৬ মার্চ ২০২৩, সোমবার, ৭:১০

১২ দেশ ঘুরেও শহীদ কেন ‘মানুষ বিক্রির হাটে’

প্রবাস জীবনে ডজন খানেক দেশ ঘুরেছেন মো. শহীদ। কাটিয়েছেন ৩০ বছর। সবচেয়ে বেশি সময় ছিলেন গ্রিস, ইতালি, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই-এ। চার-পাঁচটি দেশের ভাষায় কথাও বলতে পারেন। তবে করোনার ধাক্কায় প্রবাস জীবনের ইতি টানেন তিনি। তখন দেশে ফেরত আসেন। দীর্ঘ ৩০ বছরের প্রবাস জীবনে সঞ্চয় করতে পারেননি তেমন। এখন সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। তাই বাধ্য হয়ে নিয়মিত মানুষ বিক্রির হাটে আসেন শহীদ। ভোর ৬টা থেকে অপেক্ষা শুরু।

মানুষ এসে একদিনের জন্য শ্রমিক হিসেবে কিনে নিয়ে যায় তাকে।
গতকাল সকাল সাড়ে ৭টা। গাবতলীর আমিনবাজার ফুটওভার ব্রিজের নিচে জড়ো হয়েছিলেন অর্ধশত মানুষ। তাদের কেউ ছিলেন খালি হাতে, কেউ কোদাল, ঝাকা কিংবা কাজের উপকরণ নিয়ে। খাবারের বাটিও ছিল অনেকের কাছে। বিভিন্ন ধরনের কাজ করার অভিজ্ঞতা তাদের। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তারা নিজেদের বিক্রি করেন। শ্রম দিয়ে অর্জন করেন টাকা। মানুষ এটিকে ‘মানুষ কেনাবেচার হাট’ কিংবা ‘শ্রমের হাট’ বলে ডাকে। যার প্রয়োজন সে এখান থেকে চুক্তি করে শ্রমিক কিনে নেন। চুক্তির পর বিকাল ৫টা পর্যন্ত তারা কাজ করেন। বিনিময়ে মজুরি পান ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। শহীদও এই হাটে বিক্রির জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। তবে তার জীবনটা অন্য শ্রমিকদের মতো নয়। শহীদ জানান, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে তিনি বিভিন্ন দেশে দেশে ঘুরেছেন। ১৯৮৮ সালে প্রথম পাকিস্তানে যান। এরপর ভারত, পাকিস্তান, ইরান, তুরষ্ক, গ্রিস, সাইপ্রাস, ইতালি, পর্তুগাল, ফ্রান্স, দুবাই, বাহারাইন, ব্রুনাই ও সিঙ্গাপুর ঘুরেছেন। বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে এসব দেশে তিনি কাজ করেছেন। শহীদ বলেন, গ্রিস, ইতালি, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই- এই ৪টা দেশে বেশি কাজ করেছি। কিন্তু কোনো সঞ্চয় করতে পারিনি। এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। বাধ্য হয়ে এই কাজ করতে হচ্ছে।

শহীদের পরিবারে স্ত্রীসহ ৬ জন সদস্য। তিনি একাই সংসারের খরচ বহন করেন। ৪ সন্তান লেখাপড়া করে। তাদের খরচ চালানো দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে তার জন্য। তিনি বলেন, আমার মেয়ে কলেজে পড়ে। ছেলে স্কুলে পড়ে। আর জমজ মেয়ে আছে তারা কেজিতে পড়ে। তাদের লেখাপড়ার জন্য অনেক টাকা লাগে। বাজার খরচ বাড়ছে। কিন্তু এখানে তেমন কাজ নেই। একদিন কাজ হলে আরেকদিন বসে থাকা লাগে। ভালো কোনো কাজের অভিজ্ঞতা নেই। তাই এখানে রোজ হিসেবে কাজ করি। ৬০০-৭০০ টাকা পাই। টুকটাক করে সংসার চলে। মাঝেমধ্যে আত্মীয়দের থেকে ধার করে চলতে হয়।

আমিনবাজারের মানুষ বিক্রির হাটে প্রতিদিন শতাধিক শ্রমিক কাজের জন্য আসেন। তাদের সবাই কাজ পান না। ভোর ৬টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে যান। সেদিন আর কোনো কাজের সুযোগ থাকে না তাদের। শ্রমিকরা জানান, মাসে ২০ দিনের মতো কাজ পাওয়া যায়। বাকি ১০ দিন বসে থাকতে হয়। মাসে গড়ে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় হয় একজনের। কোনো কোনো সময় এর কমও হয়। মো. আব্দুলও ভোর হতেই প্রতিদিন আসেন এই হাটে। তিনি বলেন, বাসাভাড়া দিয়ে চলা কঠিন। ৫ জনের সংসার। ৩৪০০ টাকা ঘরভাড়া দেয়া লাগে। বাকি টাকা দিয়ে কষ্ট করে চলতে হয়।

