১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ৯:৫৫

হজযাত্রীদের সঙ্গে কেন বৈষম্য

হজ মৌসুমে সাধারণ যাত্রীরা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ঢাকা-জেদ্দা-ঢাকা রুটে সর্বোচ্চ ৬৫ হাজার টাকায় যাতায়াত করতে পারেন। বছরের অন্য সময় ওমরাহ হজে বিমান ভাড়া সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া সারাবছরই প্রবাসী শ্রমিক ও অন্যরা ৪০ হাজার টাকায় ঢাকা থেকে সৌদি আরবের রিটার্ন টিকিটে আসা-যাওয়া করছেন। অথচ হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া গুনতে হচ্ছে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। একই বিমানে পাশের আসনে বসা সাধারণ যাত্রীর তুলনায় একজন হজযাত্রী তিন গুণ বা এক লাখ টাকা বেশি দিচ্ছেন।

হজের সময় হজ ফ্লাইট ছাড়াও নিয়মিত ফ্লাইটে হজযাত্রী পরিবহন করা হয়। এ বছর এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন পবিত্র হজব্রত পালনে সৌদি আরব যাবেন। এসব হজযাত্রীকে সাধারণ যাত্রীদের তুলনায় প্রায় ৯৫০ কোটি টাকা বেশি ভাড়া গুনতে হবে। এর অর্ধেক পাবে বিমান আর বাকি অর্ধেক নেবে সৌদিয়া এয়ারলাইন্স। সৌদিয়া এয়ারলাইন্স অর্ধেক হজযাত্রী পরিবহন করে। সাধারণ ফ্লাইটে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে তারা হজযাত্রী বহন করে। অনেক হজযাত্রীকে তারা দুবাই ঘুরিয়ে নিয়ে যায়। দীর্ঘ সময় বিভিন্ন এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করানো হয়।

একই যাত্রীসেবা ও একই ফ্লাইটে বিমানের এমন ভাড়া বৈষম্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ অবস্থায় আবারও ভাড়া বাড়ানো নিয়ে বিমান, হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মধ্যে টানাপড়েন চলছে। হাব নেতারা বলছেন, দ্বিগুণ-তিন গুণ ভাড়া দিয়েও হজযাত্রীরা বাড়তি কোনো সুবিধা পান না; বরং কখন ফ্লাইট বাতিল, আবার কখনও দীর্ঘ ট্রানজিটে দুর্ভোগে পড়েন। আবার ফ্লাইট বিলম্বের কারণে হজযাত্রীদের দিনের পর দিন হজক্যাম্পে এহরাম বেঁধে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়।

এ বছর হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া এক লাখ ৩০ হাজার ৬৯৬ টাকা করার প্রস্তাব দেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে গত সপ্তাহে আরও প্রায় ১০ হাজার টাকা বাড়িয়ে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা করার নতুন প্রস্তাব দেয় সংস্থাটি। এতে হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া আরও প্রায় ১২ শতাংশ বেড়ে যাবে। গত বছর হজ প্যাকেজে এ ভাড়া ছিল এক লাখ ২৪ হাজার ৭২৩ টাকা।

এরই মধ্যে বিমান হজযাত্রীদের ইকোনমি ও বিজনেস ক্লাস- এ দুই শ্রেণিতে ভাগ করে ভাড়া নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছে। এতে বিজনেস শ্রেণির হজযাত্রীদের ভাড়া আরও বাড়বে। এর আগে হজযাত্রীরা ইকোনমি শ্রেণির ভাড়ায় ভ্রমণ করতেন। এ বিষয়ে হাব নেতারা বলছেন, হজযাত্রীদের মধ্যে সাধারণ ও ভিআইপি বলে কোনো কিছু নেই; সবাই সমান, সবাই আল্লাহর মেহমান।

নেত্রকোনার পূর্বধলার আগিয়া গ্রামের স্কুলশিক্ষক কাছিম উদ্দিন মাস্টার সমকালকে বলেন, আমার ভাতিজা আবু বক্কর সৌদি আরবের রিয়াদে চাকরি করে। প্রতিবছর ৪০ হাজার টাকায় বাংলাদেশ বিমানে আসা-যাওয়া করে। আমি এবার হজে যাওয়ার নিবন্ধন করেছি। অথচ এজেন্সিগুলো বলছে, এবার বিমান ভাড়া লাগবে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, হজযাত্রীদের ভাড়া এত বেশি কেন, কেন এমন বৈষম্য? একই প্রশ্ন রাজধানীর মিরপুরের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী মোমেনা ও আবদুল বাতেন আমিন দম্পতির। তারা এ বছর হজে যাচ্ছেন।

বনানীর ব্যবসায়ী খন্দকার আকরাম হোসেন পাভেল বলেন, গত নভেম্বরের শেষে তারা ছয় বন্ধু মিলে ওমরাহ হজ করে এসেছেন। তখন বিমান ভাড়া ছিল ৪২ হাজার টাকা। এবার তিনি স্ত্রী ও দুই বাচ্চাকে নিয়ে হজে যাবেন। বিমান ভাড়া এক লাখ ৪০ হাজার টাকা শুনে তিনি বিস্মিত।

