৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:০২

বড় ভুলতো এখন বড়দের মধ্যেই

মানুষের সমাজেতো নৃশংসতা থাকার কথা নয়। নৃশংসতার জন্য তো মানুষ সমাজবদ্ধ হয়নি। বরং সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিয়ে মানবিক জীবন যাপনের লক্ষ্যেই তো মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজের আজ এমন দুর্দশা কেন? ছেলেকে হারানোর পর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কবীর হোসেন। ছেলে আদনান কবীর এক বছর আগে উত্তরায় সমবয়সী ও দু’এক ক্লাস ওপরে পড়া ছাত্রদের হাতে খুন হয়েছিল। খুনী চক্রের অব্যাহত হুমকির মুখে সপরিবারে কবীর হোসেন এখন উদ্বাস্তু। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, হত্যাকা-টি ঘটেছিল গত বছরের ৬ জানুয়ারি উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের কাছে। ওইদিন সন্ধ্যায় উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র আদনানকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যাকা-ের পর গ্রেফতার ২২ আসামীর ১৫ জন জামিনে বেরিয়ে আসে। আদনানের অন্য দুই ভাইকে বাঁচাতে হলে মামলা তুলে নিতে হবে, আসামীরা আদনানদের বাসায় গিয়ে এমন হুমকি দেয়। ফলে এলাকা ছাড়েন কবীর হোসেন। অথচ তিনি ১৯৯২ সাল থেকে উত্তরার বাসিন্দা।

উল্লেখ্য যে, শুধু আদনান কবীরের পরিবার নয়, এমন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন অন্যরাও। গত বৃহস্পতিবার ছুরিকাহত হয়ে উত্তরার স্থানীয় একটি স্কুলের ছাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। উত্তরার বেসরকারি একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে আহত আর এক ছাত্র। কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্যে অস্থির স্থানীয় নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও। উত্তরা ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ বশির আহমদ ভূঁইয়া জানান, তিনি অতিষ্ঠ। প্রায়ই সন্তানদের অসুবিধার কথা জানিয়ে অভিভাবকরা তাকে অভিযোগ জানাচ্ছেন। কলেজের প্রাক্তন এক ছাত্র হোস্টেলে থাকা দুই শতাধিক ছাত্রের কাছ থেকে প্রতিদিন ২০ টাকা করে চাঁদা আদায় করে। সন্ধ্যার সময় হোস্টেলে থাকা ছাত্রদের ক্যাম্পাসে এনে পড়াতো স্কুল কর্তৃপক্ষ। বখাটেদের অত্যাচারে এই উদ্যোগ বাদ দিতে হয়েছে। আদনান খুন হওয়ার পর উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এক ডজন কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে শুধু উত্তরাতেই পাঁচটি গ্যাং খুঁজে পায় তারা। ডিসকো বয়েজ, নাইন স্টার ক্লাব, নাইন এমএস এবং বিগ বস নামে এই গ্যাংগুলোর সঙ্গে উত্তরায় নানা অপরাধে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়।

উত্তরার গ্যাংগুলোর ফেসবুকে হত্যা, খুনসহ নৃশংস বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। সেই সঙ্গে দল বেঁধে চাঁদা আদায়, ছিনতাই ও মারধর করছে। এক গ্যাংয়ের ওয়াল থেকে অন্য গ্যাংকে হুমকি দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এদের কারণে উত্তরার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংলগ্ন এলাকায় এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। সমাজ বিশ্লেষকরা এমন পরিস্থিতির জন্য সামাজিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি পরিবার ও শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটির কথা উল্লেখ করছেন। পরিবারগুলো বৈষয়িক উন্নতির জন্য এতটাই ব্যস্ত যে, সন্তানদের দেখভাল ও নৈতিক উন্নয়নের দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। আর শিক্ষা ব্যবস্থায়ও নৈতিক চেতনার ও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত হওয়ার তেমন কোন আয়োজন নেই। ফলে কিশোররা অপসংস্কৃতির প্রভাবে অবক্ষয়ের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। এমন অবস্থায় তাদের রক্ষায় পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা ও সরকারের করণীয় আছে। সময়ের দায়িত্ব তো তাদের পালন করতে হবে।

