১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৯:০৯

চিকিৎসাসেবার নামে কী হচ্ছে

জাহাঙ্গীর আলম আনসারী

একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে চিকিৎসা অন্যতম। একটু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যই মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। এ জন্য মানুষ ডাক্তার ও হাসপাতালের শরণাপন্ন হয়। কিন্তু আমাদের দেশের বেশির ভাগ ক্লিনিক-হাসপাতালগুলো আজ সাধারণ মানুষের জন্য কসাইখানা ও মারণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। আর ডাক্তারদের মধ্যে বড় একটি অংশ আজ মানবসেবা ও মানবিকতা ভুলে গিয়ে কসাই ও ডাকাতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এ ছাড়া চিকিৎসা বিষয়ে পড়াশোনা না করেও অনেকে ডাক্তার সেজে চেম্বার দিয়ে বসে আছেন। মানুষ সুস্থতার জন্য চিকিৎসা নিতে গিয়ে ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসায় আরো মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে।
সারা দেশে রাস্তার আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব ক্লিনিক ও হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসাসেবার নামে চলছে বাণিজ্য। বর্তমানে আমাদের দেশের বেশির ভাগ হাসপাতাল-ক্লিনিকের মালিক ও ডাক্তাররা সঠিক চিকিৎসা দেয়ার পরিবর্তে অর্থ উপার্জনকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে তিনটি সমস্যা জটিল আকার ধারণ করছে। এক. ডাক্তার বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ও ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু, দুই. সঠিকভাবে পরীক্ষা-নীরিক্ষা ছাড়াই জীবতকে মৃত ঘোষণা, তিন. আইসিইউ ও সিসিইউতে লাইফসাপোর্টের নামে রোগীকে আটকে রেখে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়।

দেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে নৈরাজ্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। অস্ত্রোপচারের পর পেটের ভেতর ছুরি বা গজ রেখেই সেলাই দেয়া, অসুস্থ অঙ্গের পরিবর্তে সুস্থ অঙ্গ কেটে ফেলা, দাঁত তোলার নামে শিক্ষানবিস ডাক্তারেরা হাত পাকাচ্ছেন আবার অনেক হাসপাতালে ডাক্তারের পরিবর্তে ওয়ার্ড বয়রাই আবার সর্বেসর্বা। জটিল কঠিন অপারেশন করতেও দ্বিধা করছেন না তারা। আবার সুযোগসুবিধাহীন সরকারি হাসপাতালে একশ্রেণীর ডাক্তার, নার্স, আয়া-কর্মচারীর চরম দুর্ব্যবহারের সামনে রোগীরা থাকছেন বড়ই অসহায়। আর মানবসেবার নাম করে গড়ে ওঠা প্রাইভেট হাসপাতালগুলোরও একই অবস্থা।
প্রতিদিন সংবাদপত্র খুললেই দেখা যায় দেশের কোথাও না কোথাও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা ডাক্তারের অবহেলায় ও ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা যাওয়ার খবর। সিজার করতে গিয়ে নবজাতকের নাড়িভুঁড়ি বা অঙ্গ কেটে ফেলার খবর। মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ বা ভুল ইনজেকশনের কারণে রোগীর মৃত্যুর খবর। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে যে চারটি ঘটনা ঘটেছে, তা দেখলেই বোঝা যায় বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবার বেহাল অবস্থার কথা। যে ঘটনাগুলো শুধু সাধারণ মানুষের নয়, উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বিবেককেও নাড়া দিয়েছে। উচ্চ আদালত ক্ষুব্ধ হয়ে এসব ক্লিনিককে কসাইখানা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত কয়েকটি সংবাদ তুলে ধরছি। গত ১৮ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার গৌরীপুরে লাইফ কেয়ার নামের এক ক্লিনিকে খাদিজা নামে এক নারীর গর্ভে যমজ শিশু থাকার পরও সিজারের সময় এক শিশু ভেতরে রেখেই পেটে সেলাই করে দেন ডাক্তার। খাদিজার স্বজনরা ডাক্তারকে খাদিজার পেটে যমজ সন্তান আছে জানালেও ডাক্তার শেখ হোসনে আরা দাবি করেন, খাদিজার পেটে সন্তান একটিই। অন্যটি টিউমার। পরে আবার সমস্যা দেখা দিলে ২৫ অক্টোবর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জরুরি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে খাদিজার পেট থেকে একটি মৃত ছেলে সন্তান বের করেন চিকিৎসকেরা।

