৩ জুলাই ২০২৪, বুধবার, ৪:৫৬

এখনো কেন চালের বাজার অস্থির?

-আবদুল লতিফ মন্ডল

দেশে চালের ক্রেতা-ভোক্তারা আশা করেছিলেন, চাল উৎপাদনে শীর্ষে থাকা বোরো ধান কাটা-মাড়াইয়ের মৌসুমে চালের দাম কমবে। তাদের সে আশা পূরণ হয়নি। নতুন বোরো চালের দাম না কমে বরং বাড়ছে। চালের দামে ঊর্ধ্বগতির খবর গুরুত্বসহকারে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ২৯ জুন দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন কিচেন মার্কেটে প্রায় সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধানের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং ঈদুল আজহার সময় চালকল বন্ধ থাকায় চালের দাম ৫০ কেজির বস্তায় ৫০ থেকে ১০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২৮ জুন বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক মাসের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) চালের দাম বেড়েছে ১০০ থেকে সর্বোচ ৪০০ টাকা। মূল্যস্ফীতি, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং ঈদে পরিবহণ বন্ধ থাকায় চালের দাম বাড়াতে হয়েছে বলে জানান চালকল মালিকরা। আড়তদাররা বলছেন, চালকল মালিকরা দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় তাদেরও বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মোটা চালের কেজিপ্রতি দাম ৫ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে। মিনিকেট ও নাজিরের মতো চিকন চালের ক্ষেত্রে এ দাম বেড়েছে ৬ থেকে ৮ টাকা। এর আগে টিসিবির তথ্যের বরাত দিয়ে ২১ জুন যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, খুচরা বাজারে এক সপ্তাহ আগে যে সরু চাল ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, সেই একই চাল ২০ জুন বিক্রি হচ্ছে ৬৮ টাকায়। সাতদিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ৮ টাকা। এছাড়া খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ভালো মানের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮৫ টাকায়। প্রতি কেজি মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫৫ টাকায়, যা গত বছর একই সময় ৪৮ থেকে ৫০ টাকা ছিল। মাঝারি চালের মধ্যে পাইজাম ও বিআর ২৮ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়, যা গত বছর ঠিক একই সময় ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বোরোর ভরা মৌসুমে চালের দাম বৃদ্ধিতে চালকল মালিক, আড়তদার ও চাল ব্যবসায়ীদের দাবি কতটা সঠিক তা পর্যালোচনা এবং চালের দামে ঊর্ধ্বমুখিতার আসল কারণ অনুসন্ধান করা এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

দেশে উৎপাদিত চালের কম-বেশি ৫৫ শতাংশ আসে বোরো থেকে। আর কম-বেশি ৩৫ শতাংশ আসে আমন থেকে। বাকিটুকু আসে আউশ থেকে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মতে, আউশ ও আমনের তুলনায় বোরো মৌসুমে নির্বিঘ্নে ধানচাষ করা যায় এবং যথাযথ পদ্ধতিতে বোরো ধানচাষ করা হলে আকস্মিক বন্যা, শৈত্যপ্রবাহ, শিলাবৃষ্টি, লবণাক্ততা, জলোচ্ছ্বাসের মতো ঝুঁকি এড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত ফলন অর্জন সম্ভব হয়। বোরোর ফলন আমন ও আউশের চেয়ে ভালো। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩-এর তথ্য মোতাবেক ২০১৯-২০, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে যখন বোরো চালের উৎপাদন দাঁড়ায় যথাক্রমে ২ কোটি ১ লাখ ৮১ হাজার টন, ১ কোটি ৯৮ লাখ ৮৫ হাজার টন এবং ২ কোটি ৯ লাখ ৭৭ হাজার টনে, তখন আমনের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১ কোটি ৫০ লাখ টন, ১ কোটি ৪৪ লাখ ৩৮ হাজার টন এবং ১ কোটি ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার টন। বোরোর ভালো ফলন যেমন চাষিদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে, তেমনি দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে জোরদার করে।

