৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৯:৫৯

দুই নিয়ন্ত্রকের সমন্বয়হীনতায় পুঁজিবাজারে বারবার অস্থিরতা

মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মধ্যে সমন্বয় না থাকায় দফায় দফায় পুঁজিবাজারে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। পরস্পর সম্পর্কিত হওয়ায় মুদ্রাবাজার নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্তে প্রভাবিত হয় পুঁজিবাজার। তবে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে কোনো সমন্বয় ছাড়াই মুদ্রাবাজার বিষয়ে নানা সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে সৃষ্ট অস্থিরতা ও টালমাটালে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।

পুঁজিবাজার-প্রভাবিত বিষয়ে মন্তব্য, সিদ্ধান্ত কিংবা সার্কুলার জারি করতে বা মতামত দিতে বিএসইসির সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সার্কুলার জারি করে ২০১২ সালে। সেই নির্দেশনার কোনো বাস্তবায়ন দেখছেন না পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্টরা। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষায় উভয় পক্ষের সমন্বয় খুবই জরুরি অভিহিত করে তাঁরা বলছেন, ‘পুঁজিবাজার স্পর্শকাতর বিষয়। আমাদের পুঁজিবাজারে প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যক্তি বিনিয়োগকারী বহুগুণ বেশি। তাদের পুঁজিও তুলনামূলক কম। পুঁজিবাজার নিয়ে কোনো তথ্য শুনলেই জেনে না জেনে শেয়ার বিক্রি করে। আর শেয়ার বিক্রির চাপে পুঁজিবাজারে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।’
সম্প্রতি বেপরোয়া ঋণের লাগাম টানতে ব্যাংকের ঋণ আমানত হ্রাস করে এক সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও সার্কুলার জারির আগেই এই তথ্য জেনে শেয়ারবাজার অস্থির হয়ে ওঠে। পুঁজিবাজারে পতন ঘটে। আর কারসাজি করার একটি গোষ্ঠী এ বিষয়ে নানা তথ্য ছড়িয়ে ভীতি সৃষ্টি করেছে। ওই গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য থাকে—ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা কম দামে শেয়ার বিক্রি করে দিলে তারা সেই শেয়ার কিনে মুনাফা অর্জন করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি ঘোষণা ও এডিআর কমানো নিয়ে আতঙ্কে শেয়ার বিক্রির চাপে বাজারে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্টরা জরুরি সভা করেছেন। সর্বশেষ সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি, আইসিবি ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বৈঠক হয়েছে।
২০১০ সালে ধসের পর দীর্ঘ ছয় বছরের মন্দাবস্থা কাটিয়ে গত বছরের শুরুতে ঊর্ধ্বমুখী গতি ফেরে পুঁজিবাজার। মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় ঊর্ধ্বমুখী পুঁজিবাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি না বাড়লে ‘প্রলুব্ধ’ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে আইনকানুনের ব্যত্যয় ঘটালে ব্যবস্থা নেওয়ারও কথা বলেন তিনি। তবে তাঁর এই ঘোষণায়ও বাজারে অস্থিরতার সৃষ্টি হয় বলে জানা গেছে।

ব্যাংকগুলো বেঁধে দেওয়া বিনিয়োগসীমা অতিক্রম করায় গত অক্টোবরে সাতটি ব্যাংককে জরিমানা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন জানানো হয়, আরো কয়েকটি ব্যাংক এই সীমা অতিক্রম করেছে। তাদেরও জরিমানা করা হবে। এই ঘোষণায় ভীতির সৃষ্টি হলে বাজার নিম্নমুখী হয়।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যভুক্ত ব্রোকারেজ হাউসগুলোর সংগঠন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সাদেক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মুদ্রাবাজার ও পুঁজিবাজার পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারের নিয়ন্ত্রক, স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটিকে অন্যান্য ব্যাংক বা মুদ্রাবাজার বিষয়ে নানা সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কাজেই পুঁজিবাজার প্রভাবিত হয়, এমন বিষয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে আলোচনা বা সমন্বয় করা প্রয়োজন। এতে মুদ্রাবাজার যেমন ভালো চলবে, তেমনি পুঁজিবাজারও স্থিতিশীল হবে।’
সূত্র জানায়, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ধস নামার পর ২০১২ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এক নির্দেশনায় বলা হয়, পুঁজিবাজারসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বা বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে বিএসইসির সঙ্গে আলোচনা, পরামর্শ ও সমন্বয় করতে হবে। বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাজার একটি সংবেদনশীল বাজার হিসেবে স্বীকৃত। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর পুঁজিবাজার সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত না হয়ে বিভিন্ন বক্তব্য ও মন্তব্য প্রদানের কারণে বাজার প্রভাবিত হওয়ার ও অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে।

জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুঁজিবাজার স্থিতিশীল করতে সরকারের জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়েছে, পুঁজিবাজার প্রভাবিত হয় এমন কোনো মন্তব্য বা সিদ্ধান্তে এসইসির সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। এখনো সেই নির্দেশনা বলবৎ আছে। তবে সেটা ফলো করা হচ্ছে কি না সবারই জানা। আমরা চাইব যেকোনো মন্তব্য কিংবা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যেন সমন্বয় করা হয়।’
বিএসইসি সূত্র বলছে, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে এক স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গঠনে কাজ করছে কমিশন। আইনকানুনে নানামুখী সংস্কার করে পুঁজিবাজারে নতুন নতুন পণ্য আনার চেষ্টা হচ্ছে। ব্যক্তি বিনিয়োগকারীকে আর্থিক সাক্ষর করতে দেশব্যাপী আর্থিক সাক্ষরতা কর্মসূচি চলছে। এতে বিনিয়োগকারী যেমন জেনেশুনে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে, তেমনি নতুন নতুন বিনিয়োগকারীও সৃষ্টি হয়েছে। ২০১০ সালে ধসের পর ধীরে ধীরে বর্তমানে স্থিতিশীল বাজারের পথে এগিয়ে পুঁজিবাজার। সমন্বয় না থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তে বাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে।

কমিশনের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকার নির্দেশনা দিয়েছে পুঁজিবাজারবিষয়ক কোনো মন্তব্য বা সিদ্ধান্তে কমিশনের সঙ্গে সমন্বয় করতে। কাজেই এ ধরনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত বা আলোচনার প্রসঙ্গ এলে কমিশনকে জানানো প্রয়োজন। কিন্তু কমিশনকে কেউ অবহিত করে না। কমিশন কিভাবে জানবে কারা কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। কমিশনকে আগে জানানো হলে সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2018/02/07/599085