১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৯:০৮

আওয়ামী লীগের আশাভঙ্গের কাল

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : মানুষের মুখ তো বন্ধ রাখা যায় না। যদিও সরকার মুখ বন্ধ করার জন্য নানা ধরনের আইন জারি করার পাঁয়তারা করছে। তা সত্ত্বেও ঝুঁকে সম্পর্কে জেনে কিংবা না জেনে মানুষ কথা বলেই যাচ্ছে। সে কথা বহু রকম। তার ভেতরের নানা প্রশ্ন নানা সংশয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে নিম্ন আদালত যে সাজা দিয়েছে, সেটিও প্রশ্নের বাইরে নয়। আর এ কথাও তো ঠিক যে, নিম্ন আদালতের অধিকাংশ রায় উচ্চ আদালতে গিয়ে ওলটপালট হয়ে যায়। নিম্ন আদালতে যাকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়, উচ্চ আদালতে গিয়ে তিনি বেকসুর খালাস পান। অর্থাৎ নিম্ন আদালতের রায়ই চূড়ান্ত নয়। বিচারক মোহাম্মদ আখতারুজ্জমান বেগম খালেদা জিয়ার এই মামলাকে নিষ্পত্তি করার জন্য খুব তাড়াহুড়োয় ছিলেন। সে কারণে সপ্তাহে তিনদিন-চারদিন করে খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির করে শুনানি করেছেন। তারপর ৬৩২ পৃষ্ঠার রায় লিখে তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। এই ৬৩২ পৃষ্ঠার রায়টি তিনি লিখেছেন মাত্র ১০ দিনে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে, আখতারুজ্জমান নিজে অক্লান্ত পরিশ্রম করে রাত-দিন কাজ করে এই রায়টি লিখেছেন। কিন্তু রায়ে আইনজীবীদের ভাষ্য মতে তিনি বলেছেন, এই মামলায় খালেদা জিয়ার সরাসরি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তার বয়স ও পদমর্যাদা বিবেচনা করে তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হলো।
সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, সংশ্লিষ্টতা পাওয়া না গিয়ে থাকে তাহলে কারাদণ্ড দেয়া হবে কেন? অপরদিকে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে ২ কোটি ৫২ লাখ টাকা, যা কুয়েতি আমীরের ব্যক্তিগত দান ছিলো, তার এক পয়সাও খরচ করা হয়নি। গোটা টাকাটা ব্যাংকে পড়ে আছে, আর তা এতদিনে ব্যাংকে পড়ে সুদে-আসলে ৬ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তাই যদি হয়, তাহলে এখানে অপরাধ কোথায় হলো? অপরাধ এইটা হতে পারে যে, টাকাটা দান করার কথা ছিলো- তা দান না করে ব্যাংকে রাখা হলো কেন। এও অভিযোগও চরম হাস্যকর। এই সরকারের আমলে সকল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, ফার্মার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি একেবারে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। মহাপরাক্রমশালী দুদক এদের টিকিটির নাগালও করতে পারছে না। লোক দেখানোর জন্য বেসিক ব্যাংকের শেখ বাচ্চুকে দুই একবার ডেকে পাঠিয়েছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ উত্থাপন করেনি। সেটি হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাপার। হলমার্ক কেলেঙ্কারির সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা কোথায়? তার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের নাম প্রকাশে তথা তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত একেবারে হিমালয় পর্বতের মত তাদের রক্ষক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সে তদন্ত রিপোর্ট দুইবছরেও আলোর মুখ দেখলো না। কোথায় সরকারের সততা? কোথায় সরকারের স্বচ্ছতা? কোথায় সরকারের জবাবদিহিতা? এর কোনো কিছুই প্রশ্নের অতীত নয়। হলমার্কের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা যখন সোনালী ব্যাংক থেকে লুট হয়ে গেল, তখন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আমাদের দেশ এত বড় বাজেটের দেশ সেখানে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা কোনো টাকাই না। কিন্তু এই সরকারের কাছে যে দুই কোটি টাকা ৬ কোটি হলো- সেটি বিরাট টাকা! আর তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে।

খালেদা জিয়ার যে শাস্তি হবে। সরকার তা আগে থেকে জানতো। আর সে কারণেই সরকার সারাদেশের বিএনপি নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। কেউ হয়তো রংপুর থেকে ঢাকা আসছেন। গাবতলীতে তাদের পুলিশ হাজার বার জিজ্ঞেস করেছে, ঢাকায় কেন আসছেন। এভাবে দেশজুড়ে খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের আগেই এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। ঢাকা যেন শুধু সরকারি চাঁইদের জন্য, বাকি সবার প্রবেশ নিষেধ। এ রকম আইন ছিল ইরানের শাহের আমলে। তখন সাধারণ মানুষের তেহরানে ঢুকতে এক ধরনের পারমিট নিতে হতো। সরকার তেমনই আয়োজন করেছিল। সরকার যদি তাই না জানতো যে খালেদা জিয়ার শাস্তি হবে, তাহলে পরিত্যক্ত জেলখানার রুম ছাপছুতরো করল কেন? সেখানে খালেদা জিয়াকে রাখার জন্য। আর ৮ তারিখ সকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সারাদেশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। তখনই প্রমাণিত হয়েছিল, খালেদা জিয়া দোষী হোন বা না হোন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হোক বা না হোক, শাস্তি তাকে দেয়াই হবে।
এবং আশ্চর্য ঘটনা এই যে, সরকার ভেবেছিল শাস্তির কথা আঁচ করে খালেদা জিয়া একেবারে মুষড়ে পড়বেন আর কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করে যাবেন। কিন্তু খালেদা জিয়া তার চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য আপোষহীন নেত্রী হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে সমাদৃতত। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, আমি কোনো অন্যায় করিনি। যেখানেই থাকি আপনাদের সঙ্গে আছি। কিছুতেই ভায়োলেন্ট হবেন না। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া যখন আদালতের দিকে রওনা হলেন, তখন সরকার ভেবেছিল তারা সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলেছেন। অল কোয়ায়েট ইন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। সব কিছু শান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার গাড়ি যখন মগবাজারে হাজির হলো তখন কোথা থেকে যেন হাজারে হাজারে মানুষ তার গাড়ি বহরের সঙ্গে যোগ দিল। যেন খালেদা জিয়া হ্যামিলনের বংশীবাদক। এই গণজোয়ারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সরকারের হিংস্র পুলিশ বাহিনীও, তারা আঘাত করার কল্পনাও করেনি। সেই জনস্রোত খালেদা জিয়ার পেছনে পেছনে চানখাঁরপুল মোড় পর্যন্ত গিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে এই যে, এর কোথায়ও বিএনপি’র নেতাকর্মীরা সামান্য উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেনি। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে এই দীর্ঘ পথ তারা অতিক্রম করেছে