গত ২৩ আগস্ট হবিগঞ্জে চাঁদের হাসি হাসপাতালে মল্লিকা দাস নামে এক নারীর সিজারের পর পেটের ভেতর তোয়ালে রেখেই সেলাই করার ঘটনা ঘটে। পরে সমস্যা দেখা দিলে অভিজ্ঞ ডাক্তার কর্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২৪ নভেম্বর ফের অপারেশন করে মল্লিকার পেটের ভেতর থেকে একটি তোয়ালে বের করা হয়।
গত মার্চ মাসে পটুয়াখালীর বাউফলের নিরাময় ক্লিনিকে সিজারের পর মাকসুদা বেগম নামে এক নারীর পেটে গজ রেখেই সেলাই করা হয়। একমাস পর মাকসুদা পেটে ব্যথা অনুভব করলে তাকে ওই ক্লিনিকে নেয়া হয়। ডাক্তার কিডনিতে সমস্যার কথা বলে ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর গত ১২ জুলাই বরিশাল মেডিক্যালে মাকসুদার পেটে অস্ত্রোপচার করে তার পেটের ভেতর থেকে গজ বের করা হয়। যে ঘটনা শেষ পর্যন্ত আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। আদালত ওই ভুয়া ডাক্তারকে অর্থ ও কারাদণ্ড দিয়েছেন।
এরপর আরেকটি আলোচিত ঘটনা ছিল গত ১৮ মে ধানমন্ডির গ্রিনরোডে অবস্থিত স্ট্রোল হাসপাতালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আফিয়া জাহান চৈতির মৃত্যুর ঘটনা। ওই শিক্ষার্থী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপতালটিতে ভর্তি হলেও তাকে দেয়া হয়েছিল ক্যান্সারের চিকিৎসা। পরে ভুল চিকিৎসায় শিক্ষার্থীর মৃত্যুর বিষয়টি স্বীকার করেছেন সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এরপর গত ২৯ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সাথে অভিভাবক নিয়ে যেতে না পারায় দরিদ্র এক রোগীকে ভর্তি করেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসা না পেয়ে সুন্দর আলী নামের এই রোগী দুই দিন পর হাসপাতালের করিডোরেই বিনাচিকিৎসায় মারা যান। রিকশাচালক সুন্দর আলী পেটের ব্যথা নিয়ে ছাতক উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। এ সময় হাসপাতালের চিকিৎসকরা সুন্দর আলীর উপযুক্ত অভিভাবককে নিয়ে আসতে বলেন। তাদের কেউ না আসায় সুন্দর আলীকে ভর্তি করা হয়নি হাসপাতালে। সুন্দর আলী আরো অসুস্থ হয়ে পড়লে একপর্যায়ে রোগী নিজেই হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে পড়েন। পাশের রোগীদের কাছ থেকে ব্যথার ওষুধ চেয়ে খান। পর দিন সারা দিন হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সরা রাউন্ডে এলেও সুন্দর আলীকে চিকিৎসা দেননি। আর সে দিন দুপুরে মারা যান তিনি। ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা অভিজিৎ শর্মা বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেছেন, মঙ্গলবার ওই রোগী চিকিৎসা নিতে এলে থাকে অভিভাবককে আনার জন্য বলা হয়। আর গুরুতর অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা করাতে কেন অভিভাবক লাগবে, এমন প্রশ্নের জবাব অবশ্য হাসপাতালের কর্মকর্তারা দিতে পারেননি।
এগুলো হলো সর্বশেষ আলোচিত কয়েকটি ঘটনা। পাঠকদের জন্য বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত আরো কয়েকটি সংবাদ শিরোনাম তুলে ধরলাম।
ভুল তথ্য দিয়ে হৃদযন্ত্রে রিং বসানোর চেষ্টা: চিকিৎসককে তলব; ২২ মার্চ ২০১৭, দৈনিক সমকাল। রংপুরে ‘ভুল চিকিৎসায়’ রোগীর মৃত্যু, ক্লিনিক ম্যানেজার গ্রেফতার; ২১ জানুয়ারি ২০১৭, কালেরকণ্ঠ। সিজারে নবজাতকের নাড়িভুঁড়ি ও কলিজা বের করে ফেলার অভিযোগ; ২৩ মার্চ ২০১৭, যুগান্তর। নার্সের অবহেলায় প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যু; ২২ নভেম্বর ২০১৭, যুগান্তর। সাভার-আশুলিয়ায় ভুল চিকিৎসায় দুই শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ; ৪ মার্চ ২০১৭, কালের কণ্ঠ। টঙ্গীতে ‘ভুল চিকিৎসায়’ রোগীর মৃত্যু, হাসপাতালে ভাঙচুর; ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বাংলাদেশ প্রতিদিন। ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু, চিকিৎসক পলাতক; ১৬ মার্চ ২০১৭, বাংলাট্রিবিউন। যশোরের চৌগাছায় ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু।

