেলার মৃগী ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি। তবে চেল্লাখালী ছাড়া এখনো সব নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় শেরপুরে ৩০৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী ৭২ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, শেরপুরসহ আশপাশের এলাকায় ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হতে পারে।

দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজানের পানিতে মুহুরী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে ফেনীর নি¤œাঞ্চল।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ১৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের চারটি স্থান ভেঙে জেলার ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার প্রায় ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

এছাড়া পাহাড়ি ঢলে ফেনীর ফুলগাজীর মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধে তিনটি জায়গায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। জেলার ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে যমুনা নদীতে একদিনে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৩ সেন্টিমিটার। এছাড়াও জেলার ছোট-বড় সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। মঙ্গলবার সকালে টাঙ্গাইল জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নূরুল আমিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তৃতীয় দফা বন্যার কবলে সিলেট
সিলেট ব্যুরো: সিলেটে সোমবার দিন ও রাতভর বৃষ্টি হয়েছে। ফলে নদ-নদীর পানি বেড়ে নতুন করে আরও এলাকা প্লাাবিত হয়ে চলমান বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। তলিয়ে গেছে জেলার ৪টি উপজেলা। নগরীরও অনেক এলাকায় রাস্তাঘাটে পানি উঠে পড়ে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে সিলেটে ৫টি নদীর পানি ৬টি স্থানে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সকাল পর্যন্ত ২৭ ঘণ্টায় সিলেটে ৩ শ’ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।

মাত্র ৩৫ দিনের মধ্যে সিলেটে তৃতীয়বার বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট। দ্বিতীয় দফার বন্যায় ৭ লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দী। এরই মাঝে অবিরাম বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে মঙ্গলবার নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে জেলার ৪টি উপজেলায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন- আগামী ৩ দিন সিলেটে ও উজানে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। সিলেটে গত ২৭ মে আগাম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দুই সপ্তাহব্যাপী স্থায়ী এ বন্যায় পানিবন্দী ছিলেন ১০ লাখেরও বেশি মানুষ। প্রথম বন্যার পানি পুরোপুরি নামার আগেই ১৫ জুন থেকে ফের বন্যা হয় সিলেটে। ১৭ জুন ভোররাত থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার অতিভারী বর্ষণে মহানগরসহ সিলেটের সব উপজেলায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। পরবর্তী এক সপ্তাহ সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি ছিলো ভয়াবহ। এরপর পানি নামতে শুরু করে। তবে সে গতি ছিলো খুব ধীর।

দ্বিতীয় দফা বন্যা শেষ হওয়ার আগেই সোমবার থেকে সিলেটে তৃতীয় দফা বন্যার আশঙ্কা দেখা দেয়। রোববার দিনভর সিলেটে থেমে থেমে ও উজানে ভারী বৃষ্টির ফলে নতুন করে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জেলার কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও গোয়াইনঘাট উপজেলার যেসব এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছিল সেসব এলাকা গতকাল ফের প্লাবিত হয়েছে।

জানা যায়, সোমবার সকাল থেকে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কানাইঘাটে সুরমা ও লোভা নদীর পানি দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। ফলে আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত সুরমা ডাইকের অন্তত ১৮টি স্থান দিয়ে সুরমা ও লোভা নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার প্রত্যন্ত জনপদ ফের বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। নতুন করে প্লাবিত বাড়ি-ঘরের মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যাচ্ছেন। এছাড়া বিভিন্ন বাজার তলিয়ে পানি ঢুকেছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। এতে নতুন করে ক্ষতিতে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া প্লাবিত হয়েছে কোম্পানীঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার নতুন নতুন এলাকা। ফলে তৃতীয় দফা ভোগান্তিতে পড়েছেন মানুষজন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয় সূত্র গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টায় জানায়, সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৭ ঘণ্টায় সিলেটে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। পাউবো আরও সূত্র জানায়, মঙ্গলবার সকাল ৯টায় সিলেটের ৫টি নদীর পানি ৬ পয়েন্টে বিপৎসীমার উপরে ছিলো। এর মধ্যে সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ১১৮ সে.মি., কুশিয়ারার পানি আমলশীদ পয়েন্টে ৭১ সে.মি, এ নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি ২২ সে.মি ও কুশিয়ারা পয়েন্টে ০.৭ এবং সারিগোয়াইন নদীর পানি গোয়াইনঘাট পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে বলে জানায় পাউবো।
এদিকে, সোমবার রাতে জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়- এদিন দুপুর পর্যন্ত সিলেট মহানগর ছাড়া জেলার সব উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি চলমান আছে। জেলার ১ হাজার ৮১টি গ্রামের ৭ লাখ ৩ শ ৩৬ জন মানুষ পানিবন্দী। এসব উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্রে ৮ হাজার ৩০৮ জন মানুষ রয়েছেন। বন্যার্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া জেলা প্রশাসন ও প্রত্যেক উপজেলা প্রশাসন কার্যালয়ে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। প্রতি ইউনিয়নে মেডিকেল টিম গঠন করে বন্যার্ত অসুস্থ মানুষকে প্রদান করা হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা।

