১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ৯:৩৮

‘যৎসামান্য’ থেকে ‘কিছুটা’ এবং অর্থমন্ত্রী

আশিকুল হামিদ : শিরোনাম দেখে পাঠকরা বিভ্রান্ত হতে পারেন- বিশেষ করে অর্থমন্ত্রীকে টেনে আনার কারণে। আমি অবশ্য জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিতের পরিচিতি দেয়ার জন্য ‘তিনি’ ও ‘তেনার’ লিখতে পারলে খুশি হতাম। কারণ, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মিস্টার মুহিতের মতো ‘তেনাদের’ সংখ্যা গণনা করে শেষ করা যাবে না। এক সময় কর্নেল (অব.) ফারুক খান থেকে শুরু করে মাহবুব-উল আলম হানিফসহ অনেক ‘তেনার’ কথা শুনতে হতো। মাঝখানে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি এবং ‘মখা’ নামে বেশি পরিচিত মহিউদ্দিন খান আলমগীর ধরনের আরো কিছু ‘তেনার’ কথা শুনতে হয়েছে। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের মতো ‘তেনারা’ কখনো ধমক ছাড়া কথা বলেছেন তেমন উদাহরণ তেনাদের কোনো বন্ধুজনও দিতে পারবেন না। ‘আধা লন্ডনী’ মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের-পূর্ব সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। ওদিকে বিগত কিছুদিনের মধ্যে সবাইকে টপকে গেছেন সেতু ও সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। অতি নাটকীয় স্টাইলে কথা বললেও অশিক্ষিত এবং ভালো মানুষের দেশ বলে বেঁচে গেছেন তিনি। বেঁচে গেছেন সক্রিয় কোনো বিরোধী দলকে রাজপথে থাকতে দেয়া হয়নি বলেও। না হলে এবং পরিবেশ গণতন্ত্রসম্মত থাকলে অনেক উপলক্ষেই মানুষের ধাওয়া খেতে হতো তাকে। নাটকীয় স্টাইলের ভাষণ-বিবৃতি তো হাওয়ায় মিলিয়ে যেতোই, মিটে যেতো মানুষকে ‘জ্ঞান’ দেয়ার শখও।

সেদিক থেকে ব্যতিক্রম হিসেবে এখনো টিকে রয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এই ‘তেনার’ কথা বলার জন্যই এবারের নিবন্ধ পরিকল্পিত হয়েছে। এরও কারণ তিনিই সৃষ্টি করেছেন। দু’-চারবার বা বার কয়েক মাত্র নয়। কারণ তথা উপলক্ষ সৃষ্টির ব্যাপারে মিস্টার মুহিত আসলে অতুলনীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে পৌঁছে গেছেন। সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে শেয়ার বাজারে মহা লুণ্ঠন চালানোর পর ৩২ লাখের বেশি সাধারণ বিনিয়োগকারী যখন রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলেন, অনেকে যখন এমনকি আত্মহত্যা পর্যন্ত করছিলেন, তখনও অর্থমন্ত্রী তাদের ‘কিছু লোক’ বলে তামাশা করেছিলেন। তার সে তামাশাকে নির্লজ্জ নিষ্ঠুরতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর মধ্যে কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায়নি। দুঃখ প্রকাশ কিংবা লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাকুক, মিস্টার মুহিত বরং এমনভাবেই কথা বলেছিলেন যেন শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার প্রচেষ্টায় অংশ নিয়ে সাধারণ ও গরীব বিনিয়োগকারীরাই উল্টো মহা অপরাধ করে ফেলেছিলেন! সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেংকারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি, বেসিক ব্যাংকের লুণ্ঠন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি এবং একই ব্যক্তিকে বেআইনিভাবে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার মাধ্যমে জনতা ব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত ঋণ কেলেংকারি পর্যন্ত এমন ডজন-ডজন ঘটনার উল্লেখ করা যায়, যেগুলোর প্রতিটিই বড় ধরনের ক্রিমিনাল বা ফৌজদারি অপরাধ এবং যেসবের কোনো একটির ব্যাপারেই মিস্টার মুহিতকে কার্যকর এবং সুফলপ্রসূ পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। পদ্মাসেতুর ঋণকেন্দ্রিক দুর্নীতির অভিযোগে সারা বিশ্বে যখন নিন্দা-সমালোচনার ঝড় উঠেছিল তখনও মিস্টার মুহিতের চেহারায় এবং বক্তৃতা-বিবৃতিতে লজ্জা-শরমের কোনো বালাই ছিল না। অথচ এ ধরনের যে কোনো একটি ঘটনার জন্যই সভ্য কোনো দেশের হলে সে দেশের অর্থমন্ত্রী মাথা নিচু করে এবং জনগণের কাছে মাফ চেয়ে পদত্যাগ করতেন। কোনো কোনো দেশে অমন অর্থমন্ত্রীকে বিচারের সম্মুখীনও করা হতো। অন্যদিকে মিস্টার মুহিত বরং আরো বেশি দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করে বেড়িয়েছেন। এখনো বেড়াচ্ছেন।

