৪ মার্চ ২০২৩, শনিবার, ১:১০

নাগালের বাইরে যাচ্ছে মাছ-মাংস

বাজারে মাছ-মাংসের দামের ঊর্ধ্বগতি থামার কোনো লক্ষণ নেই। নানা অজুহাতে দফায় দফায় দাম বাড়ছেই। ফলে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে যাচ্ছে মাছ-মাংসের মতো পুষ্টিকর খাবার। শীত মৌসুম শেষ হওয়ায় সবজির দামও বেড়েই চলছে। ভোজ্য তেল-চিনির দাম কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হলেও মাছ-মাংস ও সবজির বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার অভিযোগ তুলেছেন ভোক্তারা। তারা জানান, মাংস বাদ দিয়ে মাছ খাবেন তারও সুযোগ নেই। কারণ মাছের দামও বেড়েছে। সাধারণত মুরগির চেয়ে মাছের দাম কম হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাজারে কম দামের তেলাপিয়া ও পাঙাশ মাছের দামও নতুন করে বেড়েছে। গত সপ্তাহেও প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হতো ২৩০ টাকায়।

সপ্তাহের ব্যবধানে কেজি প্রতি ২০ টাকা বেড়ে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি। আর ২০০ থেকে ২২০ টাকার তেলাপিয়া ও পাঙাশ মাছ প্রতি কেজি ২২০ থেকে ২৫০ টাকায়। এভাবে মূল্য বৃদ্ধির কারণে হতাশায় পড়েছেন নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা। রাজধানীর কাওরান বাজারসহ বিভিন্ন কাঁচাবাজার ঘুরে ক্রেতা ও বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত এক/দেড় মাস ধরে মুরগি, গরু, খাসিসহ সব ধরনের মাংসের দাম বেড়েই চলেছে। দেড় মাস আগেও বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৪০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে। আর গরুর মাংসের কেজি ৫০ টাকার মতো বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা দরে।

মাংসের বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭২০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে। খাসির মাংসের দাম প্রতিকেজি ১১০০ টাকা। আর বকরির মাংস ৯০০ টাকা। অন্যদিকে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা, দেশি মুরগি ৫২০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩১০ থেকে ৩৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ক্রেতারা বলছেন, মুরগির বাজারে চরম বিশৃঙ্খলা চলছে। সপ্তাহ শেষ হলেই কেজি প্রতি ২০ টাকা দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজার করতে আসা ক্রেতা মাঈনুল বলেন, দাম বাড়ার কারণে বাসায় একমাস ধরে ব্রয়লার মুরগি খাওয়া বন্ধ। তিনি বলেন, ব্রয়লার এখন ২৫০ টাকা। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো মনিটরিং করতে কখনো দেখা যায়নি।

ব্রয়লার মুরগি বিক্রেতা আনোয়ার বলেন, ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ায় গত ১ মাস ধরে আমাদের বিক্রিও অনেক কমে গেছে। ফলে লোকসানে পড়ে গেছি। রমজান মাসে ব্রয়লার মুরগির দাম আরও বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা। খাবারের দাম, গাড়ি ভাড়া বৃদ্ধিসহ নানা কারণে দাম বাড়ছে বলে দাবি করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এখন আমরাও নিরুপায় হয়ে বেশি দামে কিনে বাড়তি দামেই বিক্রি করছি।

মাছের বাজার ঘুর দেখা গেছে, প্রকার ভেদে সাধারণ চাষের মাছের দাম কেজিতে বেড়েছে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত। পাশাপাশি দেশি জাতের মাছগুলোর দাম বেড়েছে ১০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত। বাজারে চাষের পাঙাশ-তেলাপিয়া থেকে শুরু করে দেশি প্রজাতির সব ধরনের মাছের দাম বেড়েছে। আগে বাজারে প্রতি কেজি পাঙাশ বিক্রি হতো ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, যা এখন ২০০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে তেলাপিয়া মাছের কেজি হয়েছে ২২০ তেকে ২৫০ টাকা, যা আগে ১৮০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হতো। প্রতি কেজি চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ১০০০ টাকায়। যা আগে ছিল ৫০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে। রুই, কাতলা, মৃগেল বিক্রি হচ্ছে ৩৪০ থেকে ৩৬০ টাকা কেজিতে, যা আগে ২৮০ থেকে ৩২০ টাকা ছিল। শিং মাছ ৩৫০-৪০০ টাকায়, টেংরা মাছ ৭৫০-৮০০ টাকা। এ ছাড়া, ইলিশ মাছ ১ হাজার ৩৫০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মাছ বিক্রেতা কাদের বলেন, প্রতি কেজি মাছের দাম কেজিতে ন্যূনতম ২০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বাজারে মাছের সরবরাহ কম। তাছাড়া পরিবহন খরচসহ অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে মাছের দাম বেড়েছে।

