৬ মার্চ ২০২৩, সোমবার, ৫:৫৮

হজের ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে

-আশিকুল হামিদ

সৌদি আরব সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চলতি বছর ১৪৪৪ হিজরি তথা ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। সবচেয়ে বেশিÑ এক লাখ ৫৯ যাবেন জনবহুল মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া থেকে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে যাবেন ৮১ হাজার ১৩২ জন। তৃতীয় স্থানে থাকা ভারত থেকে যাবেন ৭৯ হাজার ২৩৭ জন। এরপরই এসেছে বাংলাদেশের নাম। প্রতিজনের লাগবে ৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। কিন্তু মার্কিন ডলারকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে হজযাত্রীদের মধ্যে। কারণ, হজযাত্রীদের জন্য মার্কিন ডলারের বিপরীতে মূল্য কমানোর কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এর ফলে হজযাত্রীদের সকলকেই ১০৭ টাকা দরে ডলার কিনতে ও ভাঙাতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় তারা ক্ষতিগ্রস্তও হবেন যথেষ্ট পরিমাণে।

মার্কিন ডলারের মূল্যের কারণে শুধু নয়, সামগ্রিক হজ ব্যবস্থাপনার কারণেও হজযাত্রীরা লোকসানের শিকার হবেন বলে অভিযোগ উঠেছে। উল্লেখ্য, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতি মার্কিন ডলারের মূল্য ছিল ৩ দশমিক ৭৬ রিয়াল। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি রিয়ালের মূল্য হয়েছে ৩ দশমিক ৭৫ রিয়াল। অর্থাৎ পরিমাণে সামান্য হলেও সৌদি রিয়ালের মূল্য কমেছে। কিন্তু সে কারণে বাংলাদেশের হজযাত্রীরা উপকৃত বা লাভবান হতে পারবেন না। এর কারণ, উচিত যেখানে ছিল মার্কিন ডলারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খরচের হিসাব ঠিক বা নির্ধারণ করা, ধর্ম মন্ত্রণালয় সেখানে খরচের ব্যাপারে স্বেচ্ছাচারিতা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

প্রমাণ হিসেবে বিশেষ করে বিমান ভাড়ার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে ঢাকা থেকে জেদ্দা পর্যন্ত বিমান ভাড়া যেখানে ৮০/৮৫ হাজার টাকা, হজের প্রাক্কালে সেখানে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে এক লক্ষ ৮৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ না থাকলেও ভাড়া বাড়ানো হয়েছে এক লক্ষ টাকা। একই কারণে হজযাত্রীদের সংখ্যাও আশংকাজনকভাবে কমে যাচ্ছে বলে প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে। কথাটা ধর্ম মন্ত্রণালয়ও স্বীকার করেছে। ফলে অনেকে এমনকি স্থলপথে এবং নৌপথেও হজে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানা যাচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে ভারতের উদাহরণ টেনে বলা হচ্ছে, ‘হিন্দু রাষ্ট্র্র’ হিসেবে পরিচিতি থাকলেও ভারত থেকে যেখানে তিন লাখ টাকায় হজ করা সম্ভব হচ্ছে সেখানে রাষ্ট্রধর্ম এখনও ইসলাম হলেও বাংলাদেশের মানুষকে দ্বিগুণেরও বেশি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। বিষয়টিকে একবাক্যে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন সংশ্লিষ্ট সকলে। বলা হচ্ছে, এভাবে ব্যয় বাড়ানোর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে হজে যাওয়ার বিষয়ে মানুষের আগ্রহ কমানোর পদক্ষেপই নেয়া হয়েছে। এমন কোনো সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপকে কোনোক্রমেই সমর্থন করা যায় না। সরকারের উচিত বিশেষ করে হজের ব্যাপারে নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করা। হজের মতো ধর্মীয় একটি বিষয় নিয়ে মুনাফাখোরের মতো কর্মকান্ড বন্ধ করা দরকার অনতিবিলম্বে।

আমরা আশা করতে চাই, মার্কিন ডলারের মূল্য থেকে হজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয় পর্যন্ত সকল বিষয়ে জনগণের স্বার্থে ব্যবস্থা নেয়া হবে, যাতে সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নেতিবাচক কোনো বক্তব্য প্রাধান্যে আসতে না পারে।

