কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা নদীর চরে স্থাপিত রাজশাহী নগরীর অন্যতম পানি শোধনাগার এখন অচল
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৫৫

রাজশাহীতে পদ্মার চরে ১০৩ কোটি টাকার পানি শোধনাগার ॥ চালু থাকে মাত্র দু’মাস

পানি শোধনাগারের নামে এক অবাস্তব প্রকল্প চেপে বসেছে রাজশাহী নগরবাসীর কাঁধে। পানিশূন্য পদ্মায় এই শোধনাগার স্থাপনে ব্যয় হয়েছে ১০৩ কোটি টাকা। এটি বছরে চালু থাকে মাত্র দু’মাস। ফলে এটি নগরবাসীর প্রয়োজন পূরণে সমর্থ হচ্ছে না।

নগরবাসীর অভিযোগ, কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিয়েও রাজশাহী মহানগরীতে পানি সরবরাহে সংকট অব্যাহত রয়েছে। ১০৩ কোটি টাকারও বেশী ব্যয়ে পানিশূন্য পদ্মা নদীর চরে স্থাপিত রাজশাহী নগরীর অন্যতম পানি শোধনাগার এখন কঙ্কালের রূপ নিয়েছে। তারও আগে ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত ৪টি পানি শোধনাগার অকেজো হয়ে এখন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। এভাবে একের পর এক অবাস্তব প্রকল্প স্থাপন নিয়ে নগরবাসীর মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ২০১১ সালে সিটি কর্পোরেশনের পানি বিভাগকে সম্পূর্ণ আলাদা করে প্রতিষ্ঠা করা হয় রাজশাহী ওয়াসা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ, রাজশাহী নগরীতে পানি সরবরাহের জন্য পদ্মা নদীতে স্থাপিত ‘শহীদ কামারুজ্জামান পানি শোধনাগার’ এখন ওয়াসা’র মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খরা মওসুমে পদ্মায় চাহিদা মতো পানি না পাওয়ায় এটি বন্ধ হয়ে যায়। এতে নগরবাসীকে চরম পানি সংকটে পড়তে হয়। এ সময়ে বিকল্প উপায়ে পানির চাহিদা মেটাতে ওয়াসা নগরীর বিভিন্ন স্থানে ডিপটিউবওয়েল বসাতে হচ্ছে। বিগত মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন তাঁর মরহুম পিতার নামে নগরীর পূর্বপ্রান্তে পদ্মা নদীর শ্যামপুরে ‘শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান পানি শোধনাগার’ স্থাপন করেন। শ্যামপুর বালুর ঘাট এলাকায় এটি উদ্বোধন করা হয় ২০১১ সালের ২ মার্চ। পর্যায়ক্রমে এর মোট ব্যয় দাঁড়ায় ১০৩ কোটি ৩ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। কিন্তু বিপুল অঙ্কের এই প্রকল্প অচল হয়ে মূল্যবান সব যন্ত্রপাতি বিনষ্ট হচ্ছে। নগরবাসীর পানির চাহিদা মেটাতে শোধনাগারটি আর কোন কাজে না আসায় মুশকিলে পড়েছে রাজশাহী ওয়াসা। আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে এটি চালুরও কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না প্রকৌশলীরা। পদ্মা নদীর পানি নগরীর চাহিদা মেটাবে এমন আশায় শোধনাগারটির উদ্বোধন করা হলেও কখনোই পূর্ণ শক্তিতে এক ঘণ্টার বেশি তা চালু করা যায়নি। ২০১১ সালের জুলাই মাসে ৬ বার পূর্ণশক্তিতে পাম্প চালানোর উদ্যোগ নেয়া হলেও পানির চাপে এর আগেই কয়েকটি স্থানে ফেটে যায় পাইপলাইন। এদিকে গত কয়েক বছর থেকে সেখানে কেবল বালুচর দেখা যাচ্ছে। ফলে ধূ ধূ বালু চরেই আটকে গেছে পানি তোলার শত কোটি টাকা। এটি বন্ধ হয়ে যাবার ফলে নগরীতে পানি সংকট বাড়ছে। এই সংকট মোকাবেলায় বিকল্পের কথা বলছেন ওয়াসার কর্মকর্তারা। তারা স্বীকার করেছেন, প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই সঠিক ছিল না। কিন্তু এই প্রকল্প কোন যুক্তিতে স্থাপন করা হলো তার কোন জবাব তারা দিতে পারেননি। এই বিপুল গচ্চার দায় কে বহন করবে তাও জানা যায়নি। বলা হচ্ছে, ফারাক্কার কারণে পদ্মায় বছরের বেশীর ভাগ সময়ই পানি থাকে না। বিশেষ করে যে স্থানে প্রকল্প স্থাপন করা হয়েছে সেখানে বর্ষা মওসূমের কিছুদিন ছাড়া বাকি সময় পানিই থাকে না। এটা জানা সত্ত্বেও কোন হিসেবে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে এমন একটি অবাস্তব প্রকল্প স্থাপন করা হলো- নগরবাসী সে প্রশ্নও তুলেছেন। উল্লেখ্য, পদ্মার চরের এই প্রকল্পটি স্থাপনের সময় তৎকালীন মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন নগরীতে পানি শোধনাগার প্রকল্প নিয়ে বিগত বিএনপি সরকারের সমালোচনায় মুখর ছিলেন। কিন্তু তার সময়ের প্রকল্পও একই পরিণতি লাভ করলো। এর আগে রাজশাহী নগরীতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪টি পানি শোধনাগার (ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) স্থাপন করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পর সেগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এসব প্লান্ট এখন নগরীতে অনিয়মের মনুমেন্ট হয়ে আছে।
বিশুদ্ধ পানির ঘাটতি ৬ কোটি লিটার

কোটি কোটি টাকা খরচ করে এতোসব প্রকল্প নিয়েও রাজশাহী নগরীতে বিশুদ্ধ পানির সংকট মিটছে না বলে জানা গেছে। রাজশাহী ওয়াসার বেশির ভাগ গভীর নলকূপ দিয়ে পানি কম ওঠায় এবং ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পানির সংকট প্রকট হয়ে উঠছে। বর্তমানে সরবরাহকৃত পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আয়রণ ও চুন থাকে। ফলে পানি ও স্যানিটারি সামগ্রী দ্রুত নষ্ট হয়। গোসল, কাপড় ধোয়া এবং রান্নার কাজেও এই পানি ব্যবহার করতে সমস্যার মুখে পড়তে হয়। বর্তমানে নগরীতে প্রতিদিন পানির ঘাটতিও অন্তত ৬ কোটি লিটার বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, বিশুদ্ধ পানির চাহিদা পূরণে স্থাপিত ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টগুলো নানান সংকটের কারণে বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে ৭৬টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে সরাসরি পাইপের মাধ্যমে প্রতিদিন নগরীতে সাড়ে ৫ কোটি লিটারের বেশী পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে এই চাহিদা প্রায় ১২ কোটি লিটার। নগরজুড়ে সাড়ে ৫শ’ কিলোমিটার পাইপ লাইনের মাধ্যমে প্রায় ৮ লাখ নগরবাসীর পানির চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা চলছে। একজন কর্মকর্তা জানান, পানির চাহিদা পূরণে রাজশাহী ওয়াসা আরো ২০টি গভীর নলকূপ বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এরমধ্যে ১০টি বসানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। তবে এখনো রাজশাহীর প্রায় ৩০ ভাগ মানুষ ওয়াসার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।

http://www.dailysangram.com/post/318897