৭ মার্চ ২০২৩, মঙ্গলবার, ৭:৫৯

বালাইনাশকের ব্যবহার বেড়েছে অস্বাভাবিক

৯৮ শতাংশই আমদানিনির্ভর বিদেশে যাচ্ছে ৫ হাজার কোটি টাকা

দেশে বাড়ছে কৃষি আবাদের পরিধি; পাল্টাচ্ছে ফসলের ধরন। সেই সাথে বেড়েছে ফসলে ক্ষতিকর রোগ-জীবাণু ও কীটপতঙ্গ। আর এসব দমনের জন্য কৃষক বালাইনাশকের (পেস্টিসাইড) ব্যবহারও বাড়িয়ে দিয়েছেন। গত দুই দশকে দেশে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে বালাইনাশকের ব্যবহার। এতে কৃষির লাভ-ক্ষতি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও একচেটিয়া ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছে বহু জাতিক সিনজেনটাসহ আটটি কোম্পানি। দেশে বালাইনাশক ব্যবসা করে ৭০০টি কোম্পানি। এর মধ্যে মাত্র আটটি বহু জাতিক কোম্পানির হাতে এই ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ৫৫ শতাংশ। বাকি ৬৯৩টি দেশীয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের হাতে ব্যবসা রয়েছে মাত্র ৪৩ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে কৃষি আবাদের পরিধি ও ধরন বেড়েছে। তার চেয়েও বেশি হারে বেড়েছে বালাইনাশকের চাহিদা ও ব্যবহার। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে দেশের ওষুধশিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও বালাইনাশকের প্রায় ৯৮ শতাংশই বিদেশনির্ভর। বালাইনাশক আমদানিতে এতে বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সূত্রে জানা যায়, দেশে ১৯৭২ সালে জনসংখ্যা ছিল ছয় কোটি ৯০ লাখ। সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ১০ লাখ। বিশ^ব্যাংক ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্লান্ট প্রটেকশন উইং সূত্রে জানা যায়, ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্য উৎপাদন ছিল এক কোটি টন। ৫০ বছর পর খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে চার কোটি ৫৫ লাখ টনে। অর্থাৎ দেশে জনসংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে খাদ্যের উৎপাদনও। তবে দেশে মানুষ ও খাদ্য উৎপাদন বাড়ার হারের চেয়ে বেশি বেড়েছে বালাইনাশকের ব্যবহার। ১৯৭২ সালে দেশে চার হাজার মেট্রিক টন বালাইনাশকের ব্যবহার ছিল। ১৯৮০ সালে তা ছিল পাঁচ হাজার টন। ১৯৯০ সালে সাত হাজার ২০০ টন। ২০০০ সালে তা আট হাজার টনে দাঁড়ায়। কিন্তু প্রায় দুই দশকের ব্যবধানে (২০২২ সালের হিসাব) অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে বালাইনাশকের ব্যবহার দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার মেট্রিক টনে। ২০০০ সালে দেশে বালাইনাশক ম্যানুফাকচারাল কোম্পানি ছিল আটটি। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে মাত্র ২৩-এ দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ২২ বছরে দেশে ম্যানুফ্যাকচারাল কোম্পানি বেড়েছে মাত্র ১৫টি। কিন্তু এই ২২ বছরে স্থানীয় আমদানিকারকের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৫০ শতাংশ। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০০ সালে দেশীয় আমদানিকারকের সংখ্যা ছিল যেখানে মাত্র ২০০টি বর্তমানে এ সংখ্যা ৭০০টি।

বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন এসোসিয়েশনের (বিসিপিএ) তথ্য মতে, দেশে বালাইনাশকের (পেস্টিসাইড) বাজার পাঁচ হাজার কোটি টাকার। দানাদার পেস্টিসাইড বাদে তরল ও পাউডার পেস্টিসাইডের প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়। মূলত দেশে আটটি বহু জাতিক কোম্পানি একচেটিয়া অ্যাগ্রো কেমিক্যাল মার্কেটে পেটেন্ট পণ্যের ব্যবসা করে আসছে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে সিনজেন্টা। অন্য বহু জাতিক কোম্পানিগুলো হলো- বায়ার ক্রপ সায়েন্স, ইউপিএল, বিএএসএফ, হাইছেম, ইন্ডোফিল, ফরোয়াড। এসব বহু জাতিক কোম্পানি প্রায় দুই হাজার ৭৫০ কোটি টাকা তথা মোট ব্যবসার ৫৫ শতাংশ বালাইনাশকের বাজারে ব্যবসা করছে। আর স্থানীয় প্রায় ৬৯৩ আমদানিকারক কোম্পানি ব্যবসা করছে দুই হাজার ১৫০ কোটি টাকা, তথা ৪৩ শতাংশ। অন্য দিকে মাত্র ১০০ কোটি টাকা তথা মোট বাজারমূল্যের দুই শতাংশ ব্যবসা করছে দেশীয় ম্যানুফাকচারাল কোম্পানিগুলো।

দেশে বালাইনাশক কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ক্রপস প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশন বা বিসিপিএর যাত্রা শুরু ১৯৭৬ সালে। বহু জাতিক কোম্পানিগুলোসহ ৭০০টি কোম্পানির মালিক এর সদস্য। অন্য দিকে ২০২২ সালে স্থানীয় ম্যানুফাচারার্স বা উৎপাদকদের নিয়ে বাংলাদেশ অ্যাগ্রোকেমিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএএমএ) গঠন করা হয়। যার সদস্য সংখ্যা ২৩ জন।

কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, ফসল উৎপাদনে বালাইনাশকের ব্যবহার প্রয়োজন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, কীটপতঙ্গের আক্রমণের কারণে শাকসবজিতে ৫৪ শতাংশ, ফলে ৭৮ শতাংশ এবং খাদ্যশস্যে গড় ক্ষতি ৩২ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এ কারণে বালাইনাশকের ব্যবহার করে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তথ্যনুযায়ী, শুধু পোকামাকড়ের কারণে বার্ষিক ফলনের ক্ষতি হচ্ছে ধানের ক্ষেত্রে ১৬ শতাংশ, গমের ক্ষেত্রে ১১ শতাংশ, আখে ২০ শতাংশ, সবজিতে ২৫ শতাংশ, পাটে ১৫ শতাংশ এবং ডাল ফসলে ২৫ শতাংশ। আর বাংলাদেশে আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা না হলে ফসলের ৩৭ শতাংশ ক্ষতি হয়। ধান উৎপাদনে ইঁদুর একটি বড় সমস্যা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, ইঁদুর গড়ে এক বছরে দুই হাজার ৯০০ কোটি টাকার ফসল নষ্ট করছে। বাংলাদেশে চাষাবাদকৃত ১০০টি ফসলের মোট ৮৩২টি ক্ষতিকর পোকামাকড়, ৮৩৩টি রোগ সৃষ্টিকারী রোগ-জীবাণু এবং ১৭০টি আগাছা শনাক্ত করা হয়েছে। কোনো কোনো বিজ্ঞানী বলছেন, বালাইয়ের আক্রমণে ফসল ৩০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

দেশীয় কোম্পানি ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ার ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষিবিদ কে এস এম মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বালাইনাশক ব্যবসার ৫৫ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকটি বহু জাতিক কোম্পানি। দেশীয় কোম্পানিগুলোকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। আমরা দেশীয়ভাবে বালাইনাশক উৎপাদন করতে চাই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অনেকের অসহযোগিতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/732558