এত গেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা ডাক্তারদের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা। এবার দেখা যাক প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ও এনআইসিইউতে রোগীদের লাইফ সাপোর্টের নামে কী ধরনের প্রতারণা করা হচ্ছে। গুরুতর অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে নিলেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কৌশলে নেয়া হয় আইসিইউতে। এরপর ঘণ্টা হিসেবে সেখান থেকে আদায় করা হয় বড় অঙ্কের অর্থ।
২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারির নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ঝিগাতলায় অবস্থিত জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে সুমাইয়া সাবা নামে ছোট একটি শিশুকে ভর্তি করা হয়। ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত ছিল শিশুটি। কর্তব্যরত চিকিৎসক দ্রুত শিশুটিকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ভর্তি করেন। কিন্তু ওই রাতেই শিশুটি মারা যায়। পরদিন বেলা ১১টায়ও পরিবারের সদস্যদের কাছে মৃত্যুর খবরটি দেয়া হয়নি। পরিবারের তরফ থেকে শিশুটির শারীরিক অবস্থার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে চিকিৎসকেরা জানান, শিশুটির অবস্থা আশঙ্কাজনক। এরপর শিশুটির স্বজনেরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার কথা বললে আইসিইউ থেকে শিশুটিকে বের করতে গড়িমসি করে কর্তৃপক্ষ। তারা জানায়, শিশুটিকে দেয়া হবে না। এ নিয়ে স্বজনদের দৌড়ঝাঁপ আর হয়রানি র্যাবের চোখে পড়ে। পরে র্যাবের সহায়তায় আইসিইউতে ঢুকে স্বজনেরা শিশুটির নিথর দেহ দেখতে পান। এরপর হাসপাতালটিকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা জরিমানা করে র্যাব-২ এর ভ্রাম্যমাণ আদালত।

২০১৬ সালের ২৯ মার্চ বাংলাট্রিবিউনে প্রকাশিত নিউজ থেকে জানা যায়, ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় ফারজানা ইয়াসমিন মিথিলা (২৮) নামে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়। নিহতের স্বজনদের অভিযোগ ছিল মৃত্যুর পরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকেরা মিথিলাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে টালবাহানা করে। প্রসূতির স্বজনদের অভিযোগ ছিল হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসকেরা মিথিলাকে সিজার অপারেশনের জন্য অ্যানেসথেসিয়া করেন। যে কারণে তার খিঁচুনি ওঠে। পরে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় তাকে আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। মিথিলা গত দুই দিন আগেই মারা গেছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকেরা যোগসাজশ করে তাকে আইসিইউতে রেখেছে। ভর্তির দুই দিন পর হাসাপাতাল কর্তৃপক্ষ এক লাখ ৪০ হাজার টাকা বিল ধরিয়ে দেয়।

২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল ভোরের কাগজে প্রকাশিত নিউজ অনুযায়ী, ২৪ এপ্রিল জান্নাতুল নাঈমা নামে আট বছর বয়সী একটি শিশুকে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এনে তার পরিবার হাতিরপুলের পদ্মা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে দ্রুত শিশুটিকে এনআইসিইউতে স্থানান্তর করে চিকিৎসকেরা। কিন্তু কোনো সুবিধাই কথিত ওই এনআইসিইউতে বিদ্যমান ছিল না। এ ছাড়া শিশুটির চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষিত ডাক্তার ও নার্স সেখানে উপস্থিত ছিল না। এনআইসিইউর অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে পরে শিশুটি মারা যায়। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শিশুটির মৃত্যুসংবাদ তার পরিবারকে না দিয়ে তাদের ভাষায় চিকিৎসা করতে থাকে। পরে র্যাব-২ এর ভ্রাম্যমাণ আদালত হাসপাতালে শিশুটিকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়। পরে র্যাব হাসপাতালটিকে জরিমানা করে।
এখানে আমি অল্প কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলাম। এমন আরো অসংখ্য ঘটনা আছে। আবার অনেক ঘটনা সংবাদপত্রে আসেও না। গণমাধ্যমকর্মীরা সংবাদ পাওয়ার আগেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে দফারফা করে ফেলে। আর একটি লেখায় সব ঘটনা উল্লেখ করাও সম্ভব নয়। অল্প কয়েকটি ঘটনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে উন্নত চিকিৎসাসেবার নামে বর্তমানে কী চলছে।
লেখক: সাংবাদিক

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/293706