ওদিকে সম্ভাব্য ব্যয় এবং সরকারের নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে মুসলিম জনগণের মধ্যে এরই মধ্যে হজ নিয়ে নানামুখী আলোচনা শুরু হয়েছে। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, প্রতি বছর দেড় লাখের বেশি মুসলিম বাংলাদেশ থেকে হজ পালন করতে গিয়ে থাকেন। মাঝখানে করোনা এবং সৌদি সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে পরপর দু’বছর বাংলাদেশিদের পক্ষে হজে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বিশ্বের অন্য কোনো দেশের মুসলিমরাও এ সময় হজ পালন করতে পারেননি। হজ পালন করার সুযোগ পেয়েছেন কেবল সৌদি নাগরিকরা। তাদের সঙ্গে সৌদি আরবে বসবাসরত অন্যান্য দেশের মুসলিমরাও হজ করতে পেরেছেন।

সে কারণে হজ পালনকারীদের সংখ্যা যেমন অনেক কমে গেছে তেমনি কমেছে ওমরাহকারীদের সংখ্যাও। সব মিলিয়েই সংকটে পড়েছিল মুসলিম বিশ্ব। এখানেও কথা আছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর প্রধান সমস্যা যেখানে ছিল হজে যেতে পারা বা না পারা, সেখানে সৌদি আরবের সমস্যা ছিল সম্পূর্ণরূপে অর্থনৈতিক। কারণ, তেলের পাশাপাশি দেশটির আয়ের প্রধান উৎসই হজ এবং ওমরাহ। আয়ের সে দুটি উৎস বাধাগ্রস্ত হওয়ায়Ñ বাস্তবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সৌদি আরবকে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে হয়েছে। বলা যায়, শীর্ষ ধনি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত মুসলিম বিশ্বের প্রধান এ দেশটি রীতিমতো অভাবে পড়েছিল। গত বছর, ২০২১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সীমিত আকারে ওমরাহর কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে সময়ে সময়ে যারা মক্কা ও মদিনাসহ সৌদি আরবের বিভিন্ন স্থানে গেছেন তারাই অবস্থা দেখে বিস্মিত ও স্তম্ভিত না হয়ে পারেননি। মসজিদুল হারাম এবং মসজিদুন নববী (সা.)-সহ কোনো একটি স্থানেই আর আগের মতো জৌলুস ছিল না। পাঁচ তারকা সকল হোটেল তো বটেই, এমনকি নি¤œ ও সাধারণ মানের আবাসিক হোটেলগুলোও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আগের মতো আর ‘এটা খেলে ওটা ফ্রি’-এর কারবার চলতে পারেনি। সন্ধ্যা হতে না হতেই সড়কের সব লাইট বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবেশ এমন হয়ে উঠেছেÑ যা দেখে মনে হবে যেন আপনি বাংলাদেশের মতো বিদ্যুৎ ঘাটতির কোনো গরীব দেশে রয়েছেনÑ যেখানে কথায় কথায় লোডশেডিং করা হয় !
মাত্র কিছুদিন আগেও, গত অক্টোবরে এই লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বদর প্রান্তরসহ বহু এলাকায় মসজিদে তালা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কেবল আযানের পরই এসবের মধ্যে কিছু কিছু মসজিদের দরজা খুলে দেয়া হলেও জামায়াত শেষ হতে না হতেই সব দরজা বন্ধ হয়ে যেতো। এমনকি দোয়া-ইস্তেগফার পড়ার জন্যও কাউকে সময় ও সুযোগ দেয়া হতো না। অসভ্যের মতো অনেকাংশে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে মুসল্লিদের বের করে দিয়েছে সৌদি পুলিশ।