এমন অবস্থার ‘মাজেজা’ সম্পর্কে সম্ভবত কথা বাড়ানোর দরকার পড়ে না। একদিকে তার পারফরমেন্সে ‘মুগ্ধ’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রয়েছেন, অন্যদিকে রয়েছে সেই ‘বন্ধুরাষ্ট্র’, যার কাছ থেকে বন্দর এবং সড়ক ও নৌপথ ব্যবহারের বিনিময়ে সামান্য শুল্ক আদায়ের প্রশ্নেও ‘ছি ছি’ করে তেড়ে উঠেছিলেন মিস্টার মুহিত। দেশপ্রেমিকরা দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন তুললেও মিস্টার মুহিত বলেছিলেন, এটা নাকি ‘সামান্য কয়টা টাকার’ বিষয়! এর মধ্যে নিজের মানসম্মান নষ্ট হওয়ার কারণও আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। সেই ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ যখন বন্দর ও সড়কপথের সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশের কাছে উল্টো ২০ শতাংশ হারে খরচের টাকা দাবি করেছে তখন কিন্তু মিস্টার মুহিতকে কোনো ‘রা’ পর্যন্ত করতে শোনা যায়নি। এতটাই দেশপ্রেমিক অর্থমন্ত্রী তিনি!

মিস্টার মুহিতের ‘যোগ্যতা’ সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য আরো অনেক তথ্যই স্মরণ করিয়ে দেয়া যায়। সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে এবার প্রাধান্যে এসেছে খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য। সম্প্রতি সোনালী ব্যাংকের বার্ষিক ব্যবসায়ী সম্মেলনে তিনি বলে বসেছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পেছনে সরকারেরও ‘দায়’ রয়েছে। মিস্টার মুহিত অবশ্য সম্পূর্ণ দায়ের কথা বলেননি। বলেছেন, ‘কিছুটা দায়’ রয়েছে সরকারের! অর্থমন্ত্রী সম্ভবত মনে করেছিলেন, তার এই স্বীকারোক্তিতে চারদিকে ‘ধন্য ধন্য’ রব পড়ে যাবে। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক ব্যাংকারসহ তথ্যাভিজ্ঞ সকল মহলে উঠেছে নিন্দার ঝড়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর পর্যন্ত বলেছেন, খেলাপি ঋণের বিষয়টি যেহেতু অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেহেতু অর্থমন্ত্রী হিসেবে মিস্টার মুহিতও এর দায় এড়াতে পারেন না। তাছাড়া সরকারের অর্থ সংক্রান্ত সকল ব্যাপারেও প্রধান দায়দায়িত্ব অর্থমন্ত্রীরই। বড় কথা, ক্ষমতায় তো বিএনপি-জামায়াত বা ২০ দলীয় জোট নেই, রয়েছে মুহিত সাহেবদের দল আওয়ামী লীগ। সুতরাং খেলাপি ঋণসহ জাতীয় অর্থনীতির ভালো-মন্দ সকল ব্যাপারেই দায় স্বীকার করতে হবে অর্থমন্ত্রীকেই। সে দায় ‘কিছুটা’ বলে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
কথা শুধু অর্থমন্ত্রীর এই দায় স্বীকারের কারণে ওঠেনি। শেয়ার বাজারের কেলেংকারি থেকে খেলাপি ঋণ ও বিদেশে অর্থ পাচারের মতো এমন অনেক বিষয়ও সম্প্রতি নতুন করে প্রাধান্যে আসতে শুরু করেছে, যেগুলোর কারণে জাতীয় অর্থনীতিই শুধু সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে এসে যায়নি, জনগণেরও নাভিশ্বাস উঠেছে। ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় আগত এ সরকারের আমলে এখনো মোটা চাল কিনতে হচ্ছে ৪৫/৪৬ টাকায়। সরু বা চিকন চালের দাম চলছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে। এমন ভয়ংকর অবস্থার মধ্যেও অর্থমন্ত্রী দিব্যি বলে চলেছেন, মোটা চালের দাম ৪০ টাকা হওয়া উচিত ছিল! কথাটা তিনি বলেছেনও এমনভাবে, যেন সরকার চালাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত এবং ‘তেনারা’ বিরোধী দলে রয়েছেন! যেন জনগণের কষ্টে দরদে একবারে মরে যাচ্ছেন তারা!