বিকেল তিনটার দিকে খালেদা জিয়ার সাজার রায় ঘোষণা হয়েছে। খালেদা জিয়া প্রস্তুতই ছিলেন। আওয়ামী লীগ আশা করেছিল, রায় ঘোষণার সাথে সাথে হরতাল অবরোধ প্রভৃতি কঠোর কর্মসূচি দেবে বিএনপি। তখন আওয়ামী লীগ দুই চারটা বাস জ্বালিয়ে, কোথাও বাসে আগুন দিয়ে, গান পাউডার দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে বলতে পারবে যে, বিএনপি সন্ত্রাসি কার্যক্রম করেছে। কিন্তু বিএনপি তার কিছুই করেনি। বরং আওয়ামী লীগ নিজেই ময়মনসিংহে ট্রেনে আগুন দিতে গিয়েছিল। আর সাতক্ষীরায় গ্যারেজে এসি বাসে আগুনে দেয়ার চেষ্টা করে। ফেনীতে আগুন দেয় ক্যাভার্ড ভ্যানে। কিন্তু জনতার প্রতিরোধে তারা পালিয়ে যায়। বেগম জিয়াকে কারাবন্দী করার পর আ’লীগ যা চেয়েছিল সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়নি।

গত ১২ই ফেব্রুয়ারি বিএনপি শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন কর্মসূচি দিয়েছিল। সে কর্মসূচিতে খালেদা জিয়ার গ্রেফতারের প্রতিবাদে লাখো মানুষ সমবেত হয়েছিল। সেই বিশাল জনসমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে আওয়ামী পুলিশদের কিছুই করার ছিল না। কারণ এত বড় সমাবেশও ছিল শান্তিপূর্ণ। সামনে আরও যে সব কর্মসূচি আছে আমরা তো বিশ্বাস করি, সেসব কর্মসূচিও শান্তিপূর্ণ পালিত হবে। এবং বিএনপি’র নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানাই, যাতে কোনো রকম উসকানির ফাঁদে তারা পা না দেন। ১২ তারিখে শুধু যে ঢাকায়ই এ বিশাল সমাবেশ হয়েছে তা নয়, সারা দেশে বিক্ষুব্ধ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ প্রতিবাদে অংশ নিয়েছে। সর্বত্রই সৃষ্টি হয়েছে খালেদা জিয়ার সাজার বিরুদ্ধে ও মুক্তির দাবিতে জনজোয়ার। এটা সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ের মতো নিঃশব্দে এগিয়ে আসে, তারপর সশব্দে কূলের উপর আছড়ে পড়ে। এখন প্রায় সকলেই বলছেন, খালেদা জিয়ার এই গ্রেফতারের ফলে তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। এ দেশের গণমানুষে বিশ্বাস করেন না যে, তিনি কোনো অপরাধ করেছেন। আত্মসাৎ যে করেননি তার প্রমাণ তো ব্যাংকেই আছে। তাহলে ইতিমধ্যেই সরকারের বেসামাল নেতারা বলতে শুরু করেছেন যে, খালেদা জিয়া দুর্নীতিবাজ। সিরাজ শিকদারকে হত্যার পর শেখ মুজিব যেমন পার্লামেন্টে বলেছিলেন, ‘কোথায় আজ সিরাজ শিকদার।’

খালেদা জিয়াকে জেলে পুরে শেখ হাসিনাও বললেন, কোথায় আজ খালেদা জিয়া। এসব দম্ভোক্তি শেষ পর্যন্ত ঠাঁটা ঢেঁকির বাদ্যের মতো শোনায়। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পাশাপাশি আইনি লড়াইয়েরও প্রস্তুতি চলছে। ইতিমধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও জামিন প্রলম্বিত করার জন্য তিনটি মামলায় তাকে শ্যোন অ্যারেস্টও দেখানো হয়েছে। আপিলের জন্য মামলার রায়ের সার্টিফাইড কপি দিতেও গড়িমসি করা হচ্ছে। কিন্তু এসব দিয়ে আওয়ামী লীগের শেষ রক্ষা হবে বলে মনে হয় না।

http://www.dailysangram.com/post/319062