বাজারে তেল, লবণ, চিনিসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না সরকার নির্ধারিত দাম। সর্বশেষ জানুয়ারিতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ১০৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা, যা নির্ধারিত দামের চেয়ে ১৩ টাকা বেশি। এ বিষয়ে দোকানিদের জিজ্ঞাস করলে তারা কোনো উত্তর দিতে পারেনি। এদিকে রমজান সামনে রেখে ২৬শে জানুয়ারি এনবিআর এক প্রজ্ঞাপনে চিনি আমদানিতে শুল্ক ৩০ থেকে ২৫ শতাংশে নামিয়ে নেয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, হ্রাসকৃত শুল্কে চিনি এলে কেজিতে ৫ থেকে সাড়ে ৫ টাকা দাম কমতে পারে।

নতুন করে বেড়েছে ডাল ও ছোলার দাম। প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১০৫ টাকা দরে, যা গত সপ্তাহে ৯০ থেকে ৯৫ টাকা ছিল। একইভাবে প্রতি কেজি ১০ টাকা বেড়ে বুটের ডাল ৯৫ থেকে ১০০ এবং মাসকলাইয়ের ডাল ১৫৫-১৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে বাজারে এখন পিয়াজের দাম কম থাকলেও কমেনি আদা রসুনের দাম। প্রতি কেজি আদা বিক্রি হচ্ছে মান ভেদে ১৪০ থেকে ২৮০ টাকা আর রসুন ১৬০ থেকে ২২০ টাকা দরে।

এদিকে বাজারে শীতের সবজির দাম ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। এদিকে গ্রীষ্মের নতুন সবজিও বাজারে এসেছে। তবে দাম বেশি। প্রতি কেজি বেগুন ৮০ টাকা, করলা ১২০ টাকা, বরবটি ১২০ টাকা, পটোল ১২০ টাকা, ঝিঙা ৮০ টাকা, ফুলকপি ও বাঁধাকপি প্রতি পিস ২৫ থেকে ৪০ টাকা, লাউ ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সবজি বিক্রেতারা জানান, সবজির মধ্যে বর্তমানে বাজারে টমেটো, শসা ও গাজরের দামই তুলনামূলক কম। প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা। শীত শেষ। তাই এই সময়ের সবজির দাম বেশি। তবে নতুন যেসব সবজি আসছে। সেগুলোর দামও বাড়তি।
কয়েক মাস আগে থেকেই চড়ে আছে চালের বাজার। বাজার ও মান ভেদে প্রতি কেজি মোটা চাল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৬০ টাকার আশপাশে বিক্রি হয়। মিনিকেট ও নাজিরশাইল নামে বিক্রি হওয়া সরু চালের কেজি ৭০ থেকে ৮৫ টাকা। প্যাকেটজাত আটার কেজি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা।

কুলির কাজ করেন সাত্তার। কাওরান বাজারে কথা হয় তার সঙ্গে। পরিবারে স্ত্রী-সন্তানসহ সদস্য সংখ্যা ৬। আগে একাই কাজ করতেন। এখন বাধ্য হয়ে ১৯ বছরের বড় ছেলেকেও নিয়ে এসেছেন কুলির পেশায়। বাবা-ছেলে মিলে প্রতি মাসে যা আয় করেন তার অর্ধেকের বেশি টাকা বাড়ি ভাড়ায় চলে যায়। বাকি টাকায় সংসার চলে। তিনি বলেন, স্ত্রী ওএমএস’র দোকান থেকে চাল ও আটা কিনে আনে। এর জন্য তাকে প্রতিদিন ভোরে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়। আর বাজারে রাতের দিকে সস্তায় কিছু সবজি ও মাছ কিনি। আগে মাছ কিনতাম, এখন সেটাও পারি না। শুধু সবজি কিনি। এভাবেই চলছে সংসার।


https://mzamin.com/news.php?news=45195