১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ১০:২৭

আসছে ফোরজি মান নিয়ে সংশয়

ফোরজি বা চতুর্থ প্রজন্মের প্রযুক্তিতে প্রবেশ করায় দেশে সার্বিকভাবে মোবাইল টেলিযোগাযোগ সেবার মান উন্নত হবে বলে মনে করছেন টেলিযোগাযোগ খাতের বিশেষজ্ঞরা। তবে যেসব কারণে থ্রিজি সেবায় মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করা যায়নি, সেসব ফোরজির ক্ষেত্রেও সংকটের কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই এ ব্যাপারে প্রথম থেকেই সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চতুর্থ প্রজন্মের প্রযুক্তির কারণে বাড়বে ইন্টারনেটের গতি, বাড়বে স্মার্টফোনভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনের ব্যবহার। কমবে ভয়েস এবং ভিডিও উভয় ক্ষেত্রেই কলড্রপ। তবে উন্নত অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক এবং পর্যাপ্ত ব্যান্ডউইথ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। এ ছাড়া ফোরজির জন্য উপযোগী স্মার্টফোনের সহজলভ্যতাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে বাজারে ফোরজির ব্যবহার উপযোগী স্মার্ট হ্যান্ডসেট রয়েছে মাত্র ১৪ শতাংশ। তারা বলেন, থ্রিজি সেবা চালু হওয়ার পর সেবার মান নিশ্চিত করা দূরে থাক, কলড্রপ বেড়ে যাওয়াসহ সার্বিকভাবে টেলিযোগাযোগের মান নিম্নগামী হয়েছিল। ফোরজির ক্ষেত্রেও একইভাবে চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে।

এদিকে, দুটি বেসরকারি ট্রান্সমিশন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ফোরজির উপযোগী উন্নত নেটওয়ার্ক প্রস্তুত রেখেছে বলে জানিয়েছেন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক সেবাদাতা (এনটিটিএন) দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।

ফোরজি যেসব সুবিধা দেবে :মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটব মহাসচিব টি আই এম নুরুল কবীর সমকালকে বলেন, বিটিআরসি সম্প্রতি মোবাইল অপারেটরদের বেতার তরঙ্গের প্রযুক্তি নিরপেক্ষ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। এর ফলে বেতার তরঙ্গের সীমিত ও এককেন্দ্রিক ব্যবহারের বাধা দূর হয়েছে। তাই শুধু ফোরজি নয়, মোবাইল অপারেটররা এখন থ্রিজিতেও আরও উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে পারবে। বেতার তরঙ্গ প্রযুক্তির নিরপেক্ষ ব্যবহারে, অর্থাৎ একই ব্যান্ডের বেতার তরঙ্গ দিয়ে টুজি, থ্রিজি ও ফোরজি সেবা দেওয়ার ফলে এখন উঁচু ভবন কিংবা বেতার তরঙ্গের পকেট এলাকাগুলোতে নেটওয়ার্ক পৌঁছে দিতে আগের মতো সমস্যায় পড়তে হবে না। গ্রাহকরা নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক পাবেন।

ফোরজি এলে গ্রাহকরা কীভাবে উপকৃত হবেন? এ প্রশ্নের উত্তরে প্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির সমকালকে বলেন, আসলে মোবাইল নেটওয়ার্কে ইন্টারনেটের গতি বাড়ানোই ফোরজির মূল কথা। ইন্টারনেটের গতি বাড়লে মানুষ অনলাইনে কোনো বাধা ছাড়াই হাইডেফিনেশন বা এইচডি মানের ছবি কিংবা ভিডিও দেখতে পাবে। থ্রিজি সেবা, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারে কল করার ক্ষেত্রে আগের মতো কল বিচ্ছিন্ন হওয়ার মাত্রা কমবে। স্মার্টফোনভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনের ব্যবহারও বাড়বে।

বিটিআরসির চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, ফোরজি সেবা চালু দেশের টেলিযোগাযোগ খাত এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য একটি বড় মাইলফলক। বিটিআরসি এখন সেবার গুণগতমান নিশ্চিত করতে অনেক বেশি তৎপর। সেবা মানসম্পন্ন না হলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

