১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ১০:২২

কোটি টাকার রাস্তা কাজে আসে না

লাঙ্গলবন্দ সেতু থেকে নয়াগাঁও পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষে মাটির রাস্তা। পুরো বছর এটি কেউ ব্যবহার করে না। ছবি: প্রথম আলোনারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় ২০১৬ সালের প্রথম দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষে একটি কাঁচা রাস্তা নির্মাণ হয়। বর্ষাকালে রাস্তাটি থাকে পানির নিচে। শুষ্ক মৌসুমে থাকে পরিত্যক্ত।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, ওই রাস্তা নির্মাণ সরকারি টাকার অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, হিন্দুধর্মাবলম্বীরা যাতে ব্রহ্মপুত্র নদে স্নানের জন্য আসা-যাওয়া করতে পারেন, সে জন্য ওই রাস্তা নির্মাণ করা হয়। অথচ বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দ বাজারের ঘাটে যাওয়ার জন্য পৃথক পাকা সড়ক রয়েছে। তাই সোনারগাঁয়ের এই কাঁচা রাস্তা কোনো কাজে আসছে না।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানায়, নারায়ণগঞ্জের বন্দরের লাঙ্গলবন্দ বাজারের ঘাটে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদে প্রতিবছর চৈত্রের শুক্লা তিথিতে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা স্নান করতে আসেন। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা ব্রহ্মপুত্র নদের যে স্থানে স্নান করেন, তার উল্টো পাশে সোনারগাঁ উপজেলা। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে স্থানীয় প্রশাসন সোনারগাঁয়ের লাঙ্গলবন্দ সেতু থেকে কালীগঞ্জ ঘাট হয়ে নয়াগাঁও পর্যন্ত নদের তীর ঘেঁষে ওই কাঁচা রাস্তা নির্মাণের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ১২ নভেম্বর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর সড়ক নির্মাণের জন্য ৩০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করে। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ওই সময় প্রতি টন চালের সরকারি দাম ছিল ৩৬ হাজার ৩৩৫ টাকা ৫০ পয়সা। সে হিসাবে ৩০০ মেট্রিক টন চালের দাম ১ কোটি ৯ লাখ ৬৫০ টাকা।

সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ বরাদ্দ হওয়ার পর ২০১৬ সালের ১০ জানুয়ারি রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। একই বছরের ১৯ মার্চ কাজ শেষ হয়। ৭৩০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৬ দশমিক ৫ মিটার প্রস্থের এই রাস্তাকে দুটি অংশে ভাগ করে দুজনকে প্রকল্প কমিটির সভাপতি নির্বাচন করা হয়। তাঁরা হলেন স্থানীয় সনমান্দি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য জয়নাল আবেদীন ও মোগরাপাড়া ইউপির সদস্য আনোয়ার হোসেন।
স্থানীয় লোকজন জানান, রাস্তাটি নির্মাণ করার সময় এলাকাবাসী ও পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন নদে রাস্তা নির্মাণ না করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানায়। তবে কোনো কাজ হয়নি। রাস্তাটি নদের একাংশ দখল করে করা হয়। এ ছাড়া ৭৩০ মিটার দৈর্ঘ্যের এই রাস্তায় বিপুল পরিমাণ ব্যয়কে সরকারি অর্থের অপচয় বলে মনে করছেন তাঁরা। নয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম জানান, এই সড়কে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছে সরকার, তার অর্ধেক অর্থও ব্যয় করা হয়নি।

জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আমরা ছিলাম নামমাত্র সভাপতি। আমাদের হাত দিয়ে কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি। উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা আমাদের স্বাক্ষর নিয়ে তাঁরাই কাজটি বাস্তবায়ন করেছিলেন। এখানে অর্থ লুটপাট হয়ে থাকলে তাঁরাই করেছেন। আমরা এর সঙ্গে জড়িত নই।’
গত বছরের অক্টোবরে সরেজমিনে দেখা যায়, বর্ষার পানি কমে নদের তলদেশে চলে গেছে। তবু রাস্তার পানি সরেনি। গতকাল শুক্রবার দেখা যায়, সড়কটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। কেউ এই রাস্তা ব্যবহার করেন না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
ইলিয়াসদি গ্রামের নুর মিয়া বলেন, ‘নদ দখল করে সরকারি অর্থ লুটপাট করার জন্যই এই রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এই সড়ক আমাদের কোনো কাজেই আসছে না। বর্ষা ছাড়াও শুষ্ক মৌসুমেও এই সড়ক ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এত টাকা কোথায় গেল।’

পরিবেশবাদী সংগঠনের (নির্ভীক) প্রধান সমন্বয় এ টি এম কামাল বলেন, ‘প্রশাসন অপরিকল্পিতভাবে সরকারি অর্থ লুটপাট করে ব্রহ্মপুত্র নদকে গলাটিপে হত্যা করেছে। অবিলম্বে বিষয়টির তদন্ত করা উচিত।’
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নুর নবী বলেন, ‘এই রাস্তা নির্মাণে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি। উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অনুমোদন নিয়েই রাস্তাটি করা হয়েছিল। রাস্তাটি সচল করার জন্য আরও উঁচু করা প্রয়োজন। এ জন্য আমরা এই রাস্তায় আরও অর্থ বরাদ্দ করার জন্য শুষ্ক মৌসুমে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিলাম। মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ বরাদ্দের অনুমোদন দেওয়া হয়নি।’
ইউএনও শাহীনুর ইসলাম বলেন, ‘আমি যোগদানের আগে রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়। রাস্তাটি যদি অপরিকল্পিতভাবে ব্রহ্মপুত্র নদ দখল করে নির্মাণ করা হয়ে থাকে, তবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 

http://www.prothomalo.com/bangladesh/article/1428136