৭ মার্চ ২০২৩, মঙ্গলবার, ৭:৫৬

ভয়াবহ বিস্ফোরণে জনমনে উদ্বেগ

কারণ খুঁঁজে পাচ্ছে না তদন্ত কমিটি

নাছির উদ্দিন শোয়েব: সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি ভয়াবহ বিম্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। এধরনের বিস্ফোরণে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। তবে অনেক ঘটনারই সঠিক রহস্য উন্মোচন হয়নি। ঘটনার পর একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কি কারণে ঘটনাগুলো ঘটছে তা জানা যায়নি। দুদিনের ব্যবধানে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এবং চট্টগ্রামে বড় ধরনের বিস্ফোরণসহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এর আগে মগবাজার এলাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে সাতজন নিহত হয়। এছাড়া নারায়ণগঞ্জে একটি মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় ২৪ জনের মৃত্যু হয়।

এদিকে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত শিরিন ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। গতকাল সোমবার সকাল থেকে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। ভবনটির চারপাশে নিরাপত্তায় রয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে জনসাধারণের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ’ উল্লেখ করে সাইনবোর্ড ঝুলানো হয়েছে। এ ঘটনায় থানায় একটি জিডি করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মো. শহিদুল্লাহ বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশ একটি জিডি করে তদন্ত করছে। তিনি বলেন, নিহতের পরিবার মামলা করলে সেটা নিয়ে আমরা তদন্ত করব।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ অগ্নিদুর্ঘটনার জন্য বড় ঝুঁকি। অপরিকল্পিতভাবে এমন কিছু আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে উঠেছে, যেখানে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দ্রুত পৌঁছানোর সুযোগ কম। এজন্য সবাইকে সচেতন হয়ে সব বিষয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। অক্সিজেন সিলিন্ডার বিস্ফোরণের বিষয়ে তিনি বলেন, বাতাসে যে পরিমাণ অক্সিজেন আছে, আগুন ধরার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। এর সঙ্গে যদি আরও ফ্রেস অক্সিজেন যোগ হয়, তাহলে তো এর মাত্রা বাড়বেই। ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ এবং ব্যবহারের সময় সচেতনতা না থাকলে এ ধরনের দুর্ঘটনা দিনদিন বাড়তেই থাকবে।

গত রোববার সকাল পৌনে ১১টার দিকে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে শিরিন ভবনের তিনতলায়। এতে তিনজন নিহত হন। আহত হন ২৫ জন। আহত ব্যক্তিরা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ভবনে বিস্ফোরণ নিয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট জানিয়েছে, জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে। বিস্ফোরণে আশপাশের ভবনও কেঁপে ওঠে। ভূমিকম্প হচ্ছে মনে করে অন্যান্য ভবনের লোকজনও নিচে নেমে আসেন। বিস্ফোরণের পরপর আগুন ধরে যায় শিরিন ভবনে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। ৪টি ইউনিট মিলে ১৮ মিনিটের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে এনে উদ্ধারকাজ শুরু করে। শুরুতে খবর ছড়িয়ে পড়ে, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ (এসি) যন্ত্র বিস্ফোরিত হয়েছে। পরে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানায়, জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে। তারা ঘটনাস্থলে গ্যাস ডিটেক্টর (শনাক্তকারী যন্ত্র) দিয়ে পরীক্ষা করে সেখানে গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েছে বলে জানায়। তবে ঠিক কোথায় ও কীভাবে গ্যাস জমে ছিল, কীভাবে বিস্ফোরণের সূত্রপাত হয়, সেটা গতকাল পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের কর্মকর্তারা জানান, কোনো আবদ্ধ জায়গায় স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি ঘনত্বের গ্যাস থাকলে বৈদ্যুতিক সুইচ, শর্টসার্কিট, দেশলাই বা লাইটারসহ এ ধরনের যেকোনো কিছু থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত হতে পারে।

নিহত ৩ জনের লাশ হস্তান্তর: বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত তিনজনের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এরপর ওই তিনজনের লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে তাদের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। পরে দুপুর ১টায় তাদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। যাদের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে তারা হলেন- শফিকুজ্জামান (৪৫), আব্দুল মান্নান (৬৫) ও তুষার (৩৫)। এ ব্যাপারে নিউমার্কেট থানার পুলিশ উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুর রহমান বলেন, আজ (সোমবার) সকাল নিহত তিনজনের লাশের ময়নাতদন্ত শুরু হয়। পরে ময়নাতদন্ত শেষে দুপুরে তাদের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তিনি বলেন, নিহত শফিকুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। তিনি নিউ জেনারেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আর আব্দুল মান্নান একই প্রতিষ্ঠানে পিয়ন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি রাজধানীর লালবাগের বাসিন্দা। নিহত তুষারের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে। তিনিও সেখানে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. ফাহমিদা আখতার জানিয়েছেন, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণেই তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করছি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে মৃত্যু সঠিক কারণ জানা যাবে।

