৬ মার্চ ২০২৩, সোমবার, ৭:০৩

নিহত ৩

রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় একটি বাণিজ্যিক ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ২৫ জন। ১৩ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে তিন জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। গতকাল রোববার বেলা পৌনে ১১টার দিকে এ বিস্ফোরণে ভবনটির আংশিক ধসে পড়ে আগুন ধরে যায়। ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিটের চেষ্টায় অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। বিস্ফোরণের ঘটনায় পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। বিস্ফোরণের তীব্রতায় আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন ভবনটির পাশের মার্কেটের দোকানিরা। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ দল। আলামত সংগ্রহ করে সিআইডির ফরেনসিক ইউনিট। এদিকে সুয়ারেজ লাইনে জমে থাকা গ্যাস থেকে ভবনে বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে জানিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট।

অন্যদিকে বিস্ফোরণের আলামত পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া বিস্ফোরণের ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহারের আলামত পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে সায়েন্সল্যাবরেটরির পাশে শিরিন ম্যানশনের তিনতলায় হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। ভবনটির তৃতীয়তলায় ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের অফিসে মূলত বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের তীব্রতা এমনই ছিল যে, পাশের একটি ১৪তলা আবাসিক ভবন কেঁপে ওঠে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন ভবনটির বাসিন্দারা।

এতে ভবনটি আংশিক ধসে পড়ে ও আগুন লাগে। খবর পেয়ে সেখানে যায় ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট। তাদের চেষ্টায় বেলা ১১টা ১৩ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ঘটনাস্থলে দেখা গেছে, ভবনটির তিনতলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবন থেকে ইট ও জানালার কাচ উড়ে গিয়ে রাস্তা ও আশপাশের এলাকায় পড়েছে। তিনতলা ওই ভবনে বেশির ভাগই কাপড়ের দোকান ছিল। আশপাশে বেশ কয়েকটি আবাসিক ভবন রয়েছে। সেখান থেকে মানুষ আতঙ্কে নিচে নেমে আসেন। ভবনের তৃতীয় তলায় নিউ জেনারেশন, লায়রা প্রোডাক্ট, ফিনিক্স ইনস্যুরেন্স লিমিটেডসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় রয়েছে। ধানম-ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকরাম আলী মিয়া বলেন, আমরা শুনেছি, তিনজন মারা গেছেন। এ ছাড়া আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থলে পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল কাজ করছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা এরশাদ হোসাইন বলেন, আহত কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেল ও শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়েছে। এরশাদ হোসাইন আরও বলেন, এসি বিস্ফোরণের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ শুরু করে। তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্নয় করা সম্ভব হয়নি।

বিস্ফোরণের পর গুরুতর আহতদের পপুলার হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। সেখানেই ৩ জনের মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন- শফিকুজ্জামান (৪৫), আব্দুল মান্নান (৬৫) ও তুষার (৩৫)। শফিকুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। তিনি নিউ জেনারেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আব্দুল মান্নান রাজধানীর লালবাগের বাসিন্দা। তিনি একই প্রতিষ্ঠানে পিয়ন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আর নিহত তুষারের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে। তিনিও সেখানে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ ঘটনায় আহত হওয়া নিউ জেনারেশন নামে ওই প্রতিষ্ঠানের ওয়ার্কশপ ইঞ্জিনিয়ার খাইরুল বলেন, হেমায়েতপুরের ফ্যাক্টরি থেকে অফিসে এসেছিলাম একটা কাজে। তারপর হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে। চোখের সামনেই তিনজন মারা গেছেন। পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এইচআর ও অ্যাডমিন বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক রেজাউল করিম বলেন, এ ঘটনায় আহত আরও তিনজন আইসিউতে চিকিৎসাধীন। একজনের অপারেশন করা হয়। এ ছাড়া আরও চারজন জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন। কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।

ঢামেক ও বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি ১৩: বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত হয়ে রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন অনেকেই। এদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে এ তথ্য জানা গেছে। আহতদের মধ্যে যাদের নাম জানা গেছে তারা হলেন-মো. জাকির হোসেন জুয়েল (৩৫), মো. মেহেদী হাসান (২৫), মো. তাজউদ্দিন (৩০), মো. কবির হোসেন (৩২), রাবেয়া খাতুন (১৭), মো. নূরনবী (২৪), মো. কামাল হোসেন (৪০) ও অজ্ঞাতপরিচয় পুরুষ (৩২)। এ দুর্ঘটনায় দগ্ধরা হলেন- মো. আকবর আলী (৫২), আশরাফুজ্জামান (৩৬), আশা আক্তার(২৫), জহুর আলী (৫২) ও মো. হাফিজুর রহমান (৪৫)। আহত ও দগ্ধরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া আরও অনেকেই দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানা গেছে। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. এস এম আইয়ুব হোসেন জানান, সায়েন্সল্যাব এলাকা থেকে দগ্ধ হয়ে বার্নে ছয় জন এসছেন। তাদের মধ্যে জহুর আলী ৪৪ শতাংশ দগ্ধ হয়েছেন। এছাড়াও আশা আক্তারের ৩০ শতাংশ, আকবর আলীর ৩৭ শতাংশ, হাফিজুর রহমানের ৮ শতাংশ ও আশরাফুজ্জামানের শরীরের ৬ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। নূরনবীর মাথায় আঘাত থাকার কারণে তাকে ঢামেকে পাঠানো হয়েছে। দগ্ধদের তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলেও জানান তিনি।

জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ: সায়েন্স ল্যাব এলাকায় তিনতলা ভবনে বিস্ফোরণের কারণ জানিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল। বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) রহমত উল্লাহ বলেন, সুয়ারেজ লাইনে জমে থাকা গ্যাস থেকে ভবনে বিস্ফোরণ হয়েছে। এর আগে ফায়ার সার্ভিস বলেছে, তাদের প্রাথমিক ধারণা, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) বিস্ফোরণ থেকে আগুন লাগতে পারে। ২০২১ সালের ২৭ জুন রাজধানীর মগবাজারে জমে থাকা গ্যাসের ফলে ঘটে বিস্ফোরণ। সায়েন্সল্যাবের তিনতলা ভবনে ঘটা বিস্ফোরণও একই রকম বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট। মগবাজারের বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় ১২ জনের। ভয়াবহ ওই বিস্ফোরণে আশপাশের এলাকা কেঁপে উঠেছিল। বেশ কয়েকটি ভবনের জানালার কাচও ভেঙে যায়। সায়েন্সল্যাবের বিস্ফোরণেও কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ভবনটিতে কোনো না কোনোভাবে গ্যাস জমে ছিল। জমে থাকা গ্যাসের ঘন মাত্রা যদি ৫-১১ মাত্রার হয়, এইটা যদি ট্রিগার হয়, তাহলে এ ধরনের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এই ট্রিগার সুইচের মাধ্যমে, ফ্যানের সুইচ ও এসির সুইচের মাধ্যমেও হতে পারে। এটা গ্যাস থেকে সৃষ্ট বিস্ফোরণ হতে পারে। আর এত বড় বিস্ফোরণ গ্যাস থেকে সৃষ্টি হয়। এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, বৈদ্যুতিক সুইচ ও গ্যাসের চুলা জ্বালানোর আগে আমাদের নগরবাসীকে সচেতন থাকতে হবে। দরজা জানালা খুলে আগে গ্যাস বের করতে হবে। এরপর চুলা অথবা ইলেক্ট্রিক সুইচ দিতে হবে। বিস্ফোরণের ঘটনা একটি বাণিজ্যিক ভবনে ঘটেছে, সেখানে কীভাবে গ্যাস জমে ছিল, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে যে কোনোভাবে গ্যাস জমা হয়ে থাকতে পারে। সেটা সুয়ারেজ লাইনের মাধ্যমেও হতে পারে।

বিস্ফোরণের আলামত পাওয়া যায়নি: সায়েন্সল্যাব এলাকায় তিনতলা ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা একটি দুর্ঘটনা। এখন পর্যন্ত কোনো বিস্ফোরকের আলামত পাওয়া যায়নি। দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। তিনি বলেন, এখানে আমাদের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা এসেছেন। তারা কাজ করছেন। প্রাথমিকভাবে আমাদের মনে হচ্ছে এটি একটি দুর্ঘটনা। গ্যাস কিংবা অন্য কোনো কারণে বিস্ফোরণ হতে পারে। আমরা একটি তদন্ত কমিটি করে দেবো। তদন্তের মাধ্যমে মতামত দেওয়া যাবে। পুলিশের বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থলে কাজ করেছেন। বিস্ফোরণের কোনো আলামত এখন পর্যন্ত আপনারা পেয়েছেন কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো বিস্ফোরকের আলামত পাওয়া যায়নি।

যা জানাল সেনাবাহিনী: বিস্ফোরণের ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহারের আলামত পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল। বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য জানান বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান কমান্ডিং অফিসার মেজর মো. কায়সার বারী। তিনি বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরক শনাক্তকরণ যন্ত্র দিয়ে ঘটনাস্থলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছি। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের পর আমরা মনে করছি, এ বিস্ফোরণ বিস্ফোরক দ্রব্যের মাধ্যমে সংঘটিত হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে কায়সার বারী বলেন, এটা যেকোনো ধরনের বিস্ফোরণ হতে পারে। তবে প্রকৃত কারণ জানার জন্য আমাদের আরও তদন্ত করতে হবে। বিস্ফোরণের আসল কারণ আরও তদন্ত শেষে জানা যাবে বলেও জানান মেজর কায়সার বারী।

https://dailysangram.com/post/518517