১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৪৬

তারল্য সংকটে ধার দেনা করে চলছে ব্যাংকিং খাত

আমানত সংকটে দেশের ব্যাংকিং খাত। প্রতিদিন ধার দেনা করে চলছে ব্যাংকিং কার্যক্রম। আমানত বাড়াতে বাড়ানো হয়েছে সুদ হার। দেয়া হচ্ছে নানা লোভনীয় অফার। সবচেয়ে বেশি সংকটে রয়েছে দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো। ব্যাংকের আমানত সংগ্রহের টার্গেট পূরণ করতে না পারলে চাকরিও ঝুঁকিতে পড়তে পারে এমন আতঙ্ক মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের। সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারলে বাধাগ্রস্ত হবে বিনিয়োগ। নিয়ম না মেনে বিপুল অঙ্কের ঋণ বিতরণে অস্থিরতায় গোটা ব্যাংকিং খাত। আমানতের তুলনায় ঋণ প্রবাহ বেড়েছে ৯ শতাংশ বেশি। ব্যাংকের আমানত সংগ্রহের এমন অবস্থা আগে কখনো দেখা যায়নি।
প্রয়োজনে টাকা দেবে ব্যাংক। আর ব্যাংকেই যদি টাকা না থাকে, তবে গ্রাহক যাবে কোথায়? গ্রাহক বলতে বিশেষত শিল্পোদ্যোক্তারা আর আগের মতো ব্যাংকের ঋণ পাবেন না। কারণ, ব্যাংক নিজেই টাকার পেছনে ছুটছে। তারল্য সংকটের কারণে ব্যক্তির পুঁজির দিকেই আকৃষ্ট হয়ে নানাজনের কাছে ধরনা দিচ্ছে। কর্মকর্তাদের টার্গেট বেঁধে দেয়া হয়েছে। অফার করা হচ্ছে বাড়তি সুদও।

দেখা গেছে, একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে একাধিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা আমানতের আবদার করছেন। তাদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে অতিমাত্রায় ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। নিয়ম না মেনেও কোনো কোনো ব্যাংক বিপুল অঙ্কের ঋণ দিয়েছে- যা গোটা ব্যাংকিং খাতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া এডি রেশিও (ঋণ ও আমানতের অনুপাত) বাস্তবায়ন, কয়েক মাস ধরে আমানতের সুদ হার কমে যাওয়ায় গ্রাহকদের অর্থ তুলে নেয়াসহ কয়েকটি কারণে তারল্য সংকটে পড়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। ঋণ প্রদানে লাগাম টেনে তারা এখন আমানত বাড়াতে ছুটছে গ্রাহকের দ্বারে দ্বারে। বিশেষ করে সরকারি অর্থ আমানত রাখতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অথচ কয়েক মাস আগেও এই পরিস্থিতিটা ছিল ঠিক উল্টো। তখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মনোযোগ ছিল ঋণ প্রদানে প্রতিযোগিতা করা। আমানত সংগ্রহে আগ্রহ ছিল কম। ফলে স্প্রেডসীমা (ঋণ ও আমানতের সুদ হারের ব্যবধান) ৫ শতাংশ থাকার নিয়ম থাকলেও অনেক ব্যাংকেরই এই হার ছিল ৫ শতাংশের নিচে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এডি রেশিও কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়েই কিছুটা তারল্য সংকটে পড়ছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। তাই সবাই আমানত সংগ্রহে মনোযোগ দিচ্ছে। বিশেষ করে সরকারি আমানত সংগ্রহ করাই এখন তাদের মূল লক্ষ্য। তবে শিগগিরই তারল্য বাড়বে বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ঋণের তুলনায় আমানত কিছুটা কমেছে। তাই সরকারি আমানত থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ আমানত সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।
সম্প্রতি এডি রেশিও কমিয়ে সাধারণ ব্যাংকের জন্য সর্বোচ্চ ৮৩ দশমিক ৫০ ও ইসলামী ধারার ৮৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যা জুনের মধ্যেই বাস্তবায়ন করতে হবে।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অর্থবছরের শুরু থেকেই ঋণ প্রবাহ অনেক বেশি মাত্রায় বাড়তে শুরু করেছে। গড়ে প্রতিমাসে ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু আমানত বেড়েছে মাত্র ৯ থেকে ১১ শতাংশ। আমানতের তুলনায় ঋণ প্রবাহ বেড়েছে ৯ শতাংশ বেশি। এসব কারণে তারল্যে টান পড়ছে।
জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আমানত নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ব্যাংকগুলো। আর ব্যাংকগুলোও এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চায়। এই জন্য সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক মেয়াদি আমানতের বিপরীতে ১০ শতাংশ সুদ চায়।

ইতিমধ্যে সোনালী ব্যাংক থেকে আমানত নেয়ার জন্য বেসরকারি খাতের ইস্টার্ন, ব্র্যাক, দ্য সিটি, সাউথইস্ট, ঢাকা ব্যাংকসহ প্রথম সারির ব্যাংকগুলো দৌড়ঝাঁপ করছে।
বুধবার পর্যন্ত বেসরকারি ব্যাংকগুলো শুধু সোনালী ব্যাংক থেকেই প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা মেয়াদি আমানত ধার নিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সব ব্যাংক মিলিয়ে ধার দেয়া মেয়াদি আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। আমানতের সুদ হার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ হারও বাড়িছে। অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংকের ঋণের সুদ হার এখন গড়ে ১৩ শতাংশ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ৩ বছর ধরে ধাপে ধাপে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ হার কমিয়েছে। কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংক আমানতের সুদ হার ২ শতাংশে নেমে এসেছিল। এখন আবার আমানতের সুদ হার বেড়ে যাওয়ায় আমানতকারীরা ব্যাংকমুখী হবে।
সাধারণত দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের ৭৫ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে জমা রাখতে হয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে। বাকি ২৫ শতাংশ আমানত বেসরকারি ব্যাংকে রাখা হয়। কিন্তু অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়মের তোয়াক্কা না করে বেসরকারি ব্যাংকে বেশি আমানত রেখেছিল। নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আমানত রেখে বিপদে পড়েছে। তারল্য সংকটে সম্প্রতি জলবায়ু তহবিলের টাকা ফেরত দিতে পারেনি ব্যাংকটি। এমতাবস্থায় বেসরকারি ব্যাংকে সরকারি আমানত বাড়াবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের মাঝে।