খাবারের হোটেলগুলোর অবস্থা ছিল আরো করুণ। এক-দেড় বছর আগেও যে কোনো হেটেলে কম-বেশি যে দামেরই হোক, কিছু খেলেই দুটি করে নান বা তন্দুর রুটি বিনা পয়সায় দেয়া হতো। কারো ক্ষুধা বা ইচ্ছা থাকুক না থাকুক, তাকে সে রুটি নিতেই হতো। এটাই ছিল আইন। কিন্তু এবার দেখা গেলো, একদিকে ৯০-৯৫ শতাংশের বেশি হোটেল বন্ধ রয়েছে, অন্যদিকে খোলা থাকলেও কোনো হোটেলেই আর আগের মতো সেবা পাওয়া যায় না। বিনামূল্যে নান ও তন্দুর পাওয়ার কথা তো কল্পনাই করা যায়নি। সব মিলিয়ে সৌদি আরবের অবস্থা এত বেশি শোচনীয় হয়ে পড়েছিল যে, ওমরাহ করতে যাওয়া বাংলাদেশের একজন সিনিয়র সাংবাদিক বলেই বসেছিলেন, এভাবে আর দু’-এক বছর চলতে হলে সৌদি ধনি ও শেখরা ঢাকার বায়তুল মোকাররম এবং গুলিস্তানের মতো ফুটপাথের মার্কেটে গিয়ে লুঙ্গি ও গামছা বিক্রি করতে বাধ্য হবেন! কারণ, চাকচিক্য থাকলেও তাদের অর্থনীতির কোনো ভিত্তি নেই।

বলা দরকার, সৌদি আরবের ব্যাপারে বাংলাদেশের মুসলিমদের মধ্যে সব সময় বিশেষ সহানুভূতি ও শ্রদ্ধা কাজ করে। তারা চান, হজের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে সময় থাকতে নীতির অনুমোদন ও ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণসহ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে হজযাত্রীদের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা হোক। কারণ, অতীতের বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে সিদ্ধান্ত নেয়া এবং ব্যয় সম্পর্কে জানানোর ফলে হজে গমনেচ্ছুরা প্রস্তুতি নেয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পাননি। সে কারণে অনেকের পক্ষে হজ করাও সম্ভব হয়নি। এজন্যই পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকারের উচিত সময়ের পাশাপাশি মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার দিকটি বিবেচনায় নিয়ে ব্যয়ের পরিমাণও কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নেয়া, যাতে গমনেচ্ছু সকলেই হজে যেতে পারেন। আমাদের ধারণা, সরকার চাইলে ব্যয়ের পরিমাণ কমানো সম্ভব। তেমন চেষ্টা করাও দরকার। কারণ, পবিত্র হজকে অন্তত অর্থনৈতিক লাভালাভের বিষয় হিসেবে তথা বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত নয়। সরকারের বরং সকল বিষয়ে হজে গমনেচ্ছুদের সুবিধার সকল বিষয়ে লক্ষ্য রাখা উচিত।

এ প্রসঙ্গে সৌদি সরকার অবশ্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়ে রেখেছে। গত বছরের মার্চমাসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আমন্ত্রণে ঢাকা সফরে আগত সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত এক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে, এখন থেকে বাংলাদেশের সকল হজযাত্রীর ভিসার কার্যক্রম ঢাকায় সম্পন্ন করা হবে। স্থানীয় একটি হোটেলে দু’দেশের মধ্যে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক সংলাপে সিদ্ধান্তটি নেয়া এবং তার ভিত্তিতে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা।

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে দু’দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আরো কিছু বিষয় নিয়েও রাজনৈতিক সংলাপে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এসব বিষয়ের মধ্যে প্রাধান্যে ছিল সৌদি আরবে বৃক্ষ রোপন এবং সবুজায়নের প্রকল্প। স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ৫০ বিলিয়ন গাছ রোপনের দায়িত্ব পালন করবে। এর মধ্যে সৌদি আরবে ১০ বিলিয়ন গাছ লাগানো হবে। বাকি ৪০ বিলিয়ন গাছ রোপন করা হবে সৌদি আরবের প্রতিবেশিসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্রে। গাছগুলো বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে দেয়া হবে।

সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফর এবং দু’দেশের মধ্যে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠানের খবরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গভীর উৎসাহ প্রকাশ করা হয়েছে। বিশিষ্টজনরা বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে ভ্রাতৃপ্রতিম দুটি দেশের সম্পর্কে নতুন পর্যায়ে একটি শুভ সূচনা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে ভিসার বিষয়টি সামনে এসেছিল। কারণ, মুসলিম প্রধান বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছরই ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় মানুষ হজ করতে যান। বার্ষিক হজের বাইরেও কয়েক লক্ষ মুসলিম ওমরাহ করতে মক্কা-মদিনায় গিয়ে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয়টি হলো, হজযাত্রীদের পাশাপাশি ওমরাহ করতে যাওয়া সকলকেও ভিসা জটিলতায় পদে পদে বাধাগ্রস্ত হতে হয়। অনেকের পক্ষে এমনকি শেষ পর্যন্ত সৌদি আরবে যাওয়া এবং হজ ও ওমরাহ পালন করাও সম্ভব হয়ে ওঠে না।

বছরের পর বছর ধরে চলমান ঘটনাপ্রবাহের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এমন অবস্থার প্রধান কারণ আসলে ভিসা জটিলতা। অথচ সৌদি আরব এবং বাংলাদেশের সরকার চাইলে সহজেই এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। সমাধান করা জরুরিও। আমরা আশা করতে চাই, সম্পর্কের মধ্যে শুভ সূচনা যেহেতু সম্ভব হয়েছে সেহেতু ভিসার জটিলতাও কাটিয়ে ওঠা সহজেই সম্ভব হবে। বড় কথা, মুসলিম মিল্লাতের বৃহত্তর স্বার্থে এ ব্যাপারে অবশ্যই ইতিবাচক পদেক্ষেপ নেয়া দরকার।

সৌদি আরবে বাড়ি ভাড়া করা এবং সার্ভিস ও ক্যাটারিং চার্জ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় অন্য সকল বিষয়েও সরকারকে এখন থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, প্রতি বছরই বাংলাদেশের হজযাত্রীদের বসবাসের সমস্যায় পড়তে হয়। পাশাপাশি রয়েছে বিমান ভাড়া করার বিষয়টি। কারণ, এমন কোনো বছরের কথা উল্লেখ করা যাবে না, যে বছর হজযাত্রীদের বিমান সংকটে না পড়তে হয়। গত বছরও কয়েকশ’ গমনেচ্ছুর পক্ষে শেষ পর্যন্ত হজে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ বিমানের একার পক্ষে যেহেতু সকল গমনেচ্ছুকে আনা-নেয়া করা সম্ভব নয় এবং প্রতি বছরই যেহেতু বিদেশি বাণিজ্যিক বিমান ভাড়া করতে হয় সেহেতু সময় নষ্ট না করে এখন থেকেই বিমানের তথা যাতায়াতের বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার।

এ প্রসঙ্গে বিশেষ কিছু কথাও না বললে চলে না। এরকম একটি কথা হলো, হজ উপলক্ষে তো বটেই, সাধারণ সময়েও বিমানের টিকেট নিয়ে জালিয়াতি ও প্রতারণা করা হয় বলে শক্তিশালী অভিযোগ রয়েছে। দেখা গেছে, অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ঢাকা-জেদ্দা রুটে ভাড়ার তুলনায় বাংলাদেশ বিমানের ভাড়া সবসময়ই গড়ে অন্তত ২৫-৩০ হাজার টাকা বেশি। উদাহরণ দেয়ার জন্য এই সময়ের ভাড়ার কথা উল্লেখ করা যায়। বিভিন্ন সূত্রের খবরে জানা গেছে, গতবছরের অক্টোবরেও ঢাকা-জেদ্দা রুটে ভাড়ার পরিমাণ যেখানে ছিল ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বর্তমানে সেখানে আদায় করা হচ্ছে কমবেশি দুই লাখ টাকা! এর ফলে ওমরাহর খরচও অনেক বেড়ে গছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে যেখানে এক লাখ ৬০-৭০ হাজার টাকায় ১০-১৫ দিন থাকা-খাওয়া এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান জিয়ারতসহ ওমরাহ করা সম্ভব হয়েছে, আজকাল সেখানে কোনো এজেন্সিই দুই লাখ টাকার নিচে কথা বলছে না। অর্থাৎ ওমরাহ করতে হলে আপনাকে অন্তত দুই লাখ টাকা ব্যয় করতে হবে। বলা বাহুল্য, সকল বিচারে চরম জুলুম বলেই খুব কম মানুষের পক্ষেই এখন ওমরাহ করা সম্ভব হচ্ছে।