ছাতকে ফের বন্যার আশঙ্কা
ছাতক (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা: আবারো উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল এবং মুষলধারে বৃষ্টির কারণে ছাতকে বন্যার আশঙ্কা। গত ২৪ ঘণ্টার ভারী বৃষ্টিপাতে বাড়তে শুরু করেছে ছাতকের নদ-নদীসহ হাওড়াঞ্চলের পানি। ইতিমধ্যে নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফলে ফের বন্যা হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন নি¤œাঞ্চলের মানুষ। উপজেলার ইছামতি-ছনবাড়ীবাজার, রহমতপুর, নাছিমপুরবাজার বিভিন্ন নিচু যায়গা পানিতে তলিয়ে গেছে। গত ১৭ জুন সৃষ্ট বন্যায় উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে নি¤œাঞ্চলের অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। গত মঙ্গলবার (২ জুলাই) দুপুরে ছাতকের সুরমা নদীর পানি ০.৭২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৯.৬৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের গনেশপুর গ্রামের বাসিন্দা শামসুজ্জামান বলেন, গত কয়েকদিন আগে হওয়া বন্যায় আমরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। আগের বন্যার পানি এখনো নামেনি, আবারো পানি বাড়ছে। এ যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাতক পৌরসভার ০৮ নং ওয়ার্ডের চরেরবন্দ এলাকার বাসিন্দা এস.এ শাহিন বলেন, বন্যার কারণে আমরা ঈদুল আযহার আনন্দ উপভোগ করতে পারিনি। বন্যার পানি আমাদের সর্বস্বান্ত করেছে। এভাবে যদি আবারও বন্যার পানি বাড়তে থাকে। তাহলে আমাদের দুর্দশার কোনো শেষ হবে না। এখন আবার পানিবন্দী বাড়ি থেকে বাহির হতে পারতেছি না সড়কে হাঁটু পানির জন্য। গত কয়েক দিন আগের বন্যায় ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী-মা কে নিয়ে পাশের দু-তলায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। আবারো মনে হয় দু-তলায় আশ্রয় নিতে হবে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান, গত সোমবার সকাল থেকে নদীর পানি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। এর ফলে বন্যা হতে পারে, তবে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হবে না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম মোস্তাফা মুন্না বলেন, খবর নিয়েছি, নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। বন্যা মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে।

ঝিনাইগাতীতে শতশত মানুষ পানিবন্দী
ঝিনাইগাতী (শেরপুর) সংবাদদাতা: গত ৩ দিনের অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ঝিনাইগাতী উপজেলার ৬ টি ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। রোববার থেকে গত ৩ দিনের ভারি বর্ষন ও মহারশি, কালঘোষা, সোমেশ্বরী নদীর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। মঙ্গলবার সকাল থেকে মহারশি, সোমেশ্বরী ও কালঘোষা নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। মহারশি নদীর ঢলের পানির তোড়ে খৈলকুড়া বন্যানিয়ন্ত্রন বাঁধ ভেঙে গেছে। দীঘিরপাড় বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করে ৩ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ঢলের পানি প্রবেশ করে ৬টি ইউনিয়নের প্রায় ২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। শতশত মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ঢলের পানিতে আবু হারেজ নামে এক ব্যক্তির ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মহারশি নদীর পানি ঝিনাইগাতী বাজারে প্রবেশ করেছে।তাতে ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে ঢলের পানিতে তলিয়ে শতাধিক পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঢলের পানিতে তলিয়ে শতাধিক একর জমির বীজতলা ও শতাধিক একর জমির আউশ ধানের ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ঢলের পানির তোড়ে গ্রামীন রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হয়ে চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ অফিস, প্রাণী সম্পাদক অফিস, সাবরেজিস্ট্রার অফিস সহ বেশ কয়েকটি সরকারি দপ্তরে ঢলের পানি প্রবেশ করে কর্মকা- ব্যাহত হয়। উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশরাফুল আলম রাসেল, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান পানিবন্দী ও ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন।

