৪ মার্চ ২০২৩, শনিবার, ১২:৪৯

মোবাইল ফোন ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া

রাজধানীতে মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে গেছে। রিকশা, বাস, প্রাইভেটকার ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার যাত্রীদের কাছ থেকে ‘থাবা’ বা ‘ছোঁ মেরে’ মোবাইল ফোন, ব্যাগসহ মূল্যবান মালামাল কেড়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এছাড়া বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় দেশীয় ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে। পুলিশ জানিয়েছে, ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ৩০০ মোবাইল ফোন ছিনতাই হয়। তবে মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের পর তা উদ্ধার হচ্ছে না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। অনেকেই ঘটনার পর পুলিশকেও জানায় না। বাড়তি ঝামেলা এড়াতে থানায় মামলাও করে না।

জানা গেছে, রাত গভীর হলে যানবাহন ও মানুষের সমাগম কমে গেলে ছিনতাইকারীরা বেশি বেপরোয়া হয়ে পড়ে। তখন বেশকিছু এলাকায় রিকশা ও পায়ে হেঁটে চলাচলকারীদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেশীয় অস্ত্রধারী ও দলবদ্ধ এসব ছিনতাইকারীদের বাধা দিলে প্রাণ হারানোর ভয় থাকে। ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটছে। রাজধানীতে বিভিন্ন স্পটে দিনে বা সন্ধ্যায় মোটরসাইকেলে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। রাতে বা ভোরে ছিনতাইকারীরা বের হয় প্রাইভেটকার নিয়ে। মোটরসাইকেল বা প্রাইভেটকারে মহিলাদের ভ্যানিটি ব্যাগ, রিকশাযাত্রীদের মোবাইল ফোন সেট, মানিব্যাগ ছিনতাই করছে। এমনকি যাত্রী বা পথচারীদের পথরোধ করে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জিম্মি করছে। কেড়ে নিচ্ছে নগদ অর্থ, মোবাইল ফোনসহ গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম।

ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তিরা বলছেন, পুলিশ জানে কোন কোন এলাকা ছিনতাইপ্রবণ। এরপরও ব্যবস্থা নিতে তাদের অনেক অনীহা। আর ঘটনা জানালেও প্রভাবশালী না হলে প্রতিকার পাওয়া যায় না। বরং নানান ভোগান্তি সইতে হয়। তবে পুলিশ বলছে, ছিনতাইয়ের অভিযোগ করলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ছাড়া জাতীয় জরুরি সেবা ট্রিপল নাইনে (৯৯৯) কল করেও এ সেবা পাওয়া যাচ্ছে। ভুক্তভোগী কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা মনে করেন মোবাইল ফোন ছিনতাই একটি সাধারণ ঘটনা। ভুক্তভোগীরা মামলা বা সাধারণ ডায়েরি করতেও থানায় যেতে আগ্রহ দেখান না। কারণ দামি ফোন না হলে পুলিশ তেমন গুরুত্ব দেয় না বলে অভিযোগ আছে। তবে স্মার্টফোন হাতছাড়া হলে সেটি ব্যবহারকারীদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। ছবি ছাড়াও ইদানিং ব্যাংকিং পাসওয়ার্ডসহ সংবেদনশীল অনেক তথ্য মানুষ ফোনে রাখে, সেগুলো বেহাত হলে তৈরি হয় নিরাপত্তা ঝুঁকি।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর ৩টার দিকে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা তার ফেসবুক পেইজে তার মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের কথা জানান। তিনি লেখেন, মোবাইলটা উত্তরা থেকে গাড়ির জানালা দিয়ে টান দিয়ে নিয়ে গেছে আমার। নাজমুলের এই পোস্টের নিচে অনেকেই জানান, তারাও একইভাবে ফোন হারিয়েছেন। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সিদ্দিকী নাজমুল আলমের মোবাইল ফোন ছিনতাই নিয়ে আলোচনার মধ্যে র‌্যাবের এক অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছে ২৫ জন। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৩৫৫টি মোবাইল ফোন। র‌্যাব বলছে, এসব ফোন হয় ছিনতাই করা হয়েছিল, নয় চুরি করা হয়েছিল। গত সোমবার রাতে রাজধানীর শাহবাগ, খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ী, আশুলিয়া, কেরানীগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ ও সোনারগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওই ফোনগুলো উদ্ধার করা হয়। মঙ্গলবার এক বিজ্ঞপ্তিতে র‌্যাব জানায়, ফোনের পাশাপাশি উদ্ধার করা হয়েছে ৫১টি চার্জার।