অন্যদিকে গণমাধ্যমে কিন্তু মুহিত সাহেবদের কীর্তির পর কীর্তির শুধু নয়, অনেক মহাকীর্তির খবরও প্রকাশিত হচ্ছে। যেমন ৫ ফেব্রুয়ারি দেশের ‘প্রথম’ শ্রেণীর দৈনিকটিতে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক একজন বিশেষ ব্যক্তিকেই সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। মোহাম্মদ ইউনূস বাদল নামের এই ব্যক্তির প্রধান ‘যোগ্যতা’ হলো, তিনি আওয়ামী লীগ করেন। ঋণ যে কোনো ব্যাংক দিতেই পারে, কিন্তু আপত্তি উঠেছে একই ব্যক্তিকে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ দেয়ার কারণে। ওই ব্যক্তি অবশ্য চাতুরি কম করেননি। কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের নামে নেয়ার পরিবর্তে ঋণ নিয়েছেন তিনি নিজের মালিকানাধীন ২২টি পৃথক প্রতিষ্ঠানের নামে।

তথ্যাভিজ্ঞ মহলে আপত্তি উঠেছে দুটি বিশেষ কারণে। প্রথমত, প্রতিষ্ঠানের নাম ২২টি হলেও মালিক যে একই ব্যক্তি সে কথা জানা থাকা সত্ত্বেও জনতা ব্যাংক তাকে পাঁচ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার বেশি ঋণ দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনে বলা আছে, কোনো ব্যাংকই তার মোট মূলধনের সর্বেচ্চ ২৫ শতাংশের বেশি টাকা ঋণ দিতে পারবে না। এই আইন অনুযায়ী জনতা ব্যাংক কাউকে ৭৫০ কোটি টাকার বেশি অর্থ ঋণ দিতে পারে না। কারণ, জনতা ব্যাংকের মোট মূলধন দুই হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে মোহাম্মদ ইউনূস বাদল নামের ‘সৌভাগ্যবান’ আওয়ামী ব্যবসায়ীকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে জনতা ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইন লংঘন এবং নির্দেশনা উপেক্ষা করেছে।

এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, সবকিছুর পেছনে ভূমিকা পালন করেছেন এক বিখ্যাত ‘চেতনাওয়ালা’। নাম তার আবুল বারাকাত। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তাকে আবার সহযোগিতা করেছেন পরিচালনা পরিষদের এমন কয়েকজন সদস্য, যারা ব্যাংকিং-এর ‘অ, আ’ এবং ‘ক, খ, গ’ পর্যন্ত জানেন না। তাদেরও ‘যোগ্যতা’ একই আওয়ামী লীগ করা। গণমাধ্যমের রিপোর্টে কয়েকজনের নামও রয়েছে- ছাত্রলীগের সাবেক নেতা বলরাম পোদ্দার যাদের অন্যতম। অন্যরাও পোদ্দারের মতোই অতি যোগ্য।

এভাবেই দেশের ব্যাংকিং খাতের তথা জাতীয় অর্থনীতির ১২টা বাজিয়েছেন মুহিত সাহেবরা। এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ বিষয় হিসেবে এসেছে মার্কিন ডলারের দাম। কারণ, দেশের মুদ্রা বাজারে হঠাৎ করেই মার্কিন ডলারের মূল্য বাড়তে শুরু করেছে। গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে, ডলারের মূল্য শুধু বাড়ছেই না, বাড়ছেও লাফিয়ে লাফিয়ে। বৃদ্ধির বিষয়টিকে ‘উল্লম্ফন’ হিসেবে চিহ্নিত করে অর্থনীতিবিদসহ বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাস্তবে এরই মধ্যে সে প্রভাব পড়তে শুরুও করেছে। অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরার একটি কৌশল হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশি পরিমাণে ডলার বিক্রি করার পন্থা নিয়েছে। কিন্তু গড় চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি বিক্রি করা হলেও বাজারে এর প্রভাব পড়েনি। বাংলাদেশ ব্যাংক যেখানে প্রতি ডলার ৮২ টাকা ৯০ পয়সা দরে বিক্রি করেছে অন্য ব্যাংকগুলো সেখানে প্রতি ডলারের জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে ৮৪ থেকে ৮৫ টাকা পর্যন্ত আদায় করেছে। তা সত্ত্বেও ডলারের দাম যেমন বেড়ে চলেছে, তেমনি ডলার বিক্রিও হচ্ছে অনেক বেশি পরিমাণে।