ওদিকে এগিয়ে আসছে পবিত্র হজের সময়। বলা হচ্ছে, হজের প্রাক্কালে টিকেটের দামসহ ব্যয় অনেক বেড়ে যাবেÑ যার ফলে বহু বছর ধরে প্রস্তুতি নেয়া সত্ত্বেও অনেকের পক্ষেই হজে যাওয়া সম্ভব হবে না। এখানে বিশেষ একটি তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। সে তথ্যটি হলো, ঢাকা ও জেদ্দাসহ দু’দেশে বিশ্বের অনেক দেশের বিমান যাতায়াত করলেও দেশ দুটিতে এমন একটি শক্তিশালী চক্র বা সিন্ডিকেট তৎপর রয়েছে, যাদের কারণে অন্য কোনো এজেন্সি বা গোষ্ঠীর পক্ষেই তাদের ইচ্ছার বাইরে কাজ করা সম্ভব হয় না। বিমান এ ব্যাপারে সৌদিয়াকে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নিয়েছে। সে কারণে টিকেটের দাম নির্ধারণ থেকে বিমানে সিট ও ক্লাস দেয়া পর্যন্ত সবকিছুর জন্যই মানুষকে বিমান ও সৌদিয়ার ক্রিমিনাল চক্রের দয়া-দাক্ষিণ্যের জন্য তাকিয়ে থাকতে হয়। সব মিলিয়ে এমন আয়োজন তারা নিশ্চিত করেছে যে, ভারত-পাকিস্তান বা অন্য কোনো রাষ্ট্রের বিমানের টিকেটে জেদ্দা বা সৌদি আরবের অন্য কোনো বিমান বন্দরে গিয়ে নামলেও এমন পরিমাণে জরিমানা আদায় করা হয় যে, এতে যাত্রীর লোকসান ও আর্থিক ক্ষতি অনেক বেড়ে যায়। সে কারণেও কেউ বিমান ও সৌদিয়ার সিন্ডিকেটের ইচ্ছার বাইরে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারেন না। এমন অবস্থার পরিপেক্ষিতে তথ্যাভিজ্ঞরা মনে করেন, সরকারের উচিত সৌদি আরবের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে সমঝোতায় আসার চেষ্টা করা, যাতে কোনো চক্রের পক্ষেই জনগণকে জিম্মি করে অন্যায়ভাবে বেশি অর্থ আদায় করা সম্ভব না হয়। এ উদ্দেশ্যে বিমানের পরিবর্তে অতীতের মতো চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজে হজে যাওয়ার ব্যবস্থা করার কথাও চিন্তা ও পরিকল্পনা করা যেতে পারে।

বেসরকারি হজ ব্যবস্থাপনার ব্যাপারেও সরকারের উচিত কঠোর নজরদারি করা। হজ ও ওমরাহর ব্যবসায় নিয়োজিত কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে যাতে হজযাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করা সম্ভব না হয় সেদিকে শুধু লক্ষ্য রাখলে চলবে না, আর্থিক জরিমানা এবং লাইসেন্স বাতিলসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ারও পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান যাতে সৌদি আরবে নেয়ার পর হজযাত্রীদের কোনোভাবে বিপদে না ফেলতে পারে এবং চিকিৎসাসহ সকল বিষয়ে যাতে প্রয়োজনীয় সেবা দিতে বাধ্য হয় সেসব বিষয়েও সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাছাড়া হজযাত্রীদের যে কোনো বিপদ বা প্রয়োজনে দ্রুত সেবা দেয়ার জন্য বিশেষ করে জেদ্দা, মক্কা ও মদিনায় বাংলাদেশের দূতাবাস ও কনস্যুলেটের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রস্তুত রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। সব মিলিয়ে আমরা মনে করি, বাংলাদেশি হজযাত্রীদের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা দেয়ার সর্বাত্মক প্রস্তুতি এখনই শুরু করা দরকার।

https://dailysangram.com/post/518515