ফোরজির সামনে চ্যালেঞ্জ :প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র ফেলো আবু সাঈদ খান সমকালকে বলেন, ফোরজি সেবার সুবিধা দিতে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে উন্নত অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করা। এ জন্য শক্তিশালী অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের কোনো বিকল্প নেই। এই নেটওয়ার্কের দুর্বলতায় আগে থ্রিজিতেও সমস্যা হয়েছে এবং এই বড় সমস্যা এখনও রয়ে গেছে। স্মার্ট, নিরপেক্ষ ও দক্ষ ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক তৈরিতে বাংলাদেশ এখন যথেষ্ট সফল নয়। ফোরজিতে যাতে এ সমস্যা না হয়, সে জন্য এ বিষয়ে এখনই গুরুত্ব দিতে হবে। এ সম্পর্কে প্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, থ্রিজি সেবার মান নিশ্চিত করার সমস্যাগুলো যাতে ফোরজিতেও না থাকে, সে জন্য প্রথমেই প্রয়োজন দ্রুত নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের। যা মোবাইল ফোন অপারেটরদের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন (বিটিএস) বসানো না হলে ফোরজিতেও নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা নিশ্চিত করা যাবে না। অবশ্য ট্রান্সমিশন সেবার বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি এনটিটিএন কোম্পানি ফাইবার অ্যাট হোমের হেড অব কমিউনিকেশন অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স আব্বাস ফারুক সমকালকে বলেন, দুটি বেসরকারি এনটিটিএন কোম্পানি এখন পর্যন্ত ৬০ হাজার কিলোমিটারের বেশি অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। অনেক আগেই ফোরজি সেবা দেওয়ার উপযোগী উন্নত ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক প্রস্তুত রাখা হয়েছে- যেখানে ১০০ জিবিপিএস কিংবা তার বেশি সক্ষমতার কার্ড ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই বেসরকারি এনটিটিএন কোম্পানির সেবা নিলে উন্নত ফোরজি সেবা নিশ্চিত করা যাবে।

একটি মোবাইল ফোন অপারেটরের একজন বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা বলেন, ফোরজি সেবায় ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। কারণ ফোরজি যত বিস্তৃত হবে, যত এর ব্যবহার বাড়বে, ব্যান্ডউইথের চাহিদাও তত বাড়বে। দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল থেকে পর্যাপ্ত ব্যান্ডউইথ পাওয়া গেলে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকত না। কারণ, এখান থেকে ১৫০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিটিসিএলের ট্রান্সমিশন লিংকের দুর্বলতার কারণে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১৪০ জিবিপিএস। এর ফলে এখন পর্যন্ত প্রথম সাবমেরিন কেবল এবং ভারত থেকে ব্যান্ডউইথ আমদানি করা বেসরকারি আন্তর্জাতিক টেরিস্ট্রিয়াল কোম্পানিগুলোর (আইটিসি) ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। ফোরজি সেবায় ব্যান্ডউইথ চাহিদা বাড়লে তা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের অবস্থা, ব্যান্ডউইথের পর্যাপ্ততা এবং মোবাইল নেটওয়ার্কের সমক্ষতা বিবেচনায় দেশে ফোরজির গতি ৭ এমবিপিএসের (মেগাবিট পার সেকেন্ড) বেশি হবে না, যদিও বিশ্বে ফোরজির গড় গতি ১৬ দশমিক ৬ এমবিপিএস। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমারে ফোরজির গতি সবচেয়ে বেশি, ৫০০ এমবিপিএস। আর কম ভারতে, ৬ দশমিক ১৩ এমবিপিএস।

হ্যান্ডসেটের প্রাপ্তিও পর্যাপ্ত নয় :যেহেতু ফোরজি সেবা বিস্তৃত হচ্ছে মোবাইল নেটওয়ার্কে, সে কারণে ফোরজির উপযোগী মোবাইল ফোন হ্যান্ডসেট ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে দেওয়া একটি বড় শর্ত। মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত মোট মোবাইল গ্রাহকের মাত্র ৩০ শতাংশ থ্রিজি সেবার উপযোগী স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। মোবাইল ফোন আমদানিকারকদের সংগঠন বিএমপিআইর তথ্য অনুযায়ী, যত হ্যান্ডসেট বিক্রি হচ্ছে তার মধ্যে থ্রিজি উপযোগী স্মার্টফোন বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৩১ শতাংশ। বর্তমানে দেশের বাজারে যত স্মার্টফোন আছে, তার মধ্যে সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ ফোরজি ব্যবহারের উপযোগী হ্যান্ডসেট। এ পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, এ মুহূর্তে সারাদেশে ফোরজি নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেওয়া হলেও ১৪ শতাংশের বেশি মানুষ ফোরজি ব্যবহারের সুবিধা পাবেন না। আর ফোরজি উপযোগী হ্যান্ডসেটের বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের, যেগুলোর দাম কমপক্ষে ১২ হাজার টাকা। বিএমপিআইর সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া শহীদ সমকালকে বলেন, বর্তমানে ১০ হাজার টাকার নিচে স্থানীয় ব্র্যান্ডেরও হ্যান্ডসেট নেই। যেহেতু দেশে ফোরজি এসে যাচ্ছে। ফলে ১০ হাজার টাকার কম মূল্যে ফোরজি ব্যবহারে সক্ষম হ্যান্ডসেট কম সময়ের মধ্যেই বাজারে নিয়ে আসা হবে।

http://samakal.com/technology/article/1802785