৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:০৪

অবিরাম প্রশ্নফাঁস

পরীক্ষা মানেই প্রশ্নফাঁস। এবারো এর ব্যতিক্রম হয়নি। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষায় গতকাল পর্যন্ত চারটি বিষয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি পরীক্ষার আগে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটেছে।
গতকাল ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষা শুরুর আধাঘণ্টা আগে সকাল সাড়ে ৯টায় মাদারীপুর সদর উপজেলার মস্তফাপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে জোবাইদুল ইসলাম নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে আটক করে জেলা প্রশাসন। তার মোবাইলে পাওয়া যায় ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের মূল প্রশ্ন। পরীক্ষার পর দেখা যায় তার মোবাইলে থাকা প্রশ্নের সাথে পরীক্ষায় দেয়া প্রশ্নের হুবহু মিল রয়েছে।

জোবাইদুল বাসে বসেই বিভিন্ন জনের মোবাইলে প্রশ্নপত্র পাঠানোর সময় জনতার হাতে ধরা পড়ে। পরে জেলা প্রশাসন খবর পেয়ে তাকে আটক করে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি সোমবার অনুষ্ঠিত হয় ইংরেজি প্রথমপত্রের পরীক্ষা। ওই দিন মানিকগঞ্জ সিঙ্গাইর পাইলট উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে পরীার আগে ফ্রেন্ডস কোচিং সেন্টারের শিক রুবেল হোসেন ও শরীফুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়।
তাদের মোবাইলে পাওয়া যায় ইংরেজি প্রথমপত্রের প্রশ্ন। পরীা শুরু হলে দেখা যায়, মোবাইলে থাকা প্রশ্নের ইংরেজি প্রথমপত্রের সাথে হুবহু মিল রয়েছে।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার ছিল বাংলা দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষা। ওই দিন ফরিদপুরের ভাঙ্গায় পরীা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে এক পরীার্থী ও তার বড় ভাইকে আটক করা হয়। তাদের ট্যাবে থাকা প্রশ্নের সাথে পরীক্ষায় দেয়া প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া যায়।
গত ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা প্রথমপত্রের মাধ্যমে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। প্রথম দিনই প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলা প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ আসতে থাকে। পরে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সাথে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে হুবহু মিল পাওয় যায়।
পরীক্ষা মানেই প্রশ্নফাঁস এটি নিয়মিত বিষয় হলেও এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি এবার ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাহলো রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে প্রশ্নফাঁস করা হচ্ছে। কারোর যেন কিছু করার নেই। সবাই যেন অসহায় এ চক্রের কাছে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রশ্নফাঁসের সাথে সাথে এসব অপরাধী ঘোষণা দিচ্ছে আগের ফাঁস হওয়া প্রশ্ন শতভাগ মিলেছে। এবারও শতভাগ মিলে যাবে। প্রতি প্রশ্নপত্রের জন্য ৫০০ টাকা অগ্রিম পাঠাতে হবে। অনেকে আবার ঘোষণা দিচ্ছে বিনামূল্যে ১০০ জনের মধ্যে প্রশ্ন বিতরণ করা হবে। গত বুধবার ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষার বেশ আগে ফাঁসকারী চক্র ঘোষণা দেয় প্রশ্নফাঁস করা হবে এবং সত্যি সত্যিই প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে পরীক্ষার আগে।
ফেসবুকে একটি গ্রুপের একজন ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষার আগে লিখেছে ইংরেজি প্রথমপত্র প্রশ্ন সবার আগে দিলাম। আবারো একটা প্রমাণ দিলাম। ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্ন লাগলে ইনবক্সে ৫০০ টাকা লাগবে। অবশ্যই অগ্রিম করতে হবে। এভাবে প্রকাশ্যে বিকাশ নম্বর দিয়ে টাকা লেনদেন এবং প্রশ্ন সরবরাহের ঘটনা ঘটছে।

প্রশ্নফাঁসের উৎসব
প্রশ্নফাঁস মহামারি আকার ধারণ করেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয় এসএসসি পরীক্ষা। তখনো প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে। এরপর গত বছর শেষের দিকে অনুষ্ঠিত জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়। এরপর গত বছর নভেম্বরে অনুষ্ঠিত পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়। পরিস্থিতি এখন এমন নৈরাজ্যকর পর্যায়ে গড়িয়েছে যে, গত বছর শেষে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর প্রশ্নফাঁস হয় দেশের বিভিন্ন জেলায়। এ নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। প্রশ্নফাঁসে বিপন্ন শিক্ষাব্যবস্থার করুণ চিত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে সবার সামনে। একই সাথে বের হয়ে পড়ে সামাজিক অবক্ষয় আর নৈতিক অধপতনের চিত্র। প্রশ্নফাঁস যেন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের সমাপনী পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস নামক এক ভয়াবহ নৈরাজ্যের মুখোমুখি হয় দেশ। তারপর থেকে বিভিন্ন স্কুলের পরীক্ষায়ও নিয়মিত প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটতে থাকে। প্রশ্নফাঁস নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হওয়ায় পাবলিক পরীক্ষা এলেই দুশ্চিন্তা, হতাশা আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে। বিশেষ করে মেধাবী শিক্ষার্থীরা হতাশায় ভেঙে পড়ে। সারা বছর পড়ালেখা না করেও একটি শ্রেণী ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফল করছে।
২০০৯ সালের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যে পরিমাণ প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটেছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি। ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে গত সাত-আট বছরে। গত কয়েক বছরে প্রায় সব পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের রেকর্ড সম্পন্ন হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষার মান।
ট্রান্সপ্যারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল টিআইবিসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে ২০০৯ সালের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রশ্নফাঁসের রেকর্ড তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