হঠাৎ কেন মার্কিন ডলারের দাম বাড়তে শুরু করেছে তার উত্তর দিতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ ও তথ্যাভিজ্ঞরা বলেছেন, অবৈধ পথে টাকার পাচার এমন অবস্থার প্রধান কারণ। চলতি ২০১৮ সাল যেহেতু নির্বাচনের বছর সেহেতু স্বাভাবিক নিয়মেই বিদেশে টাকার পাচার অনেক বেড়ে গেছে। ক্ষমতার সম্ভাব্য রদবদল, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রতিশোধসহ সহিংসতার আশংকায় বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, ঠিকাদার ও অসৎ ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাসহ আরো অনেকেই দেশে টাকা রাখার চাইতে বিদেশে পাচার করে দেয়াকে নিরাপদ মনে করেন। বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা থাকায় এ ধরনের ব্যক্তিরা হুন্ডিসহ বিভিন্ন অবৈধ পন্থার আশ্রয় নিয়ে থাকেন। বর্তমান পর্যায়েও তেমন অবস্থারই সৃষ্টি হয়েছে। আর টাকা যেহেতু পাচার করা যায় না এবং করা গেলেও সেটা যেহেতু লাভজনক ও নিরাপদ নয় সেহেতু সংশ্লিষ্টজনেরা মার্কিন ডলারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। একই কারণে রাতারাতি ডলারের দামও বাড়তে শুরু করেছে। তথ্যাভিজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, পাচারের এই ধারা প্রতিহত না করা গেলে ডলারের দাম তো বাড়তে থাকবেই, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালে একবার ডলারের দাম বাড়তে বাড়তে ৮৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। কিন্তু নির্বাচনের বছর হওয়া সত্ত্বেও ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ডলারের দাম নেমে এসেছিল ৮০ টাকার নিচে। গত বছর, ২০১৭ সালেও ডলারের দাম ছির ৮০ টাকার নিচে। সে একই ডলারের দাম এখন ৮৫ টাকা। বলার অপেক্ষা রাখে না, মাত্র মাস কয়েকের ব্যবধানে একই ডলারের মূল্য ৮৫ টাকা পর্যন্ত উঠে যাওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আশংকাজনক। কথা শুধু এটুকুই নয়, অর্থনীতিবদসহ বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন এবং এমন অনুমান সত্যও যে, নির্বাচনের বছর বলে ডলারের মূল্য আরো বাড়তেই থাকবে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে আমদানি ও রফতানিসহ পণ্যের মূল্যের ওপর। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে বলে পণ্যের মূল্যও বাড়তে থাকবে। অন্যদিকে রফতানি করতে গিয়ে একই ডলারের কারণে ক্ষতির শিকার হবেন ব্যবসায়ীরা।

নির্বাচনের বছরের দোহাই দেয়া হলেও বিষয়টিকে কিন্তু গ্রহণযোগ্য বলা যায় না। কারণ, গত বছরই ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) তার এক রিপোর্টে জানিয়েছিল, টাকা পাচারের ক্ষেত্রে মাত্র এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ৪৮তম অবস্থান থেকে ২৬তম অবস্থানে উঠে এসেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে টাকার পাচার বেড়েছে অবিশ্বাস্য পরিমাণে। বছরে পাচার হয়ে যাওয়া টাকার পরিমাণও চমকে ওঠার মতো। জিএফআই-এর রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর পাচার হয়ে যাচ্ছে গড়ে ৪৪ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা, যার পরিমাণ ৫৫৮ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলারের সমান। ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য-পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে জিএফআই তার রিপোর্টে জানিয়েছিল, আমদানি ও রফতানির উভয় ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে প্রতি বছর ৪৯১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৩৮ হাজার আটশ কোটি টাকা পাচার করা হচ্ছে। জিএফআই-এর রিপোর্টে আরো জানানো হয়েছিল, ‘নির্বাচনের বছর’ ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছিল ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা।