ঈদুল আজহার পর চালের দাম বাড়ার জন্য চালকল মালিকরা মূল্যস্ফীতি, উৎপাদন খরচ ও ঈদে পরিবহণ বন্ধ থাকাকে দায়ী করেছেন। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ঈদুল আজহার আগে অর্থাৎ ১৭ জুনের আগে প্রায় সব ধরনের চালের দাম বর্তমান দামের তুলনায় কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা কম ছিল। ১৭ জুনের পর নতুন করে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে বলে জানা নেই। হাসকিং মিল বা স্বয়ংক্রিয় চালকলে ধানকে চালে রূপান্তর করা হয়। ধান থেকে চাল তৈরির প্রক্রিয়ায় খরচ বৃদ্ধির কোনো কারণ সম্প্রতি ঘটেছে বলেও জানা নেই। ঈদের সময় চাল পরিবহণে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সরকারি নির্দেশে বলা হয়, ‘ঈদের দিন এবং আগে-পরে ছয়দিন ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও লরি চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, পচনশীল দ্রব্য, গার্মেন্ট সামগ্রী, ওষুধ, সার ও জ্বালানি বহনকারী যানবাহন চলবে।’ উল্লেখ্য, জনশুমারি ২০২২ অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ বাস করে গ্রামে। ধান কাটা-মাড়াইয়ের মৌসুমে গ্রামে ভূমিহীন মজুর, শ্রমিক ও দুস্থরা ছাড়া অন্যরা নিজেদের উৎপাদিত চালে জীবনধারণ করেন। এ সময় গ্রামাঞ্চলে ট্রাকে চাল পরিবহণের তেমন প্রয়োজন হয় না। রাজধানীসহ শহরাঞ্চলে বসবাসকারী এক-তৃতীয়াংশ মানুষের জন্যই কেবল চাল পরিবহণ দরকার হয়।

এখন দেখা যাক চালের দামে ঊর্ধ্বমুখিতার সম্ভাব্য কারণ কী হতে পারে।
এক. মুক্তবাজার অর্থনীতির অজুহাতে দেশের প্রধান খাদ্য চালের মূল্য নির্ধারণে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। চালের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হবে মর্মে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা একাধিকবার বক্তব্য রাখলেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। সর্বশেষ ৩১ মার্চ বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, ‘বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে জাত ও উৎপাদন খরচের ভিত্তিতে আগামী পয়লা বৈশাখ থেকে চালের দাম ঠিক করে দেওয়া হবে’ (সমকাল, ১ এপ্রিল)। এ বক্তব্যের বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন মূলত চালকল মালিকরা। এ মুহূর্তে জরিপ করলে দেখা যাবে, দেশে মজুত ধান-চালের বেশির ভাগ রয়েছে চালকল মালিকদের কাছে। ২০১৯ সালে পরিচালিত এক অনুসন্ধান রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুনে ধানের মজুতে বড় ও মাঝারি কৃষকের অংশ ছিল ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশের মধ্যে ৬০ শতাংশের কিছুটা বেশি মজুত ছিল চালকল মালিকদের কাছে। অবশিষ্ট কম-বেশি ২০ শতাংশ মজুত ছিল ব্যবসায়ীদের কাছে। মজুত ধান চালে রূপান্তর করে সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে ধীরে ধীরে বাজারে ছাড়েন। এখনো তা-ই ঘটছে। চালকল মালিকরা দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় তাদেরও বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে, আড়তদারদের এমন বক্তব্য থেকে এর সত্যতার প্রমাণ মেলে।
দুই. সরকারকে চাল সরবরাহে চালকল মালিকদের রয়েছে একচেটিয়া আধিপত্য। অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহে সরকার চালকল মালিকদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সরকারের চলমান চাল সংগ্রহ নীতিমালায় দেশে উৎপাদিত চাল সংগ্রহের জন্য চালকল মালিক ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উৎস নেই। ২০০৬ সালের জাতীয় খাদ্যনীতিতে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে চাল ও অন্যান্য খাদ্যশস্য কেনার নির্দেশ থাকলেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। চালকল মালিকরা এ সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করছেন। সরকার চাষিদের কাছ থেকে খুব সামান্য পরিমাণ ধান কেনে। এ সুযোগে চালকল মালিকরা ধান কাটা-মাড়াইয়ের মৌসুমে সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে স্বল্প দামে প্রচুর পরিমাণে ধান কিনে মজুত করেন। তারা এ ধান চালে রূপান্তর করে সরকারকে চুক্তিবদ্ধ চাল সরবরাহ করেন। অবশিষ্ট থেকে যাওয়া চালের বড় অংশটি সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে সময় ও সুযোগ বুঝে চড়া দামে বিক্রি করে লাভবান হন। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন চাল ক্রেতারা।