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, দেশের অর্থনীতির ৭০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ সরকারি আমানতের মাত্র ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকগুলোতো রাখা হচ্ছে। এই হারকে ৫০ শতাংশ করা দরকার। অথচ উল্টো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ তুলে নিচ্ছে।
তিনি বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারি আমানতের অন্তত অর্ধেক অর্থ পাওয়া গেলে বর্তমান সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। এ বিষয়ে সরকারের সাথে আলোচনা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংককেও অনুরোধ করা হয়েছে।
এর আগে ২০১০ সালে ব্যাংকগুলোয় আমানত সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছিল। ওই সময় ব্যাংকগুলো চড়া সুদে আমানত নেয়ার পাশাপাশি দেড় শতাংশ সুদে কলমানিতেও ধার করেছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছর আমানতের তুলনায় দেড়গুণের বেশি ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো যা নগদ টাকার সংকট বাড়িয়েছে। এ সময়ে ৭২ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়।
সূত্রমতে, সর্বশেষ মুদ্রানীতি অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারি খাতে ঋণের লাগাম টেনে ধরে। ফলে, ব্যাংকগুলো বাধ্যবাধকতার কারণেই ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনছে। আবার অনেক ব্যাংকই পর্যাপ্ত আমানত সংকটে ঋণের জোগান দিতে পারছে না। ওসব ব্যাংক বেশি হারে আমানত সংগ্রহে বেরিয়েছে। আমানত বাড়াতে না পারলে ঋণ দিতে পারবে না, যা ব্যাংকের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আমানত বাড়ালে ঋণ ও অগ্রিমের অনুপাত অনুসারে পরিমাণও বাড়বে।

সাম্প্রতিককালে গ্যাস বিদ্যুৎসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে বিনিয়োগে মন্দা যাচ্ছিল। এরমধ্যে ব্যাংকগুলো মেয়াদি ঋণের বিপরীতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ, বৈদেশিক মুদ্রার কারবার ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফা করার কৌশল রপ্ত করেছে।
সম্প্রতি কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় এসব ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম ফারমার্স ব্যাংক। এটি আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না। সরকারের করের টাকাও ঠিকমতো পরিশোধ করতে সক্ষম না হওয়ায় উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি থাকে, তাই আমানতকারীদের ভয়ের কারণ নেই। বিষয়টি নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলেও আলোচনা চলছে।
এদিকে, শিল্পোদ্যোক্তারা উদ্বেগে রয়েছেন। তাদের মতে, বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা শিল্পের জন্য অনুকূল নয়। যেখানে ব্যাংকগুলোই অর্থ সংকটে রয়েছে সেখানে শিল্পবিকাশে তারা ঋণ জোগাবে কীভাবে? তদুপরি, মুদ্রানীতিতে ঋণের লাগাম টেনে ধরায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে। আবার সুদের হার বেড়ে যাওয়ায়ও বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। বহু চেষ্টার পর সুদের হার সিঙ্গল ডিজিটে এসেছিল।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহীউদ্দিন বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণে সুদের হার নমনীয় হারে রাখা আবশ্যক। তা না হলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। সুদের হারে যে পরিমানে বাড়ছে তাতে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা করা খুবই কঠিন হবে।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের সুদ হার ১৩ শতাংশে রয়েছে। এর সাথে অনেক হিডেন চার্জ রয়েছে। এতে করে সুদের হার ১৭ থেকে ১৮ শতাংশে পড়ে যায়। এত টাকা সুদ নিয়ে ব্যবসায়ীরা কোনভাবেই লাভ করতে পারবে না। বহু আন্দোলনে সুদ সিঙ্গেল ডিজিল আনা হয়েছিল। কিন্তু তা স্থায়ী হলো না।
ব্যাংকে সুদের হার কম থাকলে আমানতকারীদের অনেকেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন- এমনটি আশা করা হয়। কিন্তু আমানতের সুদের হার বেড়ে গেলে বিনিয়োগ ঝুঁকি না নিয়ে ব্যাংকেই টাকা জমা রাখতে আগ্রহী হবেন আমানতকারীরা যা বাজারের জন্য নেতিবাচক।

অন্যদিকে, ঘোষিত মুদ্রানীতিও শেয়ারবাজারের জন্য ইতিবাচক নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তার মতে, ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। এ অবস্থায় ঘোষিত মুদ্রানীতির লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয় বরং সুদের হার যেমন বাড়বে তেমনি বাড়বে মূল্যস্ফীতিও। তিনি বলেন, ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে একই হারে আমানতের প্রবৃদ্ধিও ঘটাতে হবে। তা কিন্তু হচ্ছে না। শেয়ারবাজারের জন্যও নতুন মুদ্রানীতিতে কোনো সুখবর নেই। কারণ, নতুন নীতি অনুযায়ী এক্সচেঞ্জ রেট বাড়বে যা শেয়ারবাজারের জন্য ভালো নয়।

http://www.dailysangram.com/post/319264