৭ মার্চ ২০২৩, মঙ্গলবার, ৮:১৫

হাসপাতাল ফেরত রোগীদের ডায়াবেটিস বেশি হচ্ছে

করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা বাসায় চিকিৎসা নিয়েছে, তাদের তুলনায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার বেড়েছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে আগে যাদের ডায়াবেটিস ছিল না, তাদের মধ্যে প্রতি এক হাজার জনে ১০ জন প্রতি মাসে নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এই তথ্য জানা গেছে। এর কারণ অনুসন্ধানে আরেকটি গবেষণা শুরু হয়েছে।

আইসিডিডিআরবির গবেষণার তথ্য অনুযায়ী দেখা গেছে, আগে থেকে যারা ডায়াবেটিক রোগী, করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সেরে ওঠার পর ওষুধে তাদের ডায়াবেটিস আর নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে তাদের ইনসুলিন নিতে হচ্ছে। এ ছাড়া করোনার ধকল কাটিয়ে ওঠার পর অনেকে নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছে। কারো কারো মানসিক অবসাদ ও স্মৃতিশক্তি লোপের সমস্যা বেড়েছে। কাজে মনোযোগ দিতে তাদের সমস্যা হচ্ছে।

আইসিডিডিআরবির এই গবেষণার কথা এমন একসময় জানা গেল, যখন দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের তিন বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। আগামীকাল ৮ মার্চ পূর্ণ হবে তিন বছর। ২০২০ সালের এই দিনে দেশে মানবদেহে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত তিন বছরে ২০ লাখ ৩৭ হাজার ৮৭১ জনের দেহে এই ভাইরাসবাহী কভিড-১৯ রোগ শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছে ২৯ হাজার ৪৪৫ জন। কভিডে আক্রান্ত হয়ে যারা বিভিন্ন হাসপাতাল বা বাসায় চিকিৎসা নিয়েছে, তারা এখনো ভুগছে নানা জটিলতায়।

আইসিডিডিআরবির গবেষণা তথ্য বলছে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ৭০ শতাংশ মানসিক সমস্যায় ভুগছে। যারা বাসায় চিকিৎসা নিয়েছে, তাদের এই হার ৫০ শতাংশ। আগে যাদের ওষুধে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ছিল, তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশের এখন ইনসুলিন নিতে হচ্ছে। আর যারা বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়েছে, তাদের মধ্যে ২৭ শতাংশের ইনসুলিন লাগছে। এ ছাড়া হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে আগে যাদের ডায়াবেটিস ছিল না, তাদের মধ্যে প্রতি এক হাজার জনে ১০ জন প্রতি মাসে নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে।

আইসিডিডিআরবির সহযোগী বিজ্ঞানী ডা. ফারজানা আফরোজ কালের কণ্ঠকে বলেন, কভিডের ঘোর প্রাদুর্ভাবের সময় যারা হাসপাতালে ভর্তি ছিল বা বাসায় চিকিৎসা নিয়েছে, এমন ৩৬২ জন রোগীর ওপর এই গবেষণা চালানো হয়।

তিনি বলেন, ‘এসব কভিড রোগী সুস্থ হয়ে ওঠার পর এক মাস, তিন মাস ও পাঁচ মাস পর মোট তিনবার তাদের পরবর্তী শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ (ফলোআপ) করা হয়। ফলোআপের মাধ্যমে দেখেছি তাদের কী কী সমস্যা রয়ে গেছে, যা কভিডে আক্রান্ত হওয়ার আগে ছিল না। বাড়ির চেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। এর কারণ খুঁজে দেখতে নতুন করে আরেকটি গবেষণা চালানো হচ্ছে।’

মোট শনাক্তের ৫১ শতাংশ ঢাকার : দেশে এ পর্যন্ত ২০ লাখ ৩৭ হাজার ৮৭১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১০ লাখ ৫২ হাজার ২০৪ জন বা ৫১ শতাংশ রোগী ঢাকার। এরপর চট্টগ্রামে এক লাখ ২৯ হাজার ৩৬০ জন বা ৬ শতাংশের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। সবচেয়ে কম তিন হাজার ৩০৮ জন শনাক্ত হয় বান্দরবান জেলায়, যা মোট শনাক্তের ০.১৬ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২০ সালে করোনা শনাক্ত হয় পাঁচ লাখ ১৩ হাজার ৫১০ জনের। ২০২১ সালে শনাক্ত হয় ১০ লাখ ৭২ হাজার ২৯ জনের। সে বছর ২৮ জুলাই সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জনের করোনা শনাক্ত হয়। ২০২২ সালে শনাক্ত হয় চার লাখ ৫১ হাজার ৫৮৬ জনের। চলতি বছরে এ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ৭০৪ জনের। প্রাদুর্ভাবের পর থেকে এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে করোনা শনাক্তের হার ১৩.৩১ শতাংশ।

