১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, রবিবার, ৯:৫৮

প্রশ্ন ফাঁসের মিছিল হোতারা অধরা

এসএসসি পরীক্ষায় টানা ৬ষ্ঠ দিনের মতো গতকালও গণিতের প্রশ্ন ফাঁস হলো। পরীক্ষা শুরুর প্রায় দেড় ঘণ্টা আগে ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন সমাধান করার সময় গতকাল কয়েকজনকে আটক করা হয়। তবে প্রশ্নফাঁসের মূল হোতারা রয়েছে অধরা। যদিও শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কেরামত আলী দাবি করেছেন, এবার এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস হয়নি। এই অবস্থায় আগামীকাল অনুষ্ঠিত হবে এসএসসির তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের পরীক্ষা।

প্রশ্নফাঁসের চক্রের একাধিক ফেসবুক গ্রুপে চলছে কার আগে কে প্রশ্ন দিতে পারবে, তার প্রতিযোগিতা। আগের পরীক্ষার প্রশ্ন সবার আগে দিয়েছে, এমন প্রমাণ দেখিয়ে দিনরাত অসংখ্য আইডি থেকে বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে প্রশ্নফাঁসের। মন্ত্রণালয়, বোর্ড আর পুলিশের কাছে তথ্য দিয়েও বন্ধ করা যাচ্ছে না প্রশ্নফাঁস। অনেকটা নির্বিঘ্নে প্রশ্ন ফাঁস চালিয়ে যাচ্ছে এ চক্রটি। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্তরিকতা নিয়ে আবারো প্রশ্ন উঠেছে। বিটিআরসি ও পুলিশের সঙ্গে চরম সমন্বয়হীনতায় এ প্রশ্ন ফাঁস রোধ করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন খোদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। গতকাল পরীক্ষা শুরুর প্রায় দেড় ঘণ্টা আগে গণিতের ‘খ-চাঁপা’ সেটের প্রশ্ন হোয়াটসঅ্যাপের একটি গ্রুপে পাওয়া যায়। যা অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। এর আগে বাংলা এবং ইংরেজি দুটি করে পত্র এবং ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। গতকালের পর টানা ছয়টি পরীক্ষার প্রশ্নই ফাঁস হলো। এ নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে অভিভাবকদের মাঝে। পরীক্ষা হলে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন সমাধানের সহযোগিতার জন্য কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। যেসব ফেসবুকে গ্রুপ বা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ফাঁস করছে তাদের কাউকে ধরতে পারেনি আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। এ ব্যাপারে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার মানবজমিনকে বলেন, এক ঘণ্টা আগে প্রশ্নফাঁস হওয়া মানে পরীক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ না কেউ এটা করছেন। আমরা চেষ্টা করছি এই গ্রুপগুলোকে ধরার। তাদের ধরতে একটি কমিটি কাজ করছে। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়সহ আমরাও তদারকিতে আছি। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষার ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না বলেও জানান তিনি। তার মতে, শিক্ষার্থীরা আধা ঘণ্টা আগে পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়। এরমধ্যে প্রশ্ন পেলেও তেমন লাভ নেই।

গতকাল এসএসসির গণিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে রাজশাহী, যশোর, গাজীপুর ও শেরপুরে ৪ জনকে আটক করেছে পুলিশ। জব্দ করা হয়েছে ৬টি মোবাইল ফোন। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রাজশাহীর পিএন গার্লস স্কুলের সামনে থেকে প্রশ্নপত্রসহ এক কলেজছাত্রীকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন অভিভাবকরা। প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে তার জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার আমীর জাফর। এদিকে, প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে যশোরে মনিরুল নামে এক যুবককে আটক করা হয়। শেরপুরে আটক করা হয় সোলায়মান নামের আরেক যুবককে। জব্দ করা হয় তার মোবাইল ফোন। এ ছাড়া পরীক্ষা শুরুর আগে বগুড়ায় দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে থেকে গণিতের প্রশ্নসহ ৫টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।

এদিকে গাজীপুরের শ্রীপুরে এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে কেন্দ্রের বাইরে কেন্দ্র সহকারী সচিবের কাছে প্রশ্নপত্র পাওয়ায় তাকে আটক করে পুলিশ। তার নাম আমজাদ হোসেন। তিনি উপজেলার আলহাজ ধনাই ব্যাপারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও এসএসসি পরীক্ষার মাওনা কেন্দ্রের সহকারী সচিব। ওই কেন্দ্রের সচিব শাহজাহান সিরাজ বলেন, প্রশ্নসহ শিক্ষককে আটক করা হয়েছে। তাকে পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সকাল ১০টা থেকে গণিত পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে লিখিত প্রশ্নপত্রের বান্ডিল থেকে একটি প্রশ্ন সরিয়ে নিজের পকেটে রেখে বের হওয়ার সময় তিনি আটক হন। সকাল ৮টা ৫৯ মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপের ঝঝঈ ফ্রি প্রশ্নের দোকান নামের একটি গ্রুপে গণিতের বহু নির্বাচনী অভীক্ষার ‘খ’ সেটের প্রশ্নপত্রটি পাওয়া যায়। এর সঙ্গে ছিল হাতে লেখা উত্তরপত্র। ফারহান আদনান নামের একটি আইডি থেকে এই প্রশ্নপত্রটি গ্রুপে দেয়া হয়। এ সময় উত্তরপত্রও দেয়া হয় ওই আইডি থেকে। এরপর ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্নপত্রটি ছড়িয়ে পড়ে। পরীক্ষা শেষে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া প্রশ্নের সঙ্গে ওই প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া গেছে।

এর আগে ১লা ফেব্রুয়ারি বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্ন একই কায়দায় ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া যায়। বাংলা প্রথম পত্রের বহুনির্বাচনী অভীক্ষার ‘খ’ সেট পরীক্ষার প্রশ্নও ফেসবুকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগেই ফেসবুকে পাওয়া যায় সে প্রশ্ন। ৩রা ফেব্রুয়ারি সকালে পরীক্ষা শুরুর প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের নৈর্ব্যক্তিক ‘খ’ সেটের উত্তরসহ প্রশ্নপত্র পাওয়া যায় ফেসবুকে। যার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। আর ৫ই ফেব্রুয়ারি পরীক্ষা শুরুর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে সকাল ৮টা ৪ মিনিটে ইংরেজি প্রথম পত্রের ‘ক’ সেটের প্রশ্ন ফাঁস হয়। যার সঙ্গে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া যায়। ৭ই ফেব্রুয়ারি পরীক্ষা শুরুর অন্তত ৪৮ মিনিট আগে সকাল ৯টা ১২ মিনিটে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ‘খ’ সেটের প্রশ্নপত্রটি হোয়াটসঅ্যাপের একটি গ্রুপে পাওয়া গেছে, যা অনুষ্ঠিত হওয়া পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে। একইভাবে ৮ই ফেব্রুয়ারি ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার প্রশ্নপত্রটিও পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগে পাওয়া যায়।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=104515