৩ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার, ১২:৫৯

দামের চোটে আমিষে টান

‘মাংস কিনার কথা অনেক আগেই ভুলছি ভাই। এখন তো মাছেও হাত দেওন যায় না। দেখলেন না পাঙাশের কেজি কত টাকা চাইল?’ গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর তেজকুনিপাড়া এলাকার বাজারে মাছ কিনতে এসে এভাবেই বলছিলেন সায়লা আক্তার। কী মাছ কিনেছেন জানতে চাইলে সমকালকে তিনি বলেন, ‘২০০ টাকা কেজি দরে দেড় কেজি ওজনের একটি পাঙাশ কিনছি। এতেই ৩০০ টাকা নাই।’

বেসরকারি চাকরিজীবী বাবুল হোসেনও গরুর মাংস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কথা জানালেন। কারওয়ান বাজারে ব্রয়লার মুরগি কিনতে এসে তিনি বলেন, ‘গরুর মাংস এখন আর সবার জন্য নয়। কেনা বাদ দিয়েছি তিন মাসে আগেই। এখন দেখি ব্রয়লারও বাদ দিতে হবে। কেজি হয়ে গেছে ২৪০ টাকা।’

সায়লা আাক্তার আর বাবুল হোসেনের মতো অনেকের কাছেই এখন গরুর মাংস দুর্লভ। নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে মুরগি ও মাছের মতো প্রাণীজ আমিষও। কেউ কেউ এসব খাদ্যপণ্য কেনা কমিয়েছেন। আবার কেউ কেউ খাদ্যাভ্যাস বদলের চেষ্টা করছেন। এতে অনেকের মধ্যে বাড়ছে আমিষের ঘাটতি।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্সের অধ্যাপক ড. সাইদুল আরেফিন বলেন, ডাল থেকেও আমিষ পাওয়া যায়। তবে প্রাণীজ আমিষই হচ্ছে প্রথম শ্রেণির আমিষ। যা পাওয়া যায় মাছ-মাংসে। মানুষের শরীরে আমিষের ঘাটতি হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। শিশুদের দীর্ঘমেয়াদে নানা রোগ দেখা দিতে পারে। পুষ্টিহীনতায় বর্ধন কমে যেতে পারে। এখন সবকিছুর দামই বাড়তি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাজারে গেলে অনেকেরই হিমশিম খেতে হয়। প্রান্তিক মানুষের কষ্ট তো আরও বেশি। প্রাণীজ আমিষের ঘাটতি পূরণ করতে হলে এসব পণ্যের দাম নাগালের মধ্যে রাখা জরুরি। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। আর সেই উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রকেই।

বড় বাজারগুলোতে মাসখানেক আগেও হাড়সহ গরুর মাংস কেনা যেত ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। সেই দাম গত হয়েছে সপ্তাহ তিনেক আগে। এখন কেজিতে খরচ পড়ছে ৭০০ টাকা। তবে পাড়া-মহল্লায় এই দাম আরও বেশি। হাড়সহ গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা দরে। এ ছাড়া খাসির মাংসের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায়।

কারওয়ান বাজারের মাংস বিক্রেতা সালাম মিয়া বলেন, সপ্তাহ দুয়েক ধরে গরু মাংসের দাম বেশি। কেন দাম বাড়ছে– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি পাল্টা প্রশ্ন ছোড়েন। বলেন, ‘বাজারে কোন জিনিসের দাম কম? আপনি বাজার-সদাই করেন?’ এই মাংস বিক্রেতা বলেন, ‘দাম বাড়লে কি আমগো বেশি লাভ? উল্টা ক্ষতি। এত দাম দিয়া গোস (মাংস) কয়জনে কিনবো। দাম বাড়লে মানুষ কম কিনে।’ সালাম মিয়ার দুই দোকান পরে একটি মাংসের দোকানে টু-লেট ঝুলছে। সেটি দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই দেখেন। ব্যবসা কমে যাওনের কারণে দোকান ছাইড়া দিছে।’

গরুর মাংসের এই আকাশচুম্বী দামের কারণে মধ্যবিত্তদের অনেকেই ভিড় করছেন ব্রয়লার মুরগি ও মাছের বাজারে। তবে আগে থেকেই তেতে আছে ব্রয়লার আর মাছের বাজার।

এক মাস ধরে ব্রয়লার মুরগি হাঁটছে গরুর মাংসের পথে। মাসখানেক আগে ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। ধাপে ধাপে বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ২৩৫ থেকে ২৪০ টাকা। ব্রয়লারের এই দাম সোনালি জাতের মুরগিকেও উস্কে দিয়েছে। এ জাতের মুরগির দাম আরও বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকা। এ ছাড়া দেশি মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা দরে।

গরু মাংস ও আর মুরগির দামে হতাশ হয়ে ক্রেতারা যাচ্ছেন মাছের বাজারে। সেখানেও দামের আগুনে পুড়তে হচ্ছে। মাছের মধ্যে দামের তালিকায় তুলনামূলক নিচের দিকে থাকত চাষের কই, তেলাপিয়া ও পাঙাশ। দামের ঢেউয়ে এসব মাছও লাফাচ্ছে। দুই থেকে তিন মাস আগে যারা ১৪০ বা ১৫০ টাকায় তেলাপিয়া কিংবা পাঙাশ কিনেছেন, বাজারে গেলে এখন চোখ তাঁদের কপালে ওঠে। বড় আকারের তেলাপিয়ার কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দরে। একইভাবে পাঙাশের কেজি কিনতেও গুনতে হচ্ছে ২০০ থেকে ২৩০ টাকা পর্যন্ত। চাষের কই মাছও বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৬০ টাকা দরে।

তবে ‘অভিজাত’ শ্রেণির মাছ কিনতে গেলে খরচ করতে হবে আরও বেশি। চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে। পাবদার কেজি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। রুই ও কাতলার কেজি বিক্রি হচ্ছে আকারভেদে ২৮০ থেকে ৪৫০ টাকা দরে।

হাতিরপুল বাজারের মাছ বিক্রেতা মিজানুর রহমান বলেন, দেশে এখন বিভিন্ন জায়গায় মাছের চাষ হয়। তবু বাজারে যে পরিমাণ মাছের চাহিদা, আসে তার চেয়ে অনেক কম। এ কারণে পাইকারি বাজারে দাম বেশি। পাইকারিতে বেশি পড়লে খুচরা বাজারে বাড়বেই।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে এক বছরে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ১৬ শতাংশ, খাসির মাংসের ২১ এবং ব্রয়লারের ৪১ শতাংশ ।

মাছ-মাংস থেকে দূরে সরে যাঁরা সবজির বাজারে যাচ্ছেন, তাঁরাও হতাশ। শীতের ভরা মৌসুমে এবার সবজির দাম ছিল অনেক চড়া। সেই রেশ এখনও রয়ে গেছে। দু-তিনটি ছাড়া অন্য সব সবজির দাম ৫০ টাকার ওপরে। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালের সবজি ঢ্যাঁড়স, ঝিঙা, ধুন্দুল, বেগুন, বরবটিসহ কয়েকটি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকায়। কোনো কোনোটির দাম আরও বেশি। করলা, পটোলসহ কয়েকটি সবজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা দরে।

 

https://samakal.com/economics/article/2303160034