১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ১০:১৯

বিদ্যুৎ খাতে দায়মুক্তি আইন দিয়ে অনেক প্রকল্পের দুর্নীতি ও অনিয়ম আড়াল করা হচ্ছে

আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাতে ১৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে। যা গত দশ বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সঞ্চালন লাইন, উপকেন্দ্র স্থাপনে এই বিনিয়োগ হবে। এর মধ্যে বেশিরভাগই বিদেশি বিনিয়োগ। বাকীটা নিজস্ব অর্থে। দেশে চলমান বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে এই অর্থের হিসাব জানা গেছে। টাকার হিসেবে এ বিনিয়োগের পরিমাণ ১লাখ ২০ হাজার ৩৩০ কোটি টাকার মতো।

বিদ্যুৎ সচিব ড. আহমদ কায়কাউস সম্প্রতি বলেছেন, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এসব বিনিয়োগের বেশিরভাগেরই প্রতিশ্রতি নিশ্চিত হয়েছে। ভবিষ্যতের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে এই বিনিয়োগ খুবই জরুরি। এতে বাংলাদেশে আর্থসামাজিক উন্নতি হবে।
তবে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি না ঘটিয়ে ব্যয়বহুল বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিশাল ঋণ ও মহাবিপদের ঝুঁকি সত্ত্বেও রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। জাতীয় কমিটিসহ বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে যেসব প্রশ্ন তুলেছেন তার কোন যুক্তিসঙ্গত গ্রহণযোগ্য উত্তর দিচ্ছে না সরকার।’
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, এই বিনিয়োগের বিদেশি অংশের প্রতিশ্রতি প্রায় পুরোটাই নিশ্চিত হয়েছে। আর সরকারিভাবে প্রতিবছর বাজেটে পর্যায়ক্রমে বরাদ্দ রেখে খরচ করা হবে।
সূত্র বলছে, বিদ্যুৎ খাতে যে বিনিয়োগ আসছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরমাণু বিদ্যুতে। রূপপুরের পরমাণু বিদ্যুতে। রাশিয়া এই অর্থ বিনিয়োগ করছে। এছাড়া ভারত, চীন ও জাপান আলাদা আলাদা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিনিয়োগ করছে। এই চার দেশের বিনিয়োগে দেশের সবচেয়ে বড় বড় চারটে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। এর প্রত্যেক কেন্দ্রের কাজ চলছে।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য এখন সব থেকে ভালো পরিবেশ। বাংলাদেশে এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বিনিয়োগের পরিবেশে ভালো। এজন্য বিদেশিরা আগ্রহ দেখাচ্ছে বেশি। বিদ্যুতের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। সেই চাহিদা পূরণের জন্য কাজ করা হচ্ছে। ফ্রান্স, ইউরোপ, চায়না, জার্মান সিঙ্গাপুর থেকে বিনিয়োগকারিরা বাংলাদেশে বিদ্যুৎখাতে বিনিয়োগ করছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে খরচ হবে এক লাখ ১৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা (১৪ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার)। এর মধ্যে রাশিয়া বিনিয়োগ করবে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা (১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার)। আর বাকীটা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বিনিয়োগ করা হবে।

রামপালে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হচ্ছে ভারতের অর্থায়নে। বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (বিআইএফপিসিএল) এটা করছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে।
পটুয়াখালীর পায়রায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিনিয়োগ করছে চীন। বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি এটা করছে। এখানেও বিনিয়োগ হবে দুই বিলিয়ন ডলার। ঋণচুক্তি হয়েছে। দ্রুত সময়ে এই অর্থ ছাড় হবে।
মাতারবাড়িতে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিনিয়োগ করছে জাপান। এতে খরচ হবে চার দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া জার্মানি, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সৌদিআরবসহ অনেক দেশ বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, বর্তমানে মোট ১৩ হাজার ৭৭১ মেগাওয়াট ক্ষমতর ৪৭টা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন আছে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চলতি বছর থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে উৎপাদনে আসবে। এখন দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা আছে ১৬ হাজার ৪৬ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ চাহিদার সময় গড়ে উৎপাদন হচ্ছে আট হাজার মেগাওয়াট।

গত ৯ বছরে (২০০৯-২০১৭) বিদ্যুৎখাতে ৮ দশমিক ৯ বিলিয়র ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। এরমধ্যে সরকারি খাতে ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার এবং বেসরকারি খাতে ৪ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে।
তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহবায়ক প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ বলেন, ‘দায়মুক্তি আইন দিয়ে এসব প্রকল্পে দুর্নীতি ও অনিয়ম আড়াল করা হচ্ছে। তা করতে গিয়ে সব প্রকল্পই দুর্নীতির এক একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলার পথ বন্ধ করতে, জনমত দমন করতে প্রতিটি প্রকল্প ঘিরে তৈরি করা হয়েছে নিপীড়নের জাল। দেশি-বিদেশি কিছু গোষ্ঠী এতে লাভবান হলেও বাংলাদেশের প্রাণপ্রকৃতি পরিবেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদী অপূরণীয় ক্ষতি এবং অর্থনৈতিক বোঝা তৈরি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘কম ব্যয়ে, পরিবেশ সম্মতভাবে যে বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান সম্ভব তা দেশের বিশেষজ্ঞ এবং জাতীয় কমিটির বিকল্প প্রস্তাবনায় দেখানো হয়েছে। অথচ এ বিষয়ে সরকার নীরব থেকে দেশবিনাশী বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রেখে চলেছে।

http://www.dailysangram.com/post/318549