পুরুষের মৃত্যু ৬৩.৮ শতাংশ, নারীর ৩৬.১৯ শতাংশ : করোনাভাইরাসে প্রথম মৃত্যু হয় ২০২০ সালের ১৮ মার্চ। মোট মারা গেছে ২৯ হাজার ৪৪৫ জন। মৃত্যুর হার ১.৪৪ শতাংশ। পুরুষ ১৮ হাজার ৭৮৯ জন বা ৬৩.৮১ শতাংশ, নারী ১০ হাজার ৬৫৬ জন বা ৩৬.১৯ শতাংশ।

মারা যাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, বক্ষব্যাধি, হৃদরোগ, কিডনির সমস্যা, গ্যাস্ট্রোলিভারজনিত রোগ, স্ট্রোক, নিউরোলজিক্যাল রোগ, থাইরয়েডজনিত রোগ, বাতজনিত সমস্যা, রক্তজনিত রোগ, ক্যান্সার ও মানসিক সমস্যাজনিত রোগে ভুগছিল।

প্রাথমিক ও নগর স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বারোপ : চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ডা. লিয়াকত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস এখন কমন কোল্ডের (সর্দি-জ্বর) চারটি ভেরিয়েন্টের মতো। ধরা যায় এটি পঞ্চম। বর্তমানে যে ভেরিয়েন্ট ছড়াচ্ছে, সেটি হঠাৎ হঠাৎ সংক্রামক হতে পারে, যেটাকে আমরা বলি এন্ডামিক। কোনো অঞ্চল বা কোনো জনগোষ্ঠীতে হঠাৎ বাড়তে পারে সাধারণ সর্দিকাশির মতো। তবে সেটা প্রাণঘাতী হবে না। ভাইরাসের একটা ধর্ম হলো, প্রথমে তীব্র আকার ধারণ করে পরে নরমাল ডিজিজে পরিণত হয়।’ তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের করণীয় হলো পর্যবেক্ষণ করা। কোনো একটা অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীতে যখন ছড়াবে, তখন জানতে হবে ভেরিয়েন্টের সঙ্গে তীব্রতা রয়েছে কি না।’

ডা. লিয়াকত আলী আরো বলেন, ‘অসংক্রামক রোগের মধ্যে যাদের ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, কিডনির সমস্যা ছিল, তারা বেশি মারা গেছে। এ জন্য আমাদের বড় বড় হাসপাতাল না করে প্রাইমারি হেলথ ও আরবান হেলথ কেয়ারকে আরো গুরুত্ব দিতে হবে।’

মজুদ না থাকায় বন্ধ টিকা কার্যক্রম : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, এ পর্যন্ত টিকা এসেছে ৩৬ কোটি ২৪ লাখ ২৬ হাজার ৯৫০ ডোজ। মজুদ আছে ৬৪ লাখ ২৯ হাজার ৮৮১ ডোজ। এর মধ্যে বেশির ভাগই শিশুদের টিকা। বড়দের টিকা মজুদ না থাকায় তৃতীয় ও চতুর্থ ডোজের টিকা কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল পর্যন্ত দেশে ১৫ কোটি ছয় লাখ ১৫ হাজার ২০১ জনকে প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে, ১৩ কোটি ৭১ লাখ ৯৯ হাজার ৩২২ জন নিয়েছে দ্বিতীয় ডোজ, ছয় কোটি ৭৪ লাখ ছয় হাজার ৪২ জন নিয়েছে তৃতীয় ডোজ এবং ৩১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৫৪ জনকে চতুর্থ ডোজের টিকা দেওয়া হয়েছে।

টিকাবিষয়ক কর্মসূচি ইপিআইয়ের প্রগ্রাম ম্যানেজার ডা. এস এম আব্দুল্লাহ আল মুরাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সব কেন্দ্রে তৃতীয় ও চতুর্থ ডোজের টিকা বন্ধ। নতুন টিকা আসতে আরো তিন সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। টিকা এলে আবার কার্যক্রম শুরু করা হবে।

পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক : ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বে ৮১ হাজার ৮৪০ জন নতুন করে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে ৩৪২ জন। সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি রাশিয়ায়। সে দেশে ২৪ ঘণ্টায় ১৪ হাজার ৪৯ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর রয়েছে তাইওয়ান, যেখানে ১১ হাজার ৩৯৬ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যু বেশি জাপানে, মারা গেছে ৮১ জন।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/03/07/1258774