১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১২:১৩

বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন

ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি হোতাদের শাস্তি কবে

ফারমার্স ব্যাংকে দুদকের টিম * মখা আলমগীর ও বাবুল চিশতিসহ সংশ্লিষ্টদের * জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হচ্ছে * মখা আলমগীরের শেয়ার বাজেয়াপ্তের দাবি, আগে শাস্তি পরে মূলধন

দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত ফারমার্স ব্যাংককে উদ্ধারে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা মূলধন জোগানের উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করেছেন ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, মহীউদ্দীন খান আলমগীরসহ যাদের কারণে ব্যাংকটি অর্থশূন্য হল, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে নতুন করে অর্থ জোগান দেয়া ঠিক হবে না। কেউ কেউ বলছেন, ফারমার্স ব্যাংকে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের যে শেয়ার আছে, তা আগে বাজেয়াপ্ত করা হোক। তা না হলে নতুন করে অর্থ দিলে তাও খেয়ে ফেলার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। বুধবার এ বিষয়ে যুগান্তরের পক্ষ থেকে জানতে চাইলে বিশিষ্ট ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এ অভিমত ব্যক্ত করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের মতো একটি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংককে মূলধন দেয়া ঠিক হবে না। হয়তোবা সরকারের চাপে ব্যাংকগুলো রাজি হয়েছে। তা-ও ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার হওয়ার শর্তে। কিন্তু তারা বোর্ডে গিয়ে কী করবে, যদি মহীউদ্দীন খান আলমগীর থাকে (?) সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব ক্ষমতাবলে তার সব শেয়ার বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। এই ব্যাংক থেকে তাকে পুরোপুরিভাবে সরাতে হবে। তা না হলে টাকা দিয়ে কোনো লাভ হবে না

সুশাসনের জন্য নাগারিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের অর্থ লুটপাটকারীদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত না করা পর্যন্ত কিছুতে কোনো অর্থ দেয়া ঠিক হবে না।
এদিকে ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীরসহ সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) টিম বুধবার ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে যায়। দুদকের উপপরিচালক সামসুল আলম ও উপসহকারী পরিচালক জয়নুল আবেদীন বিকালে ব্যাংকটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. এহসান খসরুর সঙ্গে দীর্ঘ সময় বৈঠক করেন। এ সময় তারা ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়ম সংক্রান্ত বেশ কিছু কাগজপত্র এমডির কাছে চান। এহসান খসরু দুদকের টিমকে আশ্বস্ত করেছেন, দুদক অনুসন্ধানের স্বার্থে যা চাইবে, সরবরাহ করা হবে। তথ্য সরবরাহের জন্য ব্যাংক থেকে দু’জন কর্মকর্তাকেও বিশেষভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
দুদকের সূত্রটি জানায়, ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় মঙ্গলবার শুরু হয়েছে অনুসন্ধান কাজ। অনুসন্ধানের প্রথম দিনেই ব্যাংকটির অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দুদক। কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র হাতে আসার পর মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও বাবুল চিশতীসহ সংশ্লিষ্টদের দুদকে তলব করে নোটিশ জারি করা হবে। অনুসন্ধান পর্যায়ে তাদের বক্তব্য নেয়ার জন্যই মূলত তলব করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

প্রসঙ্গত, ঋণ বিতরণে অনিয়ম, জালিয়াতি ও অবৈধ সুবিধা নেয়াসহ ব্যাংকের নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা অডিট প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন আমলে নিয়ে দুদক এই অনুসন্ধান কাজ শুরু করেছে।
এদিকে আর্থিকভাবে দেউলিয়া হওয়া ফারমার্স ব্যাংককে উদ্ধারে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা মূলধন জোগানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকও হয়েছে। তবে ওই বৈঠকে ফারমার্স ব্যাংকে অর্থ দেয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো শর্ত দিয়েছে, টাকা দিতে হলে তাদের শেয়ারহোল্ডার হিসেবে পরিচালনা পর্ষদে নিতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আজ যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের অর্থ দুর্নীতিগ্রস্ত ফারমার্স ব্যাংকে দিচ্ছে, জনগণের এসব অর্থ ঝুঁকির মধ্যে পড়ার যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। যদি তা-ই হয়, ভবিষ্যতে এসব ব্যাংকের বোর্ডে যারা আছেন, তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, যারা ব্যাংকটি দেউলিয়া করেছে, তারা উন্মুক্তভাবে চলাফেরা করছেন। তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অথচ ব্যাংকটিকে নতুন করে টাকা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীরসহ যাদের প্রভাবে ব্যাংকটির এমন করুণ পরিণতি হয়েছে, তাদের প্রভাবমুক্ত না করে অর্থ জোগান দেয়া ঠিক হবে না। তিনি প্রশ্ন করেন, নতুনভাবে জোগান দেয়া অর্থ যে খাবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে। এছাড়া যেসব সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছা-অনিচ্ছায় ব্যাংকটিকে টাকা দিতে রাজি হয়েছে, তাদের অবস্থাও তো ভালো না। তাদের দ্বারা পরিচালিত ব্যাংকগুলো বিপদগ্রস্ত। প্রতিবছর জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে তাদের মূলধন জোগান দিচ্ছে সরকার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, মহীউদ্দীন খান আলমগীর এখনও কীভাবে সাফাই গাইছেন, তা আমার বোধগম্য নয়। তিনি যে ব্যাংক চালাতে ব্যর্থ হয়েছেন, এটা তো প্রমাণিত সত্য।

সিনিয়র ব্যাংকার শফিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, তিন বছরের মাথায় যারা ব্যাংকটির এমন পরিস্থিতি করেছেন, তাদের বিচারের আওতায় না এনে ব্যাংকটিকে মূলধন জোগান দেয়া হচ্ছে। আবার সে মূলধনের অংশ পাবেন মখা আলমগীর নিজেই, যেহেতু তিনি ব্যাংকটির শেয়ারহোল্ডার। এসব বিষয় গভীরভাবে ভাবতে হবে।
সূত্র জানায়, ফারমার্স ব্যাংকে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের শেয়ার রয়েছে ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ব্যাংকটির ৪০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের বিপরীতে, যা ২৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। আর মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী) কিনতে চেয়েছিলেন ৫০ লাখ শেয়ার, যার মূল্যমান দাঁড়ায় ৫ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, সরকারের সিদ্ধান্তে সোনালী, অগ্রণীসহ তিনটি ব্যাংক এবং ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিচ্ছে ব্যাংকটিকে। এর মধ্যে আইসিবি একাই জোগান দেবে ৪৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত তিনটি ব্যাংক ও ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মূলধন হিসেবে জোগান দেবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/17700