তদন্ত কমিটি করেনি ফায়ার সার্ভিস: শিরিন ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি বলে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে। ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা (মিডিয়া) শাহজাহান মোল্লা বলেন, বড় ধরনের আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যেহেতু এখানে শুধু বিস্ফোরণ হয়েছে, আগুনে ঘটনা খুবই সামান্য। তাই তদন্ত কমিটি গঠন না করার সম্ভবনাই বেশি। রোববার ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সেনাবাহিনীর ৫৭ ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির কমাডিং অফিসার মেজর মো. কায়সার বারী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমরা মূলত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বম ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্য। আমরা প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরক শনাক্তকরণ যন্ত্র দিয়ে ঘটনাস্থলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে আমরা বুঝতে পেরেছি, এ বিস্ফোরণের ঘটনা কোনো বিস্ফোরকের মাধ্যমে সংঘটিত হয়নি। যদি কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার করা হত, তাহলে যন্ত্রের মাধ্যমে বুঝতে পারতাম। তিনি বলেন, “যেহেতু আমরা প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরক ব্যবহারের কোনো আলামত পাইনি, সেহেতু আরও তদন্ত শেষে পরবর্তীতে জানা যাবে বিস্ফোরণটি আসলে কেন ঘটেছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকার পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক রোববার সাংবাদিকের বলেছিলেন, প্রাথমিকভাবে এটা দুর্ঘটনা বলেই মনে হয়েছে তার। ঘটনাস্থলে স্প্লিন্টার বা বিস্ফোরক জাতীয় কিছুর আলামত পাওয়া যায়নি। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মহিদ উদ্দিন খন্দকার বলেন, “নানা কারণে বিস্ফোরণের ঘটতে পারে। যেমন, বৈদ্যুতিক গোলযোগ, গ্যাস জমে থেকে আবার এসির কারণেও হতে পারে।
এর আগে শনিবার বিকালে চট্টগ্রামের সীতাকু-ে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণে ছয়জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৩২ জন। চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আব্দুল মালেক বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে সিলিন্ডার থেকেই বিস্ফোরণের সূত্রপাত। হয়তো কোনো সিলিন্ডারের ব্লাস্টিং ক্যাপাসিটি কম ছিল। এ কারণে বিস্ফোরণ হয়ে থাকতে পারে। তবে তদন্তে বিস্তারিত নিশ্চিত হওয়া যাবে। এর আগে গত বছরের ৫ জুন চট্টগ্রামের সীতাকু-ে কনটেইনার ডিপোতে রাসায়নিক থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালের জুনে রাজধানীর মগবাজার ওয়ারলেস গেট এলাকায় একটি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় আশেপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। এঘটনায় অন্তত সাতজনের মৃত্যু হয়। আহত হয় অর্ধশতাধিক। ২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় পর্যন্ত ২৪ জন মারা যায়। নারায়নগঞ্জ শহরের পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুল সালাহ জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে। বিস্ফোরেণে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন।

বিস্ফোরণের প্রাথমিকভাবে কারণ নিশ্চিত হতে না পারলেও সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, চার কারণে বিস্ফোরণ হয়ে থাকতে পারে। এর মধ্যে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ কিংবা এসি থেকেও বিস্ফোরণ হয়ে থাকতে পারে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সূত্র জানিয়েছে, দেশে অন্তত ২০ কারণে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে কমপক্ষে সাতটি কারণে বিস্ফোরণের পর অগ্নিকা- ঘটে। আর বিস্ফোরণে ঘটা অগ্নিকা- ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বৈদ্যুতিক গোলযোগে বিস্ফোরণ, গ্যাসের চুলা, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, শিল্পকারখানার বয়লার বিস্ফোরণ, যানবাহনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, বিভিন্ন রাসায়নিকের বিস্ফোরণ, নিম্নমানের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির বিস্ফোরণ উল্লেখযোগ্য।

https://dailysangram.com/post/518584