১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ১০:০৩

নীতিমালা প্রণয়নে বাধা গোপন সমঝোতা

বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে বৈধ স্বর্ণ পাওয়ার অনিশ্চয়তা


স্বর্ণ খাতের ওপর সরকারের কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বৈধ পথে আমদানি না হওয়ায় এ খাতে রাজস্ব ক্ষতি প্রায় পৌনে ৯শ’ কোটি টাকা। এ উদ্বেগজনক তথ্য টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদনের। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় নীতিমালা জরুরি। কিন্তু অশুভ চক্রের কারসাজিতে তা সম্ভব হচ্ছে না। টিআইবির প্রতিবেদনে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, স্বর্ণ নীতিমালা প্রণয়নে বড় প্রতিবন্ধকতা গোপন সমঝোতা। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এবং চোরাচালান নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্টদের একাংশ, যারা অবৈধ স্বর্ণের লেনদেন এবং চোরাকারবার থেকে লাভবান হয়, তাদের সঙ্গে বড় জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের একটি প্রভাবশালী অংশ পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে দেশে স্বর্ণ আমদানির নীতিমালা যাতে না হয়, সে বিষয়ে সক্রিয়।
টিআইবির প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে এখন স্বর্ণ আমদানির জন্য নীতিমালা হচ্ছে। এ বিষয়ে এ পর্যন্ত নেয়া কার্যক্রম অবহিত করার জন্য গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রীর কাছে একটি সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়েছে। অর্থমন্ত্রীও চান স্বর্ণ খাতের ওপর সরকারের কিছু নিয়ন্ত্রণ আসুক।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ খাতে বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে কারণ হচ্ছে বৈধ স্বর্ণ পাওয়ার অনিশ্চয়তা। সরকারের দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি খুব ভালো করেই জানেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে বৈধ মজুদ বাড়ানোর যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অথচ উত্তরণের উপায় হিসেবে ‘জাতীয় স্বর্ণ নীতিমালা’ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা ছিল উদাসীন। গোড়ায় গলদ রেখেই অবিবেচনাপ্রসূত জুয়েলারি পণ্য বা স্বর্ণালংকার রফতানি নীতিমালা হয়েছে প্রায় ২২ বছর আগেই। যার মধ্য দিয়ে স্বর্ণালংকার রফতানির অনুমতি দেয়া হয়। যদিও এ নীতিমালায়ও ধরা পড়েছে নানা ধরনের অসঙ্গতি। এ কারণে এখন পর্যন্ত স্বর্ণালংকার বা জুয়েলারি রফতানির তথ্য কোনো সংস্থার কাছে নেই। তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি, নীতিমালার মাধ্যমে রফতানি বাজার উন্মুক্ত করা হলেও উল্টো বিভিন্ন দেশ থেকে বৈধ ও অবৈধভাবে আসা স্বর্ণালংকার দেশের বাজারই দখল করে নিয়েছে। ফলে স্বর্ণ আমদানি নীতিমালা বাদ রেখে রফতানি নীতিমালার উদ্যোগ দায়িত্বহীন ও হাস্যকর পদক্ষেপ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। এ কারণেই দেশে এখন পর্যন্ত স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকার আমদানি, সংগ্রহ, মজুদ, পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও রফতানি সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনা, উন্নয়ন, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি শৃঙ্খলার মধ্যে আনা সম্ভব হয়নি।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বিবেচনায় রফতানি অংশটি নিয়ামক ভূমিকায় রয়েছে। তাই রফতানির স্বপ্ন দেখাটা দোষের নয়, বরং ইতিবাচক। তবে এটি ঠিক, কোনো পণ্য রফতানি করতে হলে দেশকে ওই পণ্যটির উৎপাদন ও পারিপার্শ্বিক সূচকে সক্ষমতা থাকতে হয়। কোনো পণ্য দেশে না থাকলে এর উপকরণ আমদানি করে তা কারিগরি রূপান্তরের মাধ্যমেও পণ্যটির মূল্য সংযোজন ঘটানো যায়। পরে সেটি রফতানি করা যায়। তবে এখানেও অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের একটি বাধ্যবাধকতা থাকে।