২০১২, ২০১৩ এবং ২০১৪ সাল ছিল পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের হিড়িকের বছর। ২০১৪ সালে বছরজুড়ে একের পর এক পাবলিক পরীক্ষায় ঘটতে থাকে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা। সমাপনী, এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় প্রায় প্রতিটি বিষয়ে মুড়ি মুড়কির মতো মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন।
২০১৪ সালে প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার শুরু থেকেই প্রতিটি বিষয়ে একের পর এক প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটতে থাকে এবং উপর্যুপরি অভিযোগ আসতে থাকে। ফাঁস হওয়া অনেক প্রশ্নের সাথে পরীক্ষার হলের প্রশ্নপত্র হুবহু মিলে যায়। তারপরও একটি পরীক্ষা স্থগিত ছাড়া অন্য সব পরীক্ষা চালিয়ে নেয়া হয়।
২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রাথমিকের সমাপনী পরীক্ষায়ও একের পর এক প্রশ্নফাঁস ঘটতে থাকে। ২০১৪ সালে সমাপনী পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে ধূমধামের সাথে।
গত ১ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষার হল পরিদর্শনের সময় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ঘোষণা দেন প্রশ্নফাঁস প্রমাণিত হলে পরীক্ষা বাতিল করা হবে। কিন্তু প্রথম দিনেই পরীক্ষা চলাকালে সাংবাদিকরা প্রশ্নফাঁস হওয়ার ঘটনা তাকে অবহিত করলে তিনি তাকে অসত্য বলে দাবি করেন।

এর আগে থেকেই বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় বারবার প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল থেকে এসব ঘটনাকে মিথ্যা, গুজব ও ভিত্তিহীন বলে বাতিল করে দেয়া হয়েছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সাথে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার হুবহু মিল পাওয়ার পরও নিকট অতীতে একটি ছাড়া ফাঁস হওয়া প্রশ্নে অনুষ্ঠিত পরীক্ষা বাতিল করা হয়নি। প্রশ্নফাঁস হওয়ার পর তাকে ভিত্তিহীন বলে চালিয়ে দেয়ার পর অনেকে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ইন্টারনেটে প্রকাশ করে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। কিন্তু তারপরও পরীক্ষা বাতিল করা হয়নি। ২০১৪ সালে পরিস্থিতি অত্যন্ত বেগতিক আকার ধারণ করায় স্থগিত করা হয় ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষা। যদিও বাংলা, ইংরেজি প্রথমপত্র, গণিত, রাসায়ন, পদার্থবিজ্ঞানসহ অধিকাংশ বিষয়ের প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে। কিন্তু এসব পরীক্ষা বাতিল করা হয়নি।
অবশ্য পরবর্তীতে শিক্ষামন্ত্রীসহ অনেকেই প্রশ্নফাঁসের ঘটনা স্বীকার করেছেন। গত ১৬ নভেম্বর শিক্ষামন্ত্রী সংসদে প্রশ্নফাঁসের জন্য কিছু শিক্ষককে দায়ী করে বক্তব্য রাখেন। গত ৩০ নভেম্বর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, প্রশ্নফাঁস রোধে এমন কোনো চাবি নেই যে, তা ঘোরালেই বন্ধ হয়ে যাবে। হঠাৎ চাবি দিলাম আর প্রশ্নফাঁস বন্ধ হয়ে যাবে, তা হবে না। তবে প্রশ্নফাঁস প্রতিরোধে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। এখন পরীক্ষার তিন মাসের মধ্যে প্রশ্নফাঁস হয় না। পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্নপত্র আউট হয়ে যায়। অনেক শিক্ষক এটা করে। আমরা প্রশ্নফাঁসকে ক্রমে গুটিয়ে এনেছি। পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে আমরা আধা ঘণ্টা আগে শিক্ষার্থীদের হলে প্রবেশের ব্যবস্থা করেছি।

গত বছর ২৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জে একটি স্কুলের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রশ্নফাঁস বিষয়ে বলেন, ‘সত্যকে চাপা দিয়ে লাভ নেই। এখানে দোষীদের ধরে শাস্তি দিতে হবে। শেখ হাসিনার আমলে শিা েেত্রর যে উন্নতি তা যেন এই প্রশ্নফাঁস ম্লান করে দিতে না পারে। তিনি বলেন, এই প্রশ্নফাঁসে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এতে যদি রাজনৈতিক পরিচয়ের কেউ জড়িত থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, কারণ এরা আমাদের ভবিষ্যৎকে নষ্ট করছে।
প্রশ্নফাঁসের কারণে গত সোমবার সংসদে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। পদত্যাগ না করলে তাকে বরখাস্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছেন একজন সংসদ সদস্য।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/292034