তিন. সরকার গত জুলাইয়ে ‘খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহণ, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন, ২০২৩’ পাশ করেছে। এ আইনের ২নং ধারায় মজুতের সংজ্ঞা নির্ধারণে বলা হয়েছে, ‘মজুত (hoarding)’ অর্থ কোনো ব্যক্তি কর্তৃক কোনো মিল, কারখানা, গুদামঘর, যানবাহন বা অন্য কোনো স্থানে সরকার কর্তৃক, সময় সময়, প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত পরিমাণের অধিক পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য মজুত রাখা। আইনটির ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সরকার কর্তৃক, সময় সময়, প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত পরিমাণের অধিক পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য মজুত করলে বা মজুতসংক্রান্ত সরকারের নির্দেশ অমান্য করলে তা হবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি যাবজ্জীবন বা অনূর্ধ্ব ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।’ প্রশ্ন হলো, সরকার কি চালকল মালিক, নিজ মিলে ধান থেকে চাল তৈরি ও চাল ব্যবসা সঙ্গে জড়িত করপোরেট কোম্পানির মালিক, বড় ও মাঝারি কৃষক, আড়তদার প্রমুখ কর্তৃক ধান ও চাল মজুতের পরিমাণ, সময়কাল ইত্যাদি নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে? না করলে অবৈধ মজুতদার চিহ্নিত করা যাবে কীভাবে? আর অবৈধ মজুতদারি বন্ধ না করা হলে চালের বাজারে অস্থিরতা থাকবেই।

চার. দেশ চাল উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করলেও এখনো পণ্যটিতে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারেনি। এবার দীর্ঘ খরার কবলে পড়ে বোরোর আবাদ। গত ৭৬ বছরের রেকর্ড ভাঙা তাপপ্রবাহের কবলে পড়ে এবারের বোরো ফসল। এবার বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার (২ কোটি ২২ লাখ টন) চেয়ে ২ লাখ টন বেশি হয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) দাবি অভিজ্ঞজনদের বিশ্বাসযোগ্যতা পাচ্ছে না। কারণ, চাল উৎপাদনের পরিমাণ বেশি করে দেখানোর প্রবণতা ডিএই’র রয়েছে। এর আগে চাল উৎপাদন নিয়ে একাধিকবার বিবিএসের তথ্যের সঙ্গে ডিএই’র তথ্যের অনেক ফারাক দেখা গেছে। অর্থাৎ বিবিএসের তথ্যের তুলনায় ডিএই’র তথ্যে চালের উৎপাদন বেশি করে দেখানো হয়েছে। সুতরাং, বিবিএসের তথ্য প্রকাশের পরই জানা যাবে এবার কী পরিমাণ বোরো চাল উৎপাদিত হয়েছে। এদিকে সরকারি হিসাবে বছরে ২০ লাখ নতুন মুখ আমাদের খাবারে ভাগ বসাচ্ছে। তাছাড়া প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে খাওয়াতে হচ্ছে আমাদের। দেশের প্রয়োজনের তুলনায় চাল উৎপাদিত না হওয়ায় চালের বাজারকে অস্থির করে তোলা হচ্ছে কি না, তাও ভেবে দেখতে হবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্যসচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com

https://www.jugantor.com/index.php/todays-paper/window/823706