মানুষ বিক্রির হাটে রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, রঙ মিস্ত্রি, স্যানিটারি মিস্ত্রি, দিনমজুরসহ নানা পেশার শ্রমজীবীরা আসেন। এরমধ্যে অনেক নারীও রয়েছে। তবে তাদের মজুরি পুরুষের চেয়ে কম। তাই আক্ষেপ তাদের। জহুরা বেগমও কাজের খোঁজে এখানে আসেন। তিনি বলেন, ‘এককেজি বাগুন (বেগুন) আছিলো ১০ টাকা। এহন লাগে ৫০ টাকা। মুরগির দাম হইলো ২৪০ টাকা। আমরা খামু কি?’ মোক্তার হোসেনের একার আয়ে সংসার চলে না। তাই স্ত্রী শাহিনা বেগমও স্বামীর সঙ্গে মানুষ বিক্রির হাটে আসেন কাজের খোঁজে। দু’জন মিলে মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা আয় হয়। তা দিয়ে ৮ জনের সংসার চলে। ৬ সন্তানের মধ্যে বড় ৪ জন লেখাপড়া করেন। বিশ্ববিদ্যালয়েও লেখাপড়া করে এক সন্তান। সব মিলে ১০-১২ হাজার টাকা তাদের পড়ালেখায় ব্যয় হয়। এ ছাড়া ঘরভাড়া, বাজার খরচ নিয়ে খুবই টানাপড়নে সংসার চলছে তাদের। শাহিনা বলেন, ‘একদিনের কামে গরুর মাংসের টাকাই হয় না। তাইলে দুই দিনের কামে ভাত খামু নাকি গরুর মাংস খামু। এখন এমনেই কষ্ট করে দিন যাচ্ছে। তাও খাইয়া না খাইয়া ছেলেমেয়ের লেখাপড়া করাইতাছি।’ অস্বাভাবাবিক দাম বাড়ার কারণে অনেকদিন ধরে মুরগিও কেনেন না মোক্তার। আক্ষেপ করে বলেন, মেয়ে বলছে বাবা এক মাস ধরে তুমি মুরগি আনো না। ২৪০ টাকা কেজি মুরগি। কীভাবে খাওয়াবো। গাবতলী হয়ে বেড়িবাঁধের রাস্তা ধরে সামনে এগোতেই দেখা মেলে রাস্তার দু’পাশ ঘেসে বসে আছেন একদল নারী-পুরুষ। সঙ্গে কোদাল-ঝুড়ি আর বাজারের ব্যাগ। ব্যাগের মধ্যে খাবারের বাটি, কিছু জামা-কাপড়। কেউ পান খাচ্ছে। ধুমপানের ফাঁকে ফাঁকে গল্প চলছে। অনেকের সঙ্গে বিক্রি হতে এসেছেন ছোট্ট মফিজুল ইসলাম। গ্রামের বাড়ি রংপুর। বয়স ১৬ বছর। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করলেও করোনাকালীন অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছেন। মা জোৎসা খাতুন রাজধানীর সাভারের একটি গার্মেন্টে কাজ করতেন। গার্মেন্টে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এখন পঙ্গু জীবনযাপন করছেন তিনি। কথা হয় মফিজুলের সঙ্গে। মফিজুল জানায়, ৫ বছর বয়সে বাবা তাদের ফেলে অন্যত্র চলে যান।