জানা গেছে, জুয়েলারি পণ্য ডায়মন্ড বা স্বর্ণালংকার রফতানির সুযোগ দিয়ে প্রণয়ন করা হয় জুয়েলারি রফতানি নীতিমালা ১৯৯৫। এনবিআর সে অনুযায়ী শুল্ক বন্ড সংক্রান্ত স্থায়ী আদেশ জারি করে। বাংলাদেশ ব্যাংক জারি করে এফই সার্কুলার নং-৩০। তবে এসব বিধান দিয়ে জুয়েলারি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ও রফতানি জটিলতা দূর করা যায়নি বলে স্বীকার করে নিয়েছেন রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবির (প্রণোদনা) যুগ্ম পরিচালক আবদুর রউফ। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তিনি বলেন, খাতটির উদ্যোক্তারাই এর জন্য দায়ী। তার দাবি, আশির দশক থেকেই ইপিবি জুয়েলারি শিল্পের রফতানি উন্নয়নে বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আজ এ খাত যতটা বিকাশ লাভ করেছে, তা ইপিবির নীতিসহায়ক ভূমিকার কারণেই হয়েছে। এটি আরও অগ্রগতি হতে পারত। কিন্তু রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বর্ণ আমদানির বিষয়ে এতদিন একমত হতে পারেনি। তিনি দাবি করেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে- কয়েকটি ব্যাংককে স্বর্ণ ও মূল্যবান পাথর আমদানি করে রফতানির জন্য কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব দেয়া। বাংলাদেশ জুয়েলারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, উত্তরাধিকার সূত্রেই দেশে সুনিপুণ অলংকারের বিরাট সুনাম আছে। কিন্তু রফতানিতে যেতে হলে যে ধরনের সক্ষমতা প্রয়োজন, তা নেই। তাছাড়া রফতানি পণ্যে যে ধরনের যত্ন করতে হয়, তার উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

ডিসেম্বরে বাণিজ্য সচিব শুভাশীষ বসুর সভাপতিত্বে স্বর্ণ নীতিমালা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় তিনি উল্লেখ করেন, দেশে স্বর্ণের তৈরি অলংকারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিভিন্ন দেশেও স্বর্ণের তৈরি অলংকারসামগ্রীর প্রচুর চাহিদা থাকায় রফতানিতেও এটি যথেষ্ট সম্ভাবনাময় একটি খাত। যদিও এটি মূলত আমদানিনির্ভর খাত। এ খাতের ব্যবসায়ীরা দেশের অভ্যন্তরে বিদ্যমান বংশানুক্রমিকভাবে প্রাপ্ত স্বর্ণ এবং ব্যক্তিপর্যায়ে আনয়নকৃত স্বর্ণ থেকে স্বর্ণ সংগ্রহ করে থাকেন। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীরা তাদের কাছে মজুদকৃত স্বর্ণের বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেন না। এ কারণে তাদের মজুদকৃত স্বর্ণ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত আমদানি নীতি আদেশ ২০১৮-২১ এবং রফতানি নীতি আদেশ ২০১৮-২১ প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। এসব নীতি আদেশে স্বর্ণ, রুপা, মূল্যবান পাথর এবং ডায়মন্ড আমদানি সহজীকরণ ও রফতানি উন্নয়নের লক্ষ্যে আমদানি ও রফতানি নীতিতে সময়োপযোগী পরিবর্তন, সংযোজন এবং সংশোধনের সুযোগ রয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জাতীয় রফতানি নীতিমালায় অলংকারসামগ্রীর কাঁচামাল আমদানির জন্য সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন ও রফতানির ক্ষেত্রে উৎসাহব্যাঞ্জক পদক্ষেপ নেয়ার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ সম্পর্কিত বিধিমালা প্রণীত হয়নি। রফতানি উৎসাহী করার মতো উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিক্রয় বা বিভিন্ন পর্যায়ে রেয়াত বা ভর্তুকির সুযোগ নেই। সুপারভাইজ বন্ডেড ওয়্যারহাউস পদ্ধতির আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধার আমদানিতেও রয়েছে দুর্নীর্তির ঝুঁকি। তাছাড়া স্বর্ণালংকার রফতানির ক্ষেত্রেও এর অনুমোদন ও প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রতা এবং অযাচিত অর্থ খরচের ঝুঁকি রয়েছে। স্বর্ণ একটি স্পর্শকাতর পণ্য হলেও এর জন্য দেশে বিশেষ কোনো অঞ্চল গড়ে তোলা হয়নি। এছাড়া গুণগত মানোন্নয়ন রফতানি পণ্যের পূর্বশর্ত। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকারের মান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। আন্তর্জাতিকমানের অ্যাক্রিডিটেড টেস্টিং ল্যাবরেটরি স্থাপন এবং হলমার্ক প্রদানের কার্যক্রম সম্প্রসারণ ও সক্ষমতার বিষয়ে উদ্যোক্তাদের সীমাবদ্ধতা প্রকট। এ কারণে স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকারের ক্যারেট ও খাদের মান নির্ধারণ এবং তা যাচাইয়ে দেশে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ল্যাব টেস্ট, ফায়ার টেস্ট ও হলমার্ক টেস্ট ব্যবহারের সুবিধা নেই, যা রফতানির জন্য বড় বাধা।

