১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ১০:১৬

কুরআনের ভাষা কি মুসলিমদের কাছে বিদেশি?

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : কুরআন আরবি ভাষায় নাযিল হয়েছে। এর কারণ বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (স.) ছিলেন আরব। আরবি ভাষা না হলে কুরআন ধারণ করা হয়তো নবী (স.) এর পক্ষে কঠিন হতে পারতো। অবশ্য মহান আল্লাহ ইচ্ছে করলে অন্য ভাষাও নবীজী (স.) এর জন্য সহজ করে দিতে পারতেন।

কুরআন শিক্ষা মুসলিমদের জন্য ফরজ অর্থাৎ অত্যাবশ্যক। কুরআন যেহেতু আরবি ভাষায় নাযিল হয়েছে, তাই এ ভাষা শেখাও মুসলিমদের জন্য ফরজ হয়ে গেছে। কুরআনের অনুবাদ পড়ে হয়তো এর সারমর্ম অনুধাবন করা যেতে পারে। কিন্তু এর ভাবভঙ্গি এবং মৌলিকতা পুরোপুরি উপলব্ধি করা অসম্ভব।
কুরআনের এমন কিছু শব্দ রয়েছে, যেগুলোর অনুবাদ কোনও ভাষাতেই যথাযথভাবে হয় না। আমি কয়েকটির উদাহরণ দিতে চাই। যেমন: আল্লাহ্, কুরআন, দীন, সালাত, ঈমান, সিয়াম, হজ্ব। কোনও ভাষায়ই সঠিকভাবে অনুবাদযোগ্য নয় এমন আরও অনেক শব্দ আছে। বরং অনুবাদের চেষ্টা করলে তা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। কাজেই কুরআনের মৌলিক শব্দগুলো অক্ষুণœ রাখবার চেষ্টা করা সচেতন মুসলিমদের ঈমানি দায়িত্ব বলে গণ্য করা যেতে পারে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, অন্যান্য ভাষার মতো কুরআনের ভাষা আরবিকেও বিদেশি ভাষা আখ্যা দিয়ে একটি মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে তা বর্জনের আয়োজন করছে। এই মহলটি আল্লাহ্, দীন, ঈমান, সালাত, সিয়াম ইত্যাদি কুরআনের মৌলিক শব্দসমূহ পরিবর্তন করে স্রষ্টা বা সৃষ্টিকর্তা, ধর্ম, বিশ্বাস, নামায, রোযা, উপবাস প্রভৃতি শব্দমালা প্রতিস্থাপন করতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ কুরআনের উল্লিখিত মৌলিক শব্দমালা বুঝতে বা অনুধাবন করতে কোনও মুসলিমেরই সমস্যা নেই। এমনকি নিরক্ষর হলেও অসুবিধে হয় না। তাহলে আল্লাহ্কে স্রষ্টা, সৃষ্টিকর্তা বা প্রভু; দীনকে ধর্ম, ঈমানকে বিশ্বাস, সালাতকে নামায, সিয়ামকে রোযা বা উপবাস বানানোর কসরত কেন? আসলে এসবই উদ্দেশ্যমূলক। মুসলিমদের কীভাবে মৌলিকতা তথা দীনের মূল থেকে দূরে সরানো যায়, তারই আয়োজন ব্যতীত কিচ্ছু নয়। এই ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে জড়িয়ে পড়ে অনেক আলেমও নির্দ্বিধায় আল্লাহ্কে স্রষ্টা বা সৃষ্টিকর্তা, দীনকে ধর্ম, সালাতকে নামায বা উপাসনা, রোযাকে উপবাস বলতে শুরু করেছেন। এই প্রবণতা যে কতটা আত্মবিনাশী তা উপলব্ধি করতেও যেন অক্ষম তাঁরা। কাজেই সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করা মুসলিমদের জন্য খুব জরুরি।
এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে, কুরআনের ভাষা আরবি হলো মুসলিমদের নিজস্ব ভাষা। এটা অনেকের কাছে বিদেশি ভাষা মনে হলেও আসলে কিন্তু তা নয়। কিন্তু একশ্রেণির নামধারী মুসলিম যেমন আরবিকে বিদেশি ভাষা বলে দূরে ঠেলে দিচ্ছে, তেমনই বাইরেরও কেউ কেউ বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে তাদের কুরআন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে নানা অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

এক শ্রেণির মানুষ নিজেদের মুসলিম বলে পরিচয় দেন। কিন্তু কুরআন ছুঁয়ে দেখেননি ওতে কী লেখা আছে। কাদের জন্য এ কিতাবখানা। এর উদ্দেশইবা কী? এমন আত্মভোলা ও আত্মঘাতী মুসলিমরাই ইবাদতকে উপাসনা, সালাতকে প্রার্থনা, দীনকে ধর্ম বলতে আগ্রহী। শুধু তাই নয়, কোলকাতার বাবুদের দেখাদেখি কুরআনের ভাষাকে বিদেশি বলে দূরে ঠেলে দেবার জন্য মরিয়া অনেক বাঙালি মুসলিমও। দুর্ভাবনা এখানেই।
হ্যাঁ, কুরআনের ভাষা আরবি না হলে তা আমাদের জন্য বিদেশি ভাষা হতেই পারতো। এর প্রতি আমাদের কোনও মমত্ববোধ বা ভালোবাসার বিষয় ছিল না। উর্দু, তুর্কি, হিন্দি, ফার্সি, ইংরেজি যেমন, তেমনই আরবিকেও আমরা ভাবতে পারতাম। কিন্তু আরবি কুরআন এবং ইবাদতের ভাষা হওয়াতে এর সঙ্গে মুসলিমদের ঈমানি সম্পর্ক জড়িত। আরবি মুসলিমদের ঈমানের ভাষা। ইবাদতের ভাষা। সালাতে সূরা-কালাম পড়তে হয় আরবিতে। বাংলা বা অন্য কোনও ভাষায় তা পড়বার উপায় নেই। আছে কি? এছাড়া পবিত্র কুরআন পাঠও মুসলিমদের একটা অন্যতম ইবাদত।

