১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৯:২৬

পদার্থবিজ্ঞান প্রশ্নপত্র ফাঁস

ছাত্র-শিক্ষকসহ গ্রেফতার ২১

মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষার আগ মুহূর্তে প্রশ্নপত্র ফাঁস করার অভিযোগে গতকাল দেশের বিভিন্ন কেন্দ্র ও তার আশপাশ এলাকা থেকে ছাত্র-শিক্ষকসহ অন্তত ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ দিকে, কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে কোটালিপাড়ায় ১০ শিক্ষককে আজীবনের জন্য অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামে এসএসসির পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষার আগে এক স্কুলের পরীক্ষার্থীদের মোবাইল ফোনে পাওয়া গেছে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন, যা পরীক্ষার আসল প্রশ্নের সাথে মিলেও গেছে। গতকাল মঙ্গলবার নগরীর বাওয়া স্কুলের পরীক্ষা কেন্দ্রের অদূরে পরীক্ষার আগে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসে অভিযান চালিয়ে ওই প্রশ্নপত্র পাওয়া যায় বলে জানান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মোরাদ আলী। ওই বাসে পটিয়া আইডিয়াল হাইস্কুলের ৫০ জন পরীক্ষার্থী ছিল। পরীক্ষা শেষে একজন শিক্ষকসহ ৯ জনকে আটক করে প্রশাসন। পরীক্ষা থেকে বহিষ্কার করা হয় ২৪ জনকে।

ম্যাজিস্ট্্েরট সৈয়দ মোরাদ আলী জানান, ‘বাওয়া স্কুল কেন্দ্রের পাশে বাসে বসে বেশ কয়েক দিন ধরে পরীক্ষা শুরু হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে থেকে কিছু পরীক্ষার্থী জটলা বেঁধে মুঠোফোনে কী যেন দেখে। বিষয়টি আমার নজরে আসে। এর প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিষয়টি আমি নজরদারিতে রাখি।
তিনি আরো বলেন, সকাল ৯টার দিকে শ্যামলী পরিবহনের একটি বাস নগরীর জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদের পাশে এসে থামে। ওই বাস বাওয়া স্কুল কেন্দ্রে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য পটিয়া আইডিয়াল স্কুলের ৫৬ জন পরীক্ষার্থীকে নিয়ে আসে। সাথে ছিলেন ওই স্কুলের এক শিক্ষিকাও। বাস থামার পরপরই বাসের ভেতরেই ৬-৭ জন করে জটলা বেঁধে মুঠোফোনে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে আসা পদার্থবিজ্ঞানের খ সেটের প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র দেখছিল। সাথে সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ওই বাসে অভিযান চালিয়ে আটটি স্মার্টফোন উদ্ধার করি।
তিনি বলেন, এ ঘটনার পর ওই বাসে থাকা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দিতে দেয়া হয়। পরে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিব শওকত আলমের নেতৃত্বে একটি দল কেন্দ্র পরিদর্শনে আসেন। যে আটজনের মোবাইলে প্রশ্নপত্র যাওয়া গেছে তাদেরকে ও ওই বাসে থাকা শিক্ষককে আটক করা হয়েছে। বাসে অবস্থান করা ২৪ জনের পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা ছিল, তাদের সবাইকে পরীক্ষা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের হাতে পাওয়া ফোনেই পদার্থবিজ্ঞানের এমসিকিউ প্রশ্ন ছিল। সেসব প্রশ্ন মিলে গেছে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো: হাবিবুর রহমান বলেন, মুঠোফোনে প্রশ্নের সফট কপি পাওয়া গিয়েছিল শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। সেগুলো তারা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পেয়েছে বলে আমাদের জানিয়েছে। প্রাথমিকভাবে আমরা নিশ্চিত হয়েছি শিক্ষার্থীরা সরাসরি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত না। কারও কাছ থেকে প্রশ্নপত্র পেয়ে তারা নিজেদের মধ্যে শেয়ার করেছে।
এ ছাড়া পুলিশ লাইন স্কুল থেকে একই অপরাধে ২ ছাত্রীকে আটক করা হয়েছে।
কুমিল্লা সংবাদদাতা জানান, কুমিল্লার মুরাদনগরে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার অভিযোগে খাইরুল ইসলাম নামে প্রশ্নফাঁস সিন্ডিকেটের এক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মঙ্গলবার পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা শুরু হওয়ার আধা ঘণ্টা আগে দু’টি স্যামসাং স্মার্ট মোবাইলের মধ্যে থাকা পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তরপত্রসহ তাকে আটক করা হয়। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাকে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত খাইরুল ইসলাম (২১) উপজেলার কামাল্লা ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের তরিকুল ইসলামের ছেলে। সে কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট হতে সিভিলে ডিপ্লোমা পাস করেছে।
চিরিরবন্দর (দিনাজপুর) সংবাদদাতা জানান, চিরিরবন্দরে গত ১০ ফেব্রুয়ারি গণিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মোবাইল মেসেঞ্জারের মাধ্যমে ফাঁস করার অভিযোগে ৪ জনকে ২ দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে রাখার আদেশ দিয়েছেন বিজ্ঞ আদালত।
জামালপুর ও সরিষাবাড়ী সংবাদদাতা জানান, জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায় এসএসসি পরীক্ষার পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় শেরপুর জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের সহকারী ইন্সট্রাক্টর ফারুক আহমেদসহ ছয় এসএসসি পরীক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টায় সরিষাবাড়ী রিয়াজ উদ্দিন তালুকদার উচ্চবিদ্যালয় এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রের পাশে এক বাসা থেকে প্রশ্নপত্র সমাধান করাকালে তাদের আটক করা হয়।

