৩ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার, ১২:৫৮

দায়ী অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতা

প্রাথমিকের বৃত্তির ফলাফল অসংগতিতে সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতা এবং মনিটরিংয়ে থাকা কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তদন্ত প্রতিবেদন আগামী রবিবার বা সোমবারের মধ্যে জমা দেওয়া হবে।

এর আগে মঙ্গলবার প্রাথমিকে বৃত্তির ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ফলাফলে দেখা যায়, পরীক্ষায় অংশ না নেওয়া অনেকের নাম মেধা বৃত্তি ও সাধারণ বৃত্তির তালিকায়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এমন তথ্য পেয়ে ফল স্থগিত করে তা পুনরায় যাচাই করে বৃহস্পতিবার রাতে প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে ফল বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

তদন্ত কমিটি : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) নূরজাহান খাতুনকে প্রধান করে সিস্টেম অ্যানালিস্ট মো. সিরাজুল ইসলাম এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রগ্রামার শহিদুল ইসলামকে নিয়ে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন যুগ্ম সচিব মনীষ চাকমাকে (পরিচালক, পলিসি অপারেশন) প্রধান করে শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফ উল ইসলাম এবং হায়দার ইয়ানিকে নিয়ে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী রবিবার বা সোমবার এসব তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

ভুলের কারণ : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, কোডিংয়ে সমস্যা হওয়ার কারণে ফলাফলে ত্রুটি দেখা দিয়েছিল। এক জেলার কোডিংয়ের সঙ্গে অন্য জেলার কোডিং মিলে যাওয়ায় এক জেলার স্থলে অন্য জেলার শিক্ষার্থীর কোড (রোল নম্বর) চলে এসেছিল। এতে অনেকে পরীক্ষায় অংশ না নিলেও অন্য জেলার কোডের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় তালিকায় নাম চলে আসে।

তদন্ত কমিটির এক সদস্য বলেন, কোডিংয়ে সমস্যা হওয়ার কারণে বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফলে ত্রুটি দেখা দেয়। তবে শুধু কোডিং নয়, এর সঙ্গে যাঁরা জড়িত এবং এ কাজে মনিটরিংয়ে থাকা কর্মকর্তারাও দায়িত্বে অবহেলা করেছেন, তদন্তে প্রমাণও পাওয়া গেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে এমন আরো অনেক কিছু থাকবে।

এ বিষয়ে জানতে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।

সংশোধিত ফলে দেখা যায়, পরীক্ষায় অংশ নিয়ে যারা মেধাবৃত্তি বা সাধারণ বৃত্তি পেয়েছে তাদের অনেকেরই নাম নেই। এতে বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়েছেন শিক্ষক ও অভিভাবকরা। অনেক শিশু শিক্ষার্থী মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দায়ের করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বৃত্তির প্রথম ফলাফলে মেধাবৃত্তি পেয়েছিল ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার নান্দাইল রোড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রানীসা খাতুন। এই খুশিতে প্রতিবেশীদের মিষ্টি দিয়েছেন বাবা রুহুল আমীন। পরে ফলাফল স্থগিত করে পুনরায় যাচাইক্রমে ফল প্রকাশ করা হলে বৃত্তি থেকে বঞ্চিত হয় রানীসা।

রুহুল আমিন বলেন, বৃত্তি না পাওয়ার খবর শুনে মেয়ে চিৎকার করে কান্না করেছে। এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। এখন মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যায় না।

জানা যায়, নান্দাইল সদরে অবস্থিত চণ্ডীপাশা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৫ জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছিল। এর মধ্যে মেধাবৃত্তি পেয়েছে ১৫ জন। সংশোধিত ফলে তাদের কারো নাম না আসায় অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। অভিভাবকদের মধ্যে পাপিয়া, লাকী, স্বপ্না ও আনার কলি জানান, তাঁদের সন্তানরা এখন শয্যাশায়ী। কোনো কিছুতেই তাদের সান্ত্বনা দেওয়া যাচ্ছে না। নান্দাইল উপজেলার ১৭৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র একই। এই অভিভাবকরা গতকাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

গত মঙ্গলবার প্রকাশিত বৃত্তির ফলাফলে দেখা যায়, মেধাবৃত্তিসহ সাধারণ বৃত্তির তালিকায় রয়েছে পরীক্ষায় অংশ না নেওয়া শিক্ষার্থীদের নাম। সারা দেশ থেকে এমন অভিযোগ এলে ফল স্থগিত করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরে পুনরায় যাচাই করে বুধবার রাতে ফল প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে ফলাফলে ত্রুটির কারণ খুঁজতে পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

শিক্ষাবিদ মনজুর আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ছোট শিশুদের এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা ঠিক হয়নি। এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। হঠাৎ করেই বৃত্তি পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হয়েছিল। কিছু শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া নিয়ে আগে থেকেই বিতর্ক ছিল। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সাহায্য দেওয়ার প্রশ্ন থাকলে তা অন্যভাবে দেওয়া যেত।

ফল প্রকাশে যাঁরা জড়িত, তাঁরা ন্যূনতম যোগ্যতার পরিচয় দেননি জানিয়ে মনজুর আহমদ বলেন, ‘এটা চরম অদক্ষতা, অযোগ্যতা এবং দায়িত্বহীনতা। এর আগে এমন কোনো ঘটনা আমার জানা নেই। এসব ভুল মেনে নেওয়া যায় না। কম্পিউটার নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, কোডিংয়ে একটা বেসিক রুলস থাকে, যেটা মানতে হবে। একই কোডিং বিভিন্ন নামে বা জেলায় যাবে, এটা অযৌক্তিক।’

 

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/03/03/1257454