১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৯:৩০

দশম দিনেও প্রশ্ন ফাঁস, বাসভর্তি শিক্ষার্থী আটক

দুই বোন ও শিক্ষিকাসহ গ্রেফতার ২১ বাবা আসামি, বহিষ্কার ৫৮ শিক্ষার্থী * লাফিয়ে পড়ে ছাত্রীর আত্মহত্যার চেষ্টা

চলতি এসএসসি পরীক্ষার দশম দিন মঙ্গলবারও প্রশ্নপত্র ফাঁস হল। বিজ্ঞান বিভাগে পদার্থ, মানবিকে বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা এবং বিজনেস স্টাডিজে ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিষয়ের পরীক্ষা ছিল। এর মধ্যে বিজ্ঞান ও বিজনেস স্টাডিজ বিভাগের প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ জোরালো। ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ৫৮ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৮ ছাত্রছাত্রী, শিক্ষিকাসহ ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ নিয়ে গত কয়েক দিনে ৮১ জনকে গ্রেফতার করা হল।

ফাঁস হওয়া প্রশ্ন মোবাইলে দেখার সময় চট্টগ্রামে বাসভর্তি শিক্ষার্থী আটক করা হয়। চট্টগ্রামের পুলিশ লায়েন্স ইন্সটিটিউট কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে দুই মেয়েকে মোবাইলে প্রশ্নোত্তর দেখিয়ে মামলায় আসামি হয়েছেন তার বাবাও। পরে ওই দুই বোনকে বহিষ্কার এবং গ্রেফতার করা হলেও তাদের বাবা পালিয়েছেন। দুই বোন বাওয়া স্কুলের শিক্ষার্থী। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে কেন্দ্রের বাইরে প্রশ্নসহ ধরা পড়া চার শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মির্জাপুরে জাকির হোসেন নামে একজনকে ধরে সংক্ষিপ্ত বিচারে চার মাসের দণ্ড দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে। সাভারে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উত্তর হাতে লিখে হলে বসে খাতায় লেখার সময়ে এক ছাত্রীকে বহিষ্কার করা হয়। পরে ওই ছাত্রী কেন্দ্রের দোতলা থেকে লফিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়।

এ নিয়ে এবারের পরীক্ষার দশ দিনের মধ্যে নয় দিনই প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটল। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন ঘটনা নজিরবিহীন। প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরিয়ে দিলে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা, কোচিং সেন্টার বন্ধ, পরীক্ষার্থীদের আধা ঘণ্টা আগে বাধ্যতামূলক হলে প্রবেশ এবং কেন্দ্রে মোবাইল ফোন না নেয়া, ইন্টারনেটের গতি কমানো- এত সব পদক্ষেপের কোনোটাই কাজে আসছে না। শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারকে প্রশ্ন ফাঁস রোধে শুধু ট্রেজারির দিকে নজর দিলেই হবে না। আরও পেছনে তাকাতে হবে। কেননা, যদি ছাপানো দুই সেট প্রশ্নই পরীক্ষার বহু আগে বা আগের রাতে ফাঁস হয়ে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে ধরে নিতে হবে ট্রেজারি থেকে বেরোনোর আগেই প্রশ্ন দুষ্কৃতকারীদের হাতে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের কোথাও সাড়ে ৭টার আগে ট্রেজারি থেকে প্রশ্নপত্র বের করা হয় না বলে জানান একটি শিক্ষা বোর্ডের সাবেক এক চেয়ারম্যান।
প্রসঙ্গত, ১ ফেব্রুয়ারি এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়। এখন পর্যন্ত ১০ দিন পরীক্ষা হয়। এর মধ্যে ১২ ফেব্রুয়ারির ক্যারিয়ার শিক্ষা বাদে সব প্রশ্নই ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুষ্কৃতকারীরা প্রশ্ন ফাঁস করে থাকে। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন লেনদেন ও দেখার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে এ পর্যন্ত ৮১ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হলেও মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
প্রশ্নসহ বাসভর্তি পরীক্ষার্থী আটক : চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগেই শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোনে পাওয়া গেল প্রশ্নপত্র ও উত্তর। এ ঘটনায় ৩৪ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে ১৮ জনকে। শিক্ষার্থীদের সহযোগিতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে এক শিক্ষিকাকে। এদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে প্রশ্ন-উত্তরসহ ১০টি মোবাইল ফোন। মঙ্গলবার সকালে নগরীর মহিলা সমিতি উচ্চ বিদ্যালয় (বাওয়া), চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনস স্কুল ও ফটিকছড়ির হেঁয়াকো বনানী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে থেকে এদের আটক করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে বাসের শিক্ষার্থীদের পুলিশ পাহারায় পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হলেও পরে বহিষ্কার করা হয়। পরীক্ষা শেষে ১৮ শিক্ষার্থী ও এক শিক্ষিকাকে গ্রেফতার করা হয়। হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার ও মেসেঞ্জারের মাধ্যমে এ প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে।

গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে নগরীর বাওয়া স্কুল পরীক্ষা কেন্দ্রের ৯ জন, দামপাড়া পুলিশ লাইন কেন্দ্রের ২ জন ও ফটিকছড়ি উপজেলার হেঁয়াকো বনানী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের ৭ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদেরকে নিজ নিজ কেন্দ্রের সামনে থেকে আটক করে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোরাদ আলী যুগান্তরকে বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে খেয়াল করছি সকালের দিকে ওয়াসা মোড়ে বেশকিছু শিক্ষার্থী জটলা করে কী যেন দেখে। এ রহস্যের জট খুলতে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ওয়াসা মোড়ে আমি উপস্থিত হই। ৮টা ৪৫ মিনিটে ওয়াসা মোড়ে শিক্ষার্থীদের বহনকারী শ্যামলী পরিবহনের একটি বাস এসে দাঁড়ায়। বাসে পরীক্ষার্থীদের অপেক্ষা করতে দেখে সন্দেহ হয়। বাসে উঠে দেখতে পাই, শিক্ষার্থীরা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে কোনো কিছু পড়ছে। পরে তাদের তল্লাশি করে ৭টি মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। এগুলোয় পদার্থবিজ্ঞানের এমসিকিউ প্রশ্ন ছিল। ছিল প্রশ্নের উত্তরও। পরে শিক্ষার্থীদের কাছে পাওয়া প্রশ্নের সঙ্গে মূল প্রশ্নের মিল পাওয়া যায়।’

তিনি জানান, ওই বাসে পটিয়া আইডিয়াল স্কুলের ৫৬ জন পরীক্ষার্থী ছিল। বাংলাদেশ মহিলা সমিতি (বাওয়া) উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য তারা ওয়াসার মোড়ে বাসের ভেতরে অপেক্ষা করছিল। পরে তাদের পুলিশ পাহারায় পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর যাচাই-বাছাই শেষে কোহিনুর আক্তার নামে এক শিক্ষিকাসহ ৯ শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। এরা পটিয়া আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ শাখার শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় বাওয়া স্কুলের কেন্দ্র সচিব বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শওকত আলম যুগান্তরকে জানান, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে তিনটি কেন্দ্রের ৩৪ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্রের সচিব বাদী হয়ে তথ্যপ্রযুক্তি এবং ১৯৮০ সালের পাবলিক পরীক্ষা আইনে মামলা করেছেন।
আত্মহত্যার চেষ্টা : সাভার থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, হাতে লিখে আনা উত্তর দেখে পরীক্ষার খাতায় লেখার সময় ধরা পড়ার পর এক ছাত্রী কেন্দ্রের দোতলা ভবনের বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে সাভারের ঐতিহ্যবাহী অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে। ওই ছাত্রী সাভার ব্যাংক কলোনি এলাকার ইয়াজুল ইসলামের মেয়ে।
ছাত্রীর মা বিউটি বেগম জানিয়েছেন, বহিষ্কার করায় সে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। দুই পায়ের কয়েকটি হাড় ভেঙে গেছে। তাকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা জানায়, পদার্থবিজ্ঞানের ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উত্তর লিখে নিয়ে হলে গিয়েছিল। লেখার সময় সে ধরা পড়ে যায়।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page