কুরআনের ভাষায় একটা অলৌকিকতা বা মোজেজা আছে যা অন্য ভাষায় নেই। অবর্ণনীয় সুর ও ছন্দে পুরো কুরআন পাঠ করা যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুগ্ধ হয়ে মানুষ শোনেন। এছাড়া শিশুনারীসহ কোটি কোটি মানুষ পুরো কুরআন শরীফ হিফ্জ করেছেন। এ ধারা চলছে অব্যাহতভাবে। চলবে কিয়ামত অবধি। এমন নযির আর আছে কি? ১০/২০ পাতার কোনও গ্রন্থ কি হুবহু পৃথিবীতে কারুর মুখস্থ আছে? নেই।
কুরআনের ভাষা আরবি হলেও অন্য ভাষায় চর্চা করা যাবে না এমন কেউ বলেননি। সবাই নিজের মাতৃভাষায় পবিত্র কুরআনের মর্মার্থ অবশ্যই বুঝতে বা চর্চা করতে পারবেন। তবে আরবিভাষা উপেক্ষা করে বা এর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে নয়। যারা কুরআনের ভাষা তথা আরবিকে বিদেশি বলে দূরে ঠেলে দিয়ে কুরআনের মূল পাঠ থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে রাখতে চায় তারা আল্লাহ্ এবং মুসলিমদের প্রকাশ্য দুশমন ও কুরআন বিদ্বেষী। এদের উদ্দেশ্য সুদূরপ্রসারী এবং ঈনানবিনাশী। এদের সম্পর্কে মুসলিমদের সাবধান থাকতে হবে।
ইসলাম ও কুরআনবিদ্বেষীরা সংখ্যায় যতোই বিপুল এবং অর্থবিত্তে প্রতাপশালী হোক না কেন, কুরআনের বিস্তার ঠেকাবার শক্তি তাদের নেই। আল্লাহ্র কালাম স্বমহিমায় বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে। দিনদিন এর অনুসারীর সংখ্যা বাড়ছে অব্যাহত গতিতে।

কুরআন সর্বশেষ আসমানি কিতাব। হযরত মুহম্মদ (স.) এরপর যেমন আর নবী আবির্ভূত হবেন না, তেমনই আর কোনও আসমানি কিতাবও নাযিল হবে না। তাই কুরআনের ভাষা সহজ-সরল এবং প্রায় সব মানুষের কাছে সহজবোধ্য। এজন্য কুরআন শিশুরাও মুখস্থ করতে সক্ষম। পৃথিবীতে আর একটিও কিতাব নেই যা মানুষ কুরআনের মতো সহজে কণ্ঠস্থ করতে পারে। এও মহান আল্লাহ্র একটি বিশেষ কুদরত বৈকি।
এক তথ্যে প্রকাশ, পৃথিবীতে এখন ৬ কোটির অধিক হাফেজে কুরআন আছেন। এসংখ্যা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে অনেকে অন্ধ আছেন। আবার লাখ লাখ শিশু কুরআনের কোনও অর্থ না বুঝেও মুখস্থ করেছে। এও কি কম আশ্চর্যের বিষয়?

আগেই উল্লেখ করেছি, কুরআন শুধু মুসলিমদের জন্য নাযিল হয়নি। সব বিশ্বাসবোধ ও আদর্শের মানুষের মুক্তির পথনির্দেশনা রয়েছে এতে। এমন একখানা কিতাবের ভাষাকে যারা বিদেশি বলে আখ্যা দেয় তারা কেবল জ্ঞানপাপী নয়, দুর্ভাগাও।
কুরআন কোনও বিজ্ঞানগ্রন্থ নয়, কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে অনেক আলোচনা রয়েছে। সৃষ্টিজগত সম্পর্কেও আলোচনা আছে এন্তার। মানুষে মানুষে সামাজিক বন্ধন, মানুষের প্রতি মানুষের করণীয়, মা-বাবা ও প্রতিবেশীর হক এসব বিষয়েও আলোচনা করা হয়েছে কুরআনে। এমনকি কিয়ামত ও মানুষের পরকালীন পরিস্থিতি কী হবে তারও বিবরণ এতে রয়েছে। শুধু তাই নয়, মানুষসহ সমগ্রসৃষ্টির জীবনধারণ কীভাবে হবে সেকথাও বলা আছে। এমন আদর্শ জীবনশৈলীর ভাষাকে যারা বিদেশি বলে তাদের মতো গর্দভ আর কে?
যাই হোক, পবিত্র কুরআন এমন এক কিতাব যার শুরুতেই বলা হয়েছে, এতে কোনও ভুলত্রুটি নেই। উল্লেখ্য, কুরআন নাযিলের প্রায় দেড় হাজার বছর হতে চলেছে। এর মধ্যে অনেকে এতে তন্নতন্ন করে ত্রুটি খুঁজে ফিরেছেন। কিন্তু সামান্যতম কোনওরকমের খুঁত খুঁজে পাননি। বরং এর ত্রুটি খুঁজতে এসে নিজেরাই হতবিহ্বল হয়ে আল্লাহ্র কাছে সঁপে দিয়ে পড়েছেন মহাবিপ্লবের বাণী কালেমা তাইয়্যেবা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্।

 

http://www.dailysangram.com/post/318516