এরপর শুরু হয় মা ছেলের বেঁচে থাকার লড়াই। রংপুরের পীরগাছা উপজেলার একটি সরকারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে। এরপর মায়ের সঙ্গে ২০১৩ সালে ঢাকায় চলে আসে। সাভারের রেডিও কলোনি এলাকার একটি টিনশেড বাসায় ৩ হাজার টাকায় ভাড়া থাকে। সাভারের স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা পাশাপাশি একটি মুদি দোকানে কাজ শুরু করে। করোনার কারণে যখন সকল কিছু বন্ধ হয়ে যায় সে সময় তাকে কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেয় দোকান মালিক। পরবর্তীতে দিনচুক্তিতে যে কাজ পেতো তাই করতো। মায়ের দুর্ঘটনার পরে পুরো সংসারের দায়িত্ব এখন মফিজুলের কাঁধে। মফিজুল বলেন, গাবতলী, মিরপুর, বেড়িবাঁধ, বসিলা, আজিমপুর বিভিন্ন হাটে গত দুই বছর ধরে বিক্রি হচ্ছি। তবে সেটা নিয়মিত না। ৫শ’ টাকা দেয়ার কথা বলে সারা দিন কাজ করিয়ে কখনো ৪শ’ টাকা বা তার কম দেয়। এক কাজের কথা বলে আরেক কাজ করায়। মফিজুল জানায়, সম্প্রতি মিরপুরের স্থানীয় এক বাসিন্দা তাকে সাড়ে ৫শ’ টাকায় কিনে নিয়ে যায় সবজি ক্ষেতে কাজ করার জন্য। পরে তাকে দুপুর পর্যন্ত মাটি কাটার কাজ করায়। এরপর বাসায় নিয়ে ছেলেমেয়ের নোংরা কাপড়-চোপড় ধোয়ায়। দুপুরে খেতে দেয়ার কথা বললেও পেট ভরে খাবার দেয়নি। সন্ধ্যার সময় ৪০০ টাকা হাতে ধরিয়ে বলেন, গায়ে শক্তি নাই। এক ঘণ্টার কাজ ২ ঘণ্টায় করো- এসব বলে পাঠিয়ে দেয়। এই কিশোর জানায়, পেটভরে খাবার খেতে পারলে শরীর স্বাস্থ্যটা আরও মোটাতাজা হতো। প্রতিদিনই ভালো মজুরিতে কাজ পেতো।

সুজি বেগম। বয়স ৩৫ বছর। স্বামী স্বপন। দুজনেই হাটে আসেন। সুজি বেগম বলেন, আজ তিনি (স্বামী) আমিনবাজারের এক মহাজনের কাছে বিক্রি হয়েছেন। স্বামী সাড়ে ৬শ’ টাকা থেকে সাড়ে ৭শ’ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। আমি মহিলা দেখে ৫ থেকে ৬শ’ টাকার ওপরে কেউ কিনতে চায় না। তারওপর সর্দারদের আবার ৫০ থেকে ১শ’ করে টাকা দিতে হয়। তিনি বলেন, আমাদের ১০ বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে। নাম শান্ত। তাকে আমিনবাজারের একটি স্কুলে ভর্তি করেছি। ছেলেকে অনেক কষ্ট হলেও পড়ালেখা করাচ্ছি। চল্লিশোর্ধ্ব মনসুর আলী বলেন, গাজীপুরের কালীগঞ্জে নিজেদের পৈতৃক ভিটা। তিনবার করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। চিকিৎসা করাতে গিয়ে ভিটামাটির বেশিরভাগই বিক্রি করতে হয়েছে।

শেষ সম্বল একটি মোবাইলের দোকান ছিল সেটাও মূলধনের অভাবে বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এখন শুধু নিজেদের থাকার ঘরটুকু আছে। বাহারাইনে দীর্ঘদিন থাকলেও পরিবারের টানে ফিরে আসি। ছেলেমেয়ে কালীগঞ্জের একটি স্কুলে পড়ে। এলাকায় লোকলজ্জার ভয়ে দিনমজুরের কাজ করি না। ছেলেময়েরা বড় হয়েছে। ওরা জানে না তাদের বাবা প্রতিদিন এভাবে গরু ছাগলের মতো বিক্রি হচ্ছে। প্রতিদিন ফজরের নামাজের পরে বাসা থেকে খাবার খেয়ে অন্ধকার থাকাবস্থায় চলে আসি। মিরপুর, বসিলা, গাবতলী এসব এলাকায় কাজ করি। কখনো ৭শ’ টাকায় বিক্রি হই। কখনো ৬শ’। আবার কোনোদিন কেউ কিনতে চায় না। তখন বেলা বেড়ে গেলে বাড়ি চলে যাই। রাজধানীর গাবতলী, বেড়িবাঁধ, আমিনবাজার, বাড্ডা, বাংলামোটর, আগারগাঁও, মিরপুর, আজিমপুর, দোয়েলচত্বরসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই বসে মানুষ কেনাবেচার হাট। সকাল ৬টা থেকে এসব বাজারে আসতে শুরু করে শ্রমিকরা। সাড়ে ৭টা থেকে সকাল ৯টার মধ্যে মানুষ কেনাবেচা শেষ হয়। প্রতিদিন রাজধানীতে এরকম কয়েকহাজার শ্রমিক বিভিন্ন মহাজনের মাধ্যমে বিক্রি হয় বলে জানা গেছে। তবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও বাড়েনি এসব মানুষের জীবনমান এমনটাই আক্ষেপ এসব শ্রমিকদের।

https://mzamin.com/news.php?news=45508