মার্কিন সংস্থার এই রিপোর্টের আলোকে পর্যালোচনা করতে গিয়ে তথ্যাভিজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, এত বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার ফলে দেশের ভেতরে কোনো বিনিয়োগ হয়নি। সৃষ্টি হয়নি চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগও। মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও সংঘাতের কারণেই দেশি-বিদেশি কোনো শিল্প উদ্যোক্তাই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার সাহস পাচ্ছেন না। তথ্যাভিজ্ঞরা প্রসঙ্গক্রমে সরকারের প্রতিহিংসামূলক নীতি ও কর্মকান্ডকে পরিস্থিতির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলোর বিরুদ্ধে সরকার প্রচন্ড দমন-পীড়ন চালিয়ে এসেছে বলেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। তেমন সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে এগিয়ে আসছে নির্বাচনের সময়। সে নির্বাচন ঠিক কোন সরকারের অধীনে হবে এবং নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হতে পারবে কি না- তা নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যেই বেগম খালেদা জিয়াকে দন্ড দিয়ে কারাগারে ঢোকানো হয়েছে। এসব কারণেও ব্যবসা ও বিনিয়োগে আগ্রহীদের মধ্যে ভীতি-আতংক বেড়ে চলেছে। তারা তাই দেশ থেকে অবৈধ পথে পাচার করছে লক্ষ হাজার কোটি টাকা। ফলে শিল্প-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির প্রতিটি খাতে সংকট ক্রমাগত আরো মারাত্মক হয়ে উঠছে।

অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলা দরকার, টাকার পাচার বন্ধ করার পাশাপাশি পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে হলে সরকারের উচিত অবিলম্বে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বন্ধ করে দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। সব মিলিয়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা দরকার, কাউকেই যাতে অবৈধ পথে টাকা পাচার করার কথা চিন্তা না করতে হয়। একই কারণে টাকা পাচারকারীদের চিহ্নিত করা এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনসঙ্গত ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এ ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হলেই টাকার পাচার যেমন কমবে তেমনি কমে আসবে মার্কিন ডলারের মূল্যও। সরকারকে বুঝতে হবে, ডলারের মূল্যের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ দেশের অর্থনীতি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছে। সুতরাং মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধির রাশ অবশ্যই টেনে ধরতে হবে।
শেষ করার আগে আবারও মিস্টার মুহিতের সেই স্বীকারোক্তি প্রসঙ্গ। লক্ষ হাজার কোটি টাকার শেয়ার কেলেংকারিতে ‘কিছু লোকের’ সর্বনাশ হওয়া থেকে খেলাপি ঋণ এবং সবশেষে মার্কিন ডলারের অবিশ্বাস্য মূল্যবৃদ্ধি পর্যন্ত কোনো তথ্যই কিন্তু মুহিত সাহেবদের তথা আওয়ামী লীগ সরকারের সফলতার দাবিকে সমর্থন করে না। ওদিকে রয়েছেন আবুল বারাকাত এবং কেলেংকারি ও জালিয়াতির অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে কেটে পড়া ‘চেতনাওয়ালা’ পর্যন্ত আরো অনেকেই- যাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেননি মিস্টার মুহিত এবং তাদের সরকার। সে অর্থমন্ত্রীই আজকাল নিজেদের সরকারের ওপর ‘কিছুটা’ দায় চাপানোর নাটক করে সুকৌশলে সম্পূর্ণ দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার কসরত করছেন। ১০ টাকার অঙ্গিকার পাশ কাটিয়ে বলছেন, মোটা চালের দাম ৪০ টাকা হওয়া উচিত ছিল! এভাবে সব মিলিয়েই তারা নির্লজ্জতার সীমা ছাড়িয়ে গেছেন। একই কারণে অর্থনীতিবিদসহ সচেতন সকল মহলে দাবি উঠেছে, দেশ ও জনগণকে বাঁচাতে হলে মিস্টার মুহিতের মতো ‘তেনাদের’ আসলে বিদায় করা দরকার। কিন্তু এত ব্যর্থতা ও ক্ষতিকর নীতি ও কর্মকান্ডের পরও অসহায় জনগণের করার কিছুই নেই।

http://www.dailysangram.com/post/318764