বিমান ভাড়া নিষ্পত্তি না হওয়ায় হজ প্যাকেজ চূড়ান্ত করতে পারছে না ধর্ম মন্ত্রণালয়। এ বছর সরকারি ব্যবস্থাপনায় 'এ' ক্যাটাগরির হজ প্যাকেজের জন্য জনপ্রতি তিন লাখ ৭৩ হাজার ৬৭২ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। 'বি' ক্যাটাগরির প্যাকেজের মূল্য ধরা হয়েছে তিন লাখ আট হাজার ৬২৮ টাকা। বিমান ভাড়া চূড়ান্ত হওয়ার পর মন্ত্রিসভা হজ প্যাকেজ অনুমোদন করবে। প্যাকেজের মধ্যে কোরবানির খরচ ধরা হয়নি। এটা হজযাত্রীদেরই দিতে হবে। হজযাত্রীদের ট্রলি ব্যাগের মূল্য প্রস্তাব করা হয়েছে আড়াই হাজার টাকা। বিমান ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ২৬ হাজার ৬৯৫ টাকা। মক্কা-মদিনায় বাড়ি ভাড়া ধরা হয়েছে এক লাখ ৫০ হাজার ৫৯১ টাকা। গত বছর পুরো হজ প্যাকেজের মূল্য ছিল জনপ্রতি তিন লাখ ৬০ হাজার ২৮ টাকা। 'বি' প্যাকেজের মূল্য ছিল তিন লাখ চার হাজার ৯০৩ টাকা। এর বাইরে হজযাত্রীদের প্রাক-নিবন্ধনের সময় ৩০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।

ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী দু-এক সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিসভায় হজ প্যাকেজ চূড়ান্ত হবে। এরপর আগামী মে মাসের মধ্যে প্যাকেজের পুরো টাকা নির্ধারিত ব্যাংকে জমা দিতে হবে।

ধর্ম মন্ত্রণালয় জানায়, গত ডিসেম্বরে ধর্ম মন্ত্রণালয় ঢাকা-জেদ্দা রুটে বিমান ভাড়া নির্ধারণের প্রস্তাব জানাতে চিঠি দেয় বিমান মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু বিমান কর্তৃপক্ষ যে কোনো সময় জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে পারে বলে প্রস্তাব দিতে সময়ক্ষেপণ করে। পরে জানুয়ারির শেষে ভাড়া বাড়িয়ে প্রস্তাব পাঠায় তারা। এর পর গত সপ্তাহে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং হাব হজ প্যাকেজ নিয়ে এক বৈঠক করে। বৈঠকে ঢাকা-জেদ্দা রুটে ইকোনমি ক্লাসে এক হাজার ৬৫০ ডলার ও বিজনেস ক্লাসে দুই হাজার ৪৯০ ডলার ভাড়া নির্ধারণের প্রস্তাব করে বিমান মন্ত্রণালয়। এ প্রস্তাবে হাব ও ধর্ম মন্ত্রণালয় আপত্তি জানায়। পরে বিমান মন্ত্রণালয় ইকোনমি ক্লাসের ভাড়া এক হাজার ৬০৮ ডলার করার কথা বলে। কিন্তু ভাড়া আরও কমানোর সুপারিশ করে ধর্ম মন্ত্রণালয়। ভাড়া চূড়ান্ত না করেই বৈঠক শেষ হয়। পরে ওই দিনই বিমান কর্তৃপক্ষ বিমানের চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে ভাড়া পর্যালোচনা করার জন্য কমিটি গঠন করে। কমিটিতে ধর্ম মন্ত্রণালয়, বিমান বোর্ড, বিমান মন্ত্রণালয় ও হাব নেতাদের সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। আজ সোমবার বিকেলে বিমানের প্রধান কার্যালয় বলাকায় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এ বৈঠক থেকেই চূড়ান্ত ভাড়া নির্ধারণ করা হবে বলে জানা গেছে।

হাবের মহাসচিব শাহাদত হোসেন তসলিম বলেন, বছরের যে কোনো সময় বিমান মাত্র ৪০ হাজার টাকায় টিকিট বিক্রি করে। অথচ হজযাত্রীদের বেলায় এক লাখ ৪০ হাজার নিচ্ছে। এটা স্বাভাবিক ভাড়ার চেয়ে তিন গুণের বেশি। হজের সময় বিমানের কোনো আসন খালি যায় না। অন্য সময় আসন খালি যায়। তাই পুরো আসন বিক্রি হলে স্বাভাবিক নিয়মে ভাড়া কমার কথা। এ ছাড়া বিমান নিজেরাই নিজেদের ভাড়া ঠিক করে। এখানে গণশুনানি বা হজযাত্রীদের কোনো মতামত নেওয়া না। তিনি জানান, বিমান ভাড়া ৮০ থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা করার দাবি জানিয়েছে হাব।

বিমানের পরিচালক আলী আহসান বাবু সমকালকে বলেন, হজযাত্রীদের নিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কখনও ব্যবসা করে না। এবার আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও মক্কা-মদিনায় এয়ার ট্রাফিক ফি বাড়ার কারণে কিছুটা ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি বলেন, হজযাত্রীদের জিম্মি করে মুনাফা করার মানসিকতা নেই বিমানের।

এ বিষয়ে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান সমকালকে বলেন, হজযাত্রীদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সব পক্ষ মিলে ভাড়া নির্ধারণের জন্য কমিটি করা হয়েছে। আশা করছি, যৌক্তিক ভাড়া নির্ধারিত হবে।

 

http://samakal.com/todays-print-edition/tp-mohanagar/article/18022191