এদিকে স্বর্ণ রফতানির প্রক্রিয়াতেও নানা ঝক্কি-ঝামেলা রয়েছে। বাজুস সম্পাদক ও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী দিলীপ কুমার আগরওয়াল এ বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, রফতানিতে বন্ড লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়নের ক্ষেত্রে সীমাহীন দীর্ঘসূত্রতায় আটকে থাকতে হচ্ছে। বন্ড ইস্যুতে শুধু একটি ভুল সংশোধন করতেই যে সময় খরচ হচ্ছে, তাতে নতুন আরেকটি বন্ড লাইসেন্স নেয়ার বা নবায়নের সময় চলে আসছে। এতবেশি সময় লাগছে, যে সময়ে আরও একটি বন্ড লাইসেন্স গ্রহণের সময় চলে আসছে। ডিউটি এক্সামশন ও ড্র ব্যাক অফিসেও (ডিইডিও) ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়। এসব করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত এই লাইসেন্স আর কোনো কাজেই আসে না রফতানিকারকের।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব শুভাশীষ বসু যুগান্তরকে বলেন, স্বর্ণের তৈরি অলংকার, মূল্যবান পাথর ও ডায়মন্ড রফতানির প্রক্রিয়ায় যেতে হলে সবার কাছেই এটি এখন স্পষ্ট যে, আগে এর বৈধ আমদানি বাড়াতে হবে এবং এর লক্ষ্যে আমদানি প্রক্রিয়াও সহজ করতে হবে। তিনি বলেন, সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুভব করেছে বলেই সমন্বিত উদ্যোগে এখন কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নের কাজ করছে।
বৈধ মজুদ বাড়ানোর উপায় কী হতে পারে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রাথমিক কৌশল হিসেবে দুইটি তফসিলি ব্যাংকের মাধ্যমে স্বর্ণ আমদানি করে মজুদ বৃদ্ধি এবং সেখান থেকে ব্যবসায়ী পর্যায়ে বিক্রি ও দেশে এর রূপান্তরিত পণ্য স্বর্ণালংকার রফতানির বিষয়টি ভেবে দেখা হচ্ছে। এছাড়া সরকারের একমাত্র বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান টিসিবিকেও এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা যায় কি না, পর্যালোচনা করতে বলা হয়েছে। এ সংক্রান্ত কমিটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শেষ করলেই সবকিছু স্পষ্ট হবে।

বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী যুগান্তরকে বলেন, বৈধ মজুদের অনিশ্চয়তা চিরস্থায়ীভাবে দূর না করা গেলে স্বর্ণালংকারের রফতানি অনেকটা কল্পনা-বিলাসের মধ্যেই থেকে যাবে।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার এ প্রসঙ্গে বলেন, স্বর্ণের উচ্চমূল্যের কারণে বিশ্বব্যাপী স্বর্ণের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। এ বাড়তি চাহিদা অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ ও রফতানি বাজারের সুরক্ষা দিতে নীতিমলা করেছে ভারত। বিশ্বের অনেক দেশেই এ সংক্রান্ত নীতিমালা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে নেই। এ কারণে আমরা বিশ্ববাজারে প্রবেশ করতে পারছি না। নীতিমালা থাকলে ব্যাংক ও সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত এজেন্টের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম দামে স্বর্ণ কেনা যেত। এতে প্রাপ্তির উৎস নিশ্চিত হতো। তাছাড়া সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের নিশ্চয়তা মিলত। এতে স্বর্ণনির্ভর নতুন নতুন ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠত। রফতানির পথও সুগম হতো। আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে পারতাম।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/18413