আমরা সন্তানদের অবক্ষয়ের কথা বলছি, কিন্তু বড় অবক্ষয়তো এখন বড়দের মধ্যেই। এ কারণেই হয়তো ‘সরষের ভেতর ভূত’ প্রবাদটি ব্যাংক-ভুবনে বেশ প্রবল হয়ে উঠেছে। ৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভয়ংকর রকম উদারভাবে ঋণ বিতরণ করছে জনতা ব্যাংক। এক গ্রাহককেই মাত্র ৬ বছরে তারা দিয়েছে ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা। নিয়মনীতি না মেনে এভাবে ঋণ দেয়ায় বিপদে ব্যাংক, ঋণগ্রহীতাও ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। উল্লেখ্য যে, জনতা ব্যাংকের মোট মূলধন ২ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেয়ার সুযোগ আছে। অর্থাৎ এক গ্রাহক ৭৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ পেতে পারেন না। অথচ আলোচ্য ক্ষেত্রে ঋণ দেয়া হয়েছে মোট মূলধনের প্রায় দ্বিগুণ।

প্রশ্ন জাগে, নিয়মবহির্ভূত এই কাজটি কীভাবে সম্পন্ন হলো? জানা গেছে, ব্যাংক দেখভাল করার দায়িত্ব যাদের, সরকারের নিয়োগ দেয়া সেই পরিচালনা পর্ষদই এই বিপজ্জনক কাজটি করেছে। হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির পর এটিকেই পারস্পরিক যোগসাজশে সাধারণ মানুষের আমানত নিয়ে ভয়ঙ্কর কারসাজির আরেকটি বড় উদাহরণ বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। তাঁরা বলছেন, এটি একক ঋণের ক্ষেত্রে বৃহত্তম কেলেঙ্কারি।
উল্লেখ্য যে, সেই সময় জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারাকাত। আর ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বলরাম পোদ্দার, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক নাগিবুল ইসলাম ওরফে দীপু, টাঙ্গাইলের কালিহাতী আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী যুবলীগ নেতা আবু নাসের প্রমুখ। ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ বছর জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নেতৃত্বে ছিলেন তারা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে জনতা ব্যাংকের এই পর্ষদের উৎসাহ ছিল বেশি। পর্ষদের সিদ্ধান্তে বার বার ঋণ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঋণ দেয়া হয় খেয়ালখুশি মতো। জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে গত তিন বছর দায়িত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্যসচিব শেখ মো. ওয়াহিদ-উজ্জামান। গত ৭ ডিসেম্বর তার চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হয়েছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে তারা আরও ঋণ চেয়েছিল, আমি দেইনি। এ কারণে আমি তাদের শত্রুতে পরিণত হয়েছি। আর ঋণের প্রায় সবই আগের চেয়ারম্যানের (আবুল বারাকাত) সময় দেয়া।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, একটি ব্যাংক কীভাবে পারলো একজনকে ৫ হাজার কোটি টাকা দিতে। নিশ্চয়ই বড় কেউ আছে এর পেছনে। এটার পেছনে কারা, তা খুঁজে বের করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাই ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও দুদককে এক্ষেত্রে সক্রিয় হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কার্যক্রম আরও জোরালো করার সময় এসেছে।
প্রসঙ্গত এখানে আমরা সোনালী ব্যাংক হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল শাখার কথা উল্লেখ করতে পারি। ২০১১ সালের দিকে হলমার্ক নামে গ্রুপটি ওই শাখা থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছিল। ফলে সোনালী ব্যাংক এখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। জনতা ব্যাংকও কি সেই পথেই পা বাড়ালো? অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে কী বলবেন?

 

 

http://www.dailysangram.com/post/318282