র‌্যাব-৩ এর সহকারী পুলিশ সুপার ফারজানা হক বলেন, মোবাইল চোরাকারবারী এই চক্রের হোতা মো. রবি নামে একজন। তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘদিন যাবৎ চোরাই এবং ছিনতাই করা মোবাইল ক্রয়-বিক্রয় করে আসছে। এই চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে জানিয়ে এই র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর আগে গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ছিনতাইকারী গ্রুপের দুই নেতাসহ ১৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশিদ বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা ডিবিকে বলেছে, প্রতিদিন ১০০ জন লোক শহরের রাস্তায় ঘোরাফেরা করে ও মহাজন (গ্যাং লিডার) তাদের প্রত্যেককে প্রতিদিন কমপক্ষে তিনটি মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেন। সেই হিসেবে শহরে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, বাস বা গাড়ির জানালার পাশে বসে যখন কেউ ফোনে কথা বলে বা নেট ব্রাউজ করে তখনই ছিনতাইকারীরা ফোনগুলো চুরি করে। পরে মহাজনরা তাদের কাছ থেকে কম দামে ফোন কিনে নেয়। সস্তা ফোনগুলো সরাসরি বিক্রি করা হলেও দামি ফোনগুলো খুলে শুধু যন্ত্রাংশ বিক্রি করা হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্যাং লিডাররা ফোনের ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি (আইএমইআই) নম্বর পরিবর্তন করে বিক্রি করে। ডিবি কর্মকর্তারা নগরবাসীকে এ ধরনের ছিনতাইয়ের ঘটনার পর সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার অনুরোধ জানিয়েছেন যাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অন্তত হটস্পটগুলো (সক্রিয় স্থান) খুঁজে বের করতে পারে।

এর আগে ফোন ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন একজন মন্ত্রীও। ২০২১ সালের ৩০ মে রাজধানীর বিজয় সরণি এলাকায় গাড়িতে বসে ইন্টারনেটে ব্রাউজিং করার সময় পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নানের ফোনটি গাড়ির জানলার বাইরে ‘ছোঁ’ মেরে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। তোলপাড়ের মধ্যে ১৯ জুলাই ফোনটি উদ্ধারের কথা জানায় পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় পাঁচজনকে। ২০২২ সালের ৩১ অগাস্ট রাত ১১টার দিকে একই কায়দায় রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকা থেকে ছিনতাই হয় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের মোবাইল ফোন। সেটি ৭ সেপ্টেম্বর উদ্ধারের কথা জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ। গত বছর ২১ জুলাই রাজধানীর কারওয়ান বাজারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী পারিশা আক্তারের মোবাইল ফোনটি বাসের জানালা দিয়ে ছিনতাই করে একটি চক্র। ওই শিক্ষার্থী ছিনতাইকারীকে ধাওয়া দিয়ে ধরতে পারেননি। ওই সময় আরেক বাসের যাত্রীর মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়ার সময় পারিশা ছিনতাইকারীকে জাপটে ধরেন। পারিশার সঙ্গে থাকা তার বন্ধুরা ঘটনাস্থল থেকে আরেক সন্দেহভাজনকে আটক করে। ৩ আগস্ট পারিশার মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় মো. রিপন ওরফে আকাশ, মো. শফিক এবং একজন কিশোর ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছর ৬ জুন রাতে টঙ্গী ব্রিজের ওপরে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন মো. সাহেদ হোসেন নামে এক যুবক। ছিনতাইকারীরা মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে সাহেদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে ছিনতাইকারীরা ধারালো ছুরি দিয়ে সাহেদকে উপর্যুপরি আঘাত করে। এতে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে যান সাহেদ। ছিনতাইকারীরা তার মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মারা যান সাহেদ।

 

https://dailysangram.com/post/518346