আটককৃতরা হলেন- শেরপুর জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের সহকারী ইন্সট্রাক্টর স্থানীয় বলারদিয়ার গ্রামের বাসিন্দা চিলড্রেন্স হোম পাবলিক স্কুলের শিক্ষক ফারুক আহমেদ, এসএসসি পরীক্ষার্থী মেহেনাজ তাবাসসুম, পরীক্ষার্থী পরাগ ফারদিনা, পরীক্ষার্থী রুমানা আক্তার রিয়া ও পরীক্ষার্থী মারজিয়া মুনতাহা ও পরীক্ষার্থী জাহিদ হাসান। আটককৃত সবাই জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার চিলড্রেন্স হোম পাবলিক উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং তাদের এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র হচ্ছে সরিষাবাড়ী রিয়াজ উদ্দিন তালুকদার উচ্চবিদ্যালয়।
কোটালীপাড়া (গোপালগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্ব অবহেলার দায়ে ১০ শিক্ষককে বহিষ্কার করা হয়েছে। মঙ্গলবার উপজেলার বলুহার ইসলামিয়া মাদরাসা কেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার জিলাল হোসেন ওই ১০ শিক্ষককে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেন। বহিষ্কৃত শিক্ষকরা হলেন, প্রশান্ত বাড়ৈ, মনিরা বেগম, মনির হাওলাদার, কবিতা কীর্ত্তনীয়া, অশোক জয়ধর, শামিম আহমেদ, মহসিন তালুকদার, লায়েকুজ্জামান, নিয়াজ মকদুম ও জয়প্রকাশ বিশ্বাস।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষকদের দায়িত্ব অবহেলার বিষয়টি দেখতে পান। পরে তিনি ওই ১০ শিক্ষককে পরীক্ষার দায়িত্ব থেকে বহিষ্কার করেন। ওই শিক্ষকেরা আর কোনো দিনই পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। তাৎক্ষণিকভাবে বাইরে থেকে শিক্ষক এনে পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয় বলে জানান কেন্দ্রসচিব।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংবাদদাতা জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রে অ্যান্ড্রয়েড ফোন রাখা ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায়ে দীপ কুমার দাস নামে এক পরীক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ।
মঙ্গলবার সকালে উপজেলার অরুয়াইল বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের একটি পরীক্ষার হল থেকে তাকে আটক করা হলেও দুপুরে বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করা হয়। আটককৃত পরীক্ষার্থী উপজেলার অরুয়াইল ডাক পাড়া এলাকার দিলিপ কুমার দাসের ছেলে ও অরুয়াইল বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র।
নীলফামারী সংবাদদাতা জানান, নীলফামারীর সৈয়দপুরের ক্যান্ট. বোর্ড উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে থেকে জায়েদ আলী নামে এক এসএসসি পরীক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বজলুর রশিদ ওই পরীক্ষার্থীকে মোবাইল ফোনসহ গ্রেফতার করে। লক্ষণপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরীক্ষার্থী জায়েদ আলীকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করার সময় হাতেনাতে আটক করেন ওই কর্মকর্তা। পরে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সাথে তার মোবাইল মেসেজে থাকা প্রশ্নের মিল পাওয়ায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে থানা পুলিশে সোপর্দ করা হয়। আটক জায়েদ আলী বাঙ্গালীপুর ইউনিয়নের চৌমুহনী বাজারের গাজীউর রহমানের ছেলে।

সৈয়দপুর (নীলফামারী) সংবাদদাতা জানান, নীলফামারীর সৈয়দপুরে গতকাল সকালে পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশের সময় মোবাইলে প্রশ্নপত্রসহ একজন শিক্ষার্থীকে আটক করে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে একজন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এসএসসি পরীক্ষার সৈয়দপুর ক্যান্ট. বোর্ড হাইস্কুল পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশের সময় জায়েদ আলী নামে এক পরীক্ষার্থীর দেহ তল্লাশি করে মোবাইলে প্রশ্নপত্রসহ আটক করেন সৈয়দপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) পরিমল কুমার সরকার। সে লক্ষণপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র এবং বাঙ্গালিপুর ইউনিয়নের চৌমহনী বাজারের গাজিউর রহমানের ছেলে।

অপর দিকে একই কেন্দ্রে অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে নয়ন চন্দ্র দেবনাথ নামে এক পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সে বোতলাগাড়ি দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র।
মোহনগঞ্জ (নেত্রকোনা) সংবাদদাতা জানান, গতকাল সকালে মোহনগঞ্জ আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে মোবাইলে পদার্থবিজ্ঞান প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র পাওয়ার কারণে ওই কেন্দ্রের এক মেয়ে শিক্ষার্থী অর্পিতা রানী দাসকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা পরিসংখ্যান অফিসার ফরহাদ হোসেন তাকে আটক করে থানায় পাঠান। শিক্ষার্থীটির বিরুদ্ধে মামলার প্রক্রিয়া চলছে। শিক্ষার্থীটি মোহনগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্রী। তার বাবার নাম অজিত কুমার দাস। কেন্দ্রসচিব কাজী রফিকুর রহমান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/293721