শেরপুরে চেল্লাখালি নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে
শেরপুর জেলা সংবাদদাতা: গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার চেল্লাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ২৪৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একইসাথে মহারশি ঝিনাইগাতী সামেশ্বরী এবং নালিতাবাড়ী উপজেলার ভোগাই, সদর উপজেলার মৃগী ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি। তবে চেল্লাখালি ছাড়া এখনও সব নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘন্টায় শেরপুরে ৩০৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী ৭২ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, শেরপুরসহ আশপাশের এলাকায় ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। চলমান পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী, শ্রীবরদী ও শেরপুর সদর স্বল্পমেয়াদী বন্যার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

এদিকে পাহাড়ি ঢলের প্রবল স্রোতে ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশি নদীর কাঁচা বাঁধের কয়েকটি স্থানে ভাঙনের ফলে নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে বিভিন্ন এলাকায় কলা চাষি ও মাছ চাষিরা করেছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢলের পানি নেমে না দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। ইতিমধ্যে ঝিনাইগাতী নিচু জমিত পানি প্রবেশ গেলে আমনের বীজতলা ও সবজি ক্ষেতের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান বলেন, ইতিমধ্যে ঝিনাইগাতীর মহারশি নদীর ভাঙা স্থানে মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ফেনী শহরের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত
ফেনী সংবাদদাতা: সোমবারের ভারী বর্ষণের ফলে ফেনী শহরের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় এর চেয়ে অনেক কম বৃষ্টিতেও পাড়া মহল্লার সড়কগুলো হাঁটু পানিতে নিমজ্জিত হয়। অন্যতম প্রধান সড়ক এসএসকে রোড, নাজির রোড,ফালাহীয়া মাদ্রাসা রোড, শান্তি কোম্পানী রোড, একাডেমী রোড, মাষ্টার পাড়া রোড, পেট্রো বাংলা রোড, পাঠান বাড়ী রোড পানিতে ডুবে যায়। ফলে মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।

শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। কিন্তু ড্রেনেজ সিষ্টেম আধুনিকায়নে কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এতে পৌরবাসী ক্ষুব্ধ।

গাইবান্ধায় নতুন করে বাড়ছে সব নদ-নদীর পানি
গাইবান্ধা থেকে জোবায়ের আলী : কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ ও উজানের নেমে আসা পানিতে নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে গাইবান্ধায় সব নদ-নদীর পানি। তবে পানি বাড়লেও এখনো বিপৎসীমার সামান্য কিছুটা নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।অনবরত বর্ষন হলে যে কোন সময় বিপদ সীমা অতিক্রম করতে পারে।গতকাল মঙ্গলবার (২ জুলাই) তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার (সি. মি) নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে জেলার ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ঘাঘট ও করতোয়া নদীর পানিও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই চরাঞ্চলসহ বেশ কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে শুরু করেছে
বিকেল ৩টার পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, ফুলছড়ি পয়েন্টে যমুনা ব্রহ্মপুত্রের পানি ৫৯ সে.মি.বৃদ্ধি পেয়ে এখন বিপৎসীমার ৪৯ সে.মি. নিচ দিয়ে, নিউব্রীজ পয়েন্টে ঘাঘট নদী ৬৬ সে.মি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১০৩ সে.মি. নিচ দিয়ে, চকরহিমাপুর পয়েন্টে করতোয়া পানি ১৪ সে.মি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৩১৫ সে.মি. নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পানি বৃদ্ধির কারণে গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি, মোল্লারচর, গিদারি, ঘাগোয়া ও ফুলছড়ি উপজেলার এরেন্ডাবাড়ি, ফুলছড়ি ও ফজলুপুর এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর, কাপাসিয়া ও হরিপুর ইউনিয়নের নিম্নঞ্চলে পানি ঢুকেছে।গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাফিজুল ইসলাম বলেন, আমরা সার্বক্ষণিক নদীপাড় ও ভাঙনের খবর রাখছি। ভাঙন কবলিত নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙনরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।

https://www.dailysangram.info/post/560251