মূল পদ্মার বুকে এবার সম্পূর্ণ নতুন জেগে ওঠা চর এগুলো। গত রোববার রাজশাহী সদরের ফুলতলা থেকে ছবি তুলেছেন সংগ্রামের ফটোসাংবাদিক সোহরাব হোসেন সৌরভ
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ৯:৫৪

পদ্মায় জাগছে নিত্যনতুন চর

গঙ্গায় ভারতের ফারাক্কা পয়েন্টে পানি প্রবাহ না থাকায় শুকনো মওসুমের শুরুতেই নিত্যনতুন চর জাগছে বাংলাদেশের পদ্মার বুকে। যৌথ নদী কমিশনের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০১৬ সালে ৭৭ হাজার কিউসেক এবং ২০১৭ সালে ৬৪ হাজার কিউসেক পানি কম পেয়েছে। চলতি বছরেও পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) পক্ষ থেকে গঙ্গার পানি প্রাপ্তির বিষয়ে নিয়মিত রিপোর্ট দেয়া হলেও তা খুবই গতানুগতিক। তাদের প্রদত্ত হিসেবে শুধুই অঙ্কের ছক থাকে- কোন বাখ্যা-মন্তব্য থাকে না। জেআরসি’র দেয়া হার্ডিঞ্জ পয়েন্টে প্রাপ্ত পানির হিসেবে দেখা যায়, গত বছর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারির ১-১০ তারিখে পাওয়ার কথা ৪৬,৩২৩ কিউসেক সেখানে প্রাপ্তি ৪২,৫৬৩ কিউসেক। ১১-২০ তারিখে পাওয়ার কথা ৪২,৮৫৯ কিউসেক সেখানে প্রাপ্তি ৩৭,৮১৩ কিউসেক। ২১-২৮ তারিখে পাওয়ার কথা ৩৯,১০৬ কিউসেক সেখানে প্রাপ্তি ৩৪,৬৪৯ কিউসেক। এই তিন কিস্তিতে বাংলাদেশ পানি কম পেয়েছে ১৩,২৪২ কিউসেক। এভাবে পরের মাসেও পানি কম পায়। বছরের হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশ ২০১৬ সালে পানি কম পেয়েছে প্রায় ৭৭ হাজার কিউসেক এবং ২০১৭ সালে কম পেয়েছে ৬৪ হাজার কিউসেক। পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে গত বছর সামান্য বেশি পানি প্রাপ্তি দেখানো হয়। সূত্র জানায়, সেসময় বিহারে বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধির মুখে ফারাক্কার গেটসমূহ উম্মুক্ত করে রাখায় পানি কিছুটা বেশি আসে। কিন্তু এবছর ইতোমধ্যেই যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে তাতে চুক্তি মোতাবেক পানি মিলবে কি-না সে সন্দেহ রয়েছে। চলতি বছরের তথ্য এযাবত জেআরসি থেকে পাওয়া যায়নি।

চলতি শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই পদ্মায় পানি প্রবাহ বিপুল মাত্রায় কমে যাওয়ায় পদ্মা ইতোমধ্যেই মরা নদীর রূপ নিয়েছে। স্রোত না থাকায় লাখ লাখ টন পলি এসে পড়ছে পদ্মার বুকে। বছরে পদ্মায় তিন মাস পানি থাকলেও নয় মাসই পানি থাকে নদীর তলায়। এর ফলে নদীর বেশির ভাগ এলাকা জুড়ে জেগে উঠে চর। পদ্মা শুকিয়ে যাওয়ায় এর সাথে সংযুক্ত ২৫টি নদীও এখন মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে পদ্মার বুক জুড়ে এখন ধুধু বালু চর। হাজার হাজার মাইল জুড়ে জেগে উঠছে এই চর। আগের তুলনায় এবছর নতুন চর সৃষ্টির হার বেশি বলেও জানা গেছে। উৎস ও উজান থেকে ফারাক্কা পয়েন্টে যথেষ্ট পরিমাণ পানি এসে পৌঁছাতে না পারার কারণে স্বাভাবিক প্রবাহ যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশ চুক্তি মোতাবেক পানি থেকে বঞ্চিত থাকছে। বিষয়টি যেন দিনে দিনে গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের কাছে।

এদিকে শুষ্ক মওসুমে যেমন পানির হাহাকার সৃষ্টি হয়, বর্ষা মওসুম আসলে পদ্মায় দেখা দেয় বন্যা ও ভাঙন। নাব্য হারিয়ে নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ার কারণে সামান্য পানিও উপচে পড়ে। এই বিপরীতমুখি অবস্থানের কারণে চরম বিপাকে পড়ে পদ্মাকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকার মানুষদের পাশাপাশি সার্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশ। মৎস্য সম্পদের উৎপাদন হ্রাস পেয়ে চলেছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে, কৃষিতে সেচ বিঘিœত হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে নৌপথ।
পানি ও নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকীর মতে, ফারাক্কা বাঁধের কারণে মরে গেছে পদ্মা নদী। আর পদ্মা শুকিয়ে যাবার সাথে সাথে মরে গেছে রাজশাহীর আরো ২৫টি নদী। শুধু তাই নয়, এর সাথে রাজশাহীর অনেক অজানা নদী হারিয়ে গেছে। হারানো নদীর মধ্যে রয়েছে চীনারকূপ (দামকুড়া নদী), নবগঙ্গা, রাজশাহী শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী বারাহী, সরমঙ্গলা (রাইচাদ নদী), চন্দনাসহ আরো অনেক শাখা নদী। এতে বিলুপ্ত হচ্ছে পানির মাছ। মাটি হারাচ্ছে ঊর্বরতা। হারিয়ে যাচ্ছে নদীর সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পদ। হারাচ্ছে সুশীতল পরিবেশ। যা পরিবেশকে করছে দুষিত। তিনি জানান, উৎস ও উজানে গঙ্গার উপর ভারত অসংখ্য প্রকল্প নির্মাণ করেছে। উজানে অনেকগুলো কৃত্রিম খালের সাহায্যে গঙ্গার পানি অন্যত্র প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। তার কারণেই ফারাক্কা পয়েন্টে পানি পৌঁছাতে পারছে না। এসব প্রকল্প অপসারণ করা ছাড়া গঙ্গা-পদ্মায় স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার অন্য কোন বিকল্প নেই বলেও মাহবুব সিদ্দিকী উল্লেখ করেন।

 

http://www.dailysangram.com/post/319375