১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:০১

জলবায়ু ট্রাস্টের প্রকল্প বাস্তবায়ন অনিশ্চিত

তহবিলের টাকা ব্যবহারে নীতিমালা হচ্ছে

‘জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলের’ ৫০৮ কোটি টাকা ফেরত দিতে পারছে না ফারমার্স ব্যাংক। এতে বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে এ তহবিলের ব্যয়ে পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচি। কারণ ব্যাংকে সংরক্ষিত অর্থের বিপরীতে প্রাপ্য মুনাফা দিয়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা কর্মসূচি ও প্রকল্পগুলো। এছাড়া বেসরকারি একটি ব্যাংকে ট্রাস্টের বিপুল অঙ্কের অর্থ জমা রাখার কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে এ তহবিল। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জলবায়ু ট্রাস্ট তহবিল সংক্রান্ত বৈঠকে উঠে এসেছে এ উদ্বেগ, আশঙ্কা ও সংকটের কথা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

সূত্রমতে, সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় তহবিলের অর্থ ব্যাংকে রাখার ব্যাপারে নতুন করে একটি নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
জানা গেছে, বেসরকারি একটি ব্যাংকে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলের এ অর্থ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল সদ্য বিদায়ী পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু দায়িত্বে থাকাকালীন। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু যুগান্তরকে বলেন, এখন আমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নেই। তবে ট্রাস্ট তহবিলের এ অর্থের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টি রয়েছে। এর বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি।
এদিকে ফারমার্স ব্যাংক জলবায়ু ফান্ডের টাকা ফেরত না দেয়ার বিষয়টি জাতীয় সংসদে তুলেছেন নতুন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শরণাপন্ন হয়েছে পরিবেশ এবং বন মন্ত্রণালয়। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, অর্থ সংকটের ফলে জলবায়ু মোকাবেলায় হাতে নেয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঝুঁকিপূর্ণ মানুষগুলো ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। জনগণের টাকায় পরিচালিত এ তহবিল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা এ ধরনের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত কেন নিলেন বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। তিনি আরও বলেন, এমন একটি ব্যাংকে টাকা রাখা হয়েছে যাদের সক্ষমতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল, নতুন একটি ব্যাংকও বটে। শুধু অতিরিক্ত মুনাফার জন্য এখানে বিনিয়োগের কোনো যুক্তি ছিল না। যারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের জবাবদিহিতায় আনা উচিত বলে আমি মনে করি।

জানা গেছে, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত গত ৯ বছরে সরকার জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা প্রদান করেছে। এ ট্রাস্ট আইনের বিধান অনুযায়ী তহবিলের ৬৬ শতাংশ ব্যয় হওয়ার কথা প্রকল্প বা কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। অবশিষ্ট ৩৪ শতাংশ অর্থ স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখতে হবে। ফলে মোট তহবিলের ৩৪ শতাংশ অর্থাৎ ১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা স্থায়ী আমানত হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। পাশাপাশি ২০০৯-১০ অর্থবছরে বরাদ্দের অব্যয়িত ১০৩ কোটি টাকাও স্থায়ী আমানত হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। এতে প্রাপ্য সুদসহ মোট স্থায়ী আমানতের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৮০৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এ অর্থের মধ্যে সরকারি ব্যাংকে জমা আছে ১ হাজার ২৯০ কোটি ২০ লাখ টাকা। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকে ৫০৮ কোটি টাকা ও সাড়ে ৮ কোটি টাকা এবি ব্যাংকে এফডিআর হিসেবে জমা রাখা হয়।
সূত্রমতে, ফারমার্স ব্যাংকে রক্ষিত অর্থের মধ্যে ৪৫৫ কোটি টাকার এফডিআর মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। এ টাকা নগদায়ন করতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেয়ার পরও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নগদায়ন করেনি। কারণ সম্প্রতি এ নতুন প্রজন্মের ব্যাংকটি বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়েছে। শুধু ট্রাস্ট তহবিলের অর্থ নয় সাধারণ গ্রাহকের মধ্যেও অনেকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও নির্দেশ প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমানকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর কোনো সুরাহা হয়নি।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ফজলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ফারমার্স ব্যাংক জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলের অর্থ ফেরত দিতে না পারলে তা বাংলাদেশ ব্যাংক দেখবে। অর্থ বিভাগ এ ধরনের তহবিল রাখার একটি বিধান করে দিয়েছে। এর মধ্যে ৭৫ ভাগ সরকারি ও ২৫ ভাগ বেসরকারি ব্যাংক রাখতে হবে। আমাদের কাছে লিখিত পত্র দেয়া হলেও কিছু করার থাকবে না। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংককে সব ধরনের ক্ষমতা দেয়া আছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সেখানে তহবিলের বিপুল পরিমাণ অর্থ বেসরকারি একটি ব্যাংকে জমা রাখাকে ঝুঁকি হিসেবে মনে করা হয়। বৈঠকে আরও বলা হয়, ব্যাংকে ট্রাস্ট তহবিল সিড মানি হিসেবে রাখা হয়। এর বিপরীতে প্রাপ্য সুদ দিয়ে জলবায়ু পরির্তন মোকাবেলায় গ্রহণকৃত কর্মসূচি ও প্রকল্পের ব্যয় মেটানো হচ্ছে। কিন্তু সিড মানি ব্যাংকে আটকে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন প্রকল্পের অনুকূলে অর্থ ছাড় সম্ভব হচ্ছে না। এতে যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় স্বর্ণদ্বীপে মাল্টিপারপাস সাইক্লোন সেন্টার, বগুড়া পৌরসভা ও কুমিল্লায় ড্রেন নির্মাণ, স্যানিটেশন ও সড়কে বাতি নির্মাণ এবং সাইক্লোন মোকাবেলায় পিরোজপুরে সহিষ্ণু গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এছাড়া ভোলার চরফ্যাশনে পরিবেশবান্ধব সৌর বিদ্যুৎ চালিত সড়ক বাতি স্থাপন, ঝিনাইদহের মহেশপুর পৌরসভার ড্রেনেজ অবকাঠামো উন্নয়ন, শরীয়তপুরে ৬টি উপজেলায় আর্সেনিকমুক্ত গভীর নলকূপ স্থাপন, বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ পৌরসভার অন্তর্গত বেড়িবাঁধ ও রাস্তাঘাট উন্নয়ন, দিনাজপুরের বিরল উপজেলাধীন মালঝাড় চকচকা নামক স্থানে টেপা নদীর তীর সংরক্ষণ কাজ চলছে। পাশাপাশি নেত্রকোনা পৌরসভা এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসন ও পরিবেশ উন্নয়ন, জলবায়ু সহিষ্ণু পর্যটন শিল্প উন্নয়নে দায়িত্বশীল পর্যটন ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন, পরিবেশ অধিদফতর চট্রগ্রামের গবেষণা সম্প্রসারণ ও আধুনিয়কায়ন, সোনাগাজী পৌরসভায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বনায়ন সৃজন ও গভীর নলকূপ স্থাপন কাজও চলছে। এসব প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরেই শেষ হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/16988