৬ মার্চ ২০২৩, সোমবার, ৭:০৩

৫ উপায়ে সম্পদ ও অর্থপাচার

বাংলাদেশ থেকে পাঁচ উপায়ে অর্থসম্পদ পাচার হয়ে থাকে। বাংলাদেশ থেকে অবৈধ ও বৈধ দু’ভাবেই অর্জিত সম্পদ বিভিন্ন উন্নত দেশে পাচার হয়। অর্থসম্পদ পাচারে বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে বাণিজ্যভিত্তিক পাচার, হুন্ডি বা হাওয়ালা, কুরিয়ার ও ক্যারিয়ার, বিনিময়ভিত্তিক পাচার, রেমিট্যান্স স্কিমের অপব্যবহারের মতো পদ্ধতিগুলোর ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে। তবে বড় বড় পাচার সাধারণত বাণিজ্যভিত্তিক মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে- পণ্য বা সেবা লেনদেনে অতি বা অবমূল্যায়িত চালান ইস্যু, একই পণ্য বা সেবার একাধিক চালান ইস্যুকরণ, ঘোষণার তুলনায় পণ্য বা সেবা বেশি বা কম জাহাজীকরণ ও পণ্য বা সেবার মিথ্যা ঘোষণা প্রদান ইত্যাদি।

‘বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ (বিএফআইইউ) কর্তৃক প্রণীত ‘বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ বা সম্পদ উদ্ধারের কৌশল নির্ধারণের নিমিত্তে প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন’-এ এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে এ রিপোর্টটি প্রণয়ন করা হয় বলে জানা গেছে।

উল্লেখ্য, গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির পর্যবেক্ষণ মতে, উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে অর্থসম্পদ পাচারের প্রায় ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয় আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে।

এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ বা সম্পদ উদ্ধারে ‘ট্যাক্স রিকভারি’ পদ্ধতি অনুসরণ এবং এ লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তবে এ জন্য সরকারকে প্রথমে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আইনি ও বিচারিক প্রক্রিয়া ‘ট্যাক্স রিকভারি’ পদ্ধতি অনুসরণ করার উপযোগী করতে হবে। ‘ট্যাক্স রিকভারি’-এর জন্য বিদ্যমান আইনি কাঠামো, বিচারিক প্রক্রিয়া ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো যথাযথ নয়। যদিও ২০২০ সালে ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স আংশিক সংশোধন করে এ ধরনের বিধান রাখা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, পাচারকৃত অর্থ বা সম্পদ উদ্ধার প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে প্রচলিত ও প্রায় সব দেশ কর্তৃক স্বীকৃত পদ্ধতি হলো অপরাধের অভিযোগ সাব্যস্তকরণ-পূর্বক অপরাধলব্ধ অর্থ বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা ফিরিয়ে আনা।

পদ্ধতিগত জটিলতা ও আইনি দীর্ঘসূত্রতাসহ বিবিধ কারণে বিশ্বজুড়ে ‘এসেট রিকভারি’-এর সফলতা কাক্সিক্ষত পর্যায়ের নয়। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০০৬-২০১২ সময়ে বিশ্বের সম্মিলিত ‘এসেট রিকভারি’-এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৪২৩.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ বিবেচনায় বর্তমানে বিভিন্ন দেশে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ করার আগে বা না করেই অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট অর্থ বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা ফিরিয়ে আনা বা প্রশাসনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে জরিমানার অর্থ আদায় করা বা দরকষাকষির মাধ্যমে পাচারকৃত সম্পত্তির অংশবিশেষ উদ্ধারের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। তবে সম্প্রতি জরিমানাসহ কর ধার্য করে তা আদায় (ট্যাক্স রিকভারি) করে পাচারকৃত অর্থ বা সম্পদ উদ্ধারে তুলনামূলক অধিক সাফল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র এ প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কর আদায় করেছে। তবে কখনোই দোষী সাব্যস্ত না করে বাজেয়াপ্তকরণ, দোষী সাব্যস্ত করে বাজেয়াপ্তকরণের বিকল্প নয়। দোষী সাব্যস্ত না করে বা করার আগে বাজেয়াপ্তকরণ প্রক্রিয়াটি অভিযুক্তের বা অপরাধীর পরিবর্তে অপরাধলব্ধ অর্থ বা সম্পত্তির ওপর প্রযোজ্য বিধায় এ ক্ষেত্রে আদালতের আদেশ পাওয়া সহজ হয়। বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনি কাঠামো, বিচারিক প্রক্রিয়া এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতার কারণে ‘ট্যাক্স রিকভারি’ প্রক্রিয়া কার্যকর নয়। অন্য দিকে বাংলাদেশের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো যথেষ্ট দৃঢ় হওয়া সত্ত্বেও পাচারকৃত অর্থ বা সম্পদ চিহ্নিত করা হতে তা বাজেয়াপ্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনার সফলতার হার খুব কম।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ট্যাক্স রিকভারি’ কার্যক্রমের সফলতা ‘এসেট রিকভারি’-এর তুলনায় অনেক বেশি। কমন ল কান্ট্রি হিসেবে বাংলাদেশের আইনি কাঠামো ও বিচারিক প্রক্রিয়া ‘এসেট রিকভারি’-এর দু’টি পদ্ধতির মধ্যে অপরাধ সাব্যস্ত করে পাচারকৃত অর্থ বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ-পূর্বক উদ্ধারের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো খুবই মানসম্পন্ন। কিন্তু অপর পদ্ধতি অর্থাৎ অপরাধ সাব্যস্ত করার আগে বা অপরাধ সাব্যস্ত না করে পাচারকৃত অর্থ বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ-পূর্বক উদ্ধারের আইনি কাঠামোতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়ায় দেশের অভ্যন্তরেই কমপক্ষে ছয় থেকে সাতটি সংস্থার ঐকান্তিক সহযোগিতার প্রয়োজন হয়।

মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ২(ফ)(আ) ধারা মোতাবেক বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পত্তি নিয়মবহির্ভূতভাবে বিদেশে পাচারকে মানিলন্ডারিং হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আলোচ্য ধারা মতে, অবৈধ কিন্তু অপ্রদর্শিত অর্থও যদি বিদেশে পাচার করা হয় সে ক্ষেত্রে ‘ট্যাক্স রিকভারি’ পদ্ধতি অনুসরণ করা হলেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং অপরাধের মামলা হতে পারে। ফলে বিদ্যমান ব্যবস্থায় ‘ট্যাক্স রিকভারি’ পদ্ধতি কার্যকর হবে না।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/732368