৩ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার, ১১:৩২

বাংলাদেশকে গাড্ডায় ফেলেছে আদানি

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

এই মুহূর্তে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় প্রতারক শিল্পগোষ্ঠীর প্রধান গৌতম আদানি। ‘গুজরাটের কসাই’ নামে কুখ্যাত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অতি ঘনিষ্ঠজন এই আদানি। তিনিও গুজরাটেরই লোক। এক দশক আগেও শিল্পজগতে আদানির কোনো নাম ছিল না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির পৃষ্ঠপোষকতায় এক দশকের মধ্যে আদানি ভারতের শীর্ষ ধনী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। কিন্তু তার ব্যবসার প্রায় সবচাই ছিল প্রতারণার উপর প্রতিষ্ঠিত।

শেয়ারবাজারে কারসাজি করে আদানির এই উত্থান ঘটেছিল। এখন সে জালিয়াতি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় আদানির ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নেমেছে। এখন আর কোনো নম্বরে নেই। আদানির ব্যবসার এই উত্থানে বাংলাদেশও আছে একটি বড় ধরনের মুরগা হিসেবে।

২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের পর বাংলাদেশ সরকার অতি সংগোপনে আদানির সঙ্গে পঁচিশ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি করে। চুক্তিটির ভারত সরকারের সাথে ছিল না। তা ছিল আদানি গ্রুপের সঙ্গে। আদানি গ্রুপের বিদ্যুতের দাম বাংলাদেশের তুলনায় তিনগুন ধরা হয়। আর চুক্তি অনুযায়ী তাদের বছরে ৪৫ কোটি ডলার দিতে বাংলাদেশ সম্মত হয়। এই চুক্তির শর্তাবলীর বিস্তারিত গোপন রাখা হয়েছিল। কিন্তু আদানির ব্যবসায় যখন ধস নামে তখন সারা পৃথিবীতে এই চুক্তির শর্তাবলী প্রকাশিত হয়ে পড়ে। চুক্তিটি ছিল সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধী। সিডনি ভিত্তিক ক্লাইমেট এনার্জি ফিন্যান্স অস্ট্রেলেশিয়ার জ¦ালানি অর্থনীতিবিদ টিম বাকলে আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তির বিষয়ে বলেন যে, এটা অত্যন্ত বিস্ময়কর যে, কোনো কা-জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ এ ধরনের একটি চুক্তি করতে পারে না। চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সচিব মিনা মাসুদুজ্জামান। এই বিষয়ে মিনা মাসুদ ডেইলি স্টার পত্রিকাকে বলেন, চুক্তির বিষয়ে আমার কিছু মনে পড়ছে না। এটা চেয়ারম্যানের মাধ্যমে এসেছিল। মিনা মাসুদ এখন কারখানা ও স্থাপনা বিভাগের অতিরিক্ত পরিদর্শক। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পিডিবির চেয়ারম্যান ছিলেন খালেদ মাহমুদ। তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে আমার কোনো আগ্রহ নেই। তিনি বর্তমানে বারাকা পাওয়ারে একজন পরিচালক।

এই চুক্তির সবচাইতে দুঃখজনক দিক হলো পিডিবি এমনভাবে চুক্তিটি করেছে যে, এটি পরিবর্তন, বাতিল বা সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই। ১৪ হাজার আটশ ষোল কোটি রুপী ব্যয়ে আদানির বিদ্যুৎ প্রকল্পটি নির্মাণের পথে। বাংলাদেশ সরকার তিনগুন দামে ২৫ বছর ধরে আদানির কাছ থেকে এই বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য। তাছাড়া এই চুক্তি থেকে সরে আসতে চাইলেও বাংলাদেশ তা কোনোদিনও সরে আসতে পারবে না। আদানিকে এই গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে।

আদানির আছে নিজস্ব জাহাজ বহর, রেললাইন, অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় আছে কয়লার খনি। এগুলোর মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে আদানিই হচ্ছে মূল নিয়ন্ত্রক। ফলে কয়লার দামও আদানি বাড়িয়ে দিতে পারবে। আর তার ব্যয় বাংলাদেশকে বহন করতে হবে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আদানির বিদ্যুৎ প্রকল্পটির যদি কোনো ক্ষতি হয় তা মেরামত ও প্রতিস্থাপনের ব্যয়ভারও বাংলাদেশকে বহন করতে হবে। এরকম অসম আত্মঘাতী চুক্তির কথা পৃথিবীতে খুব একটা শোনা যায় না। চুক্তি অনুযায়ী পায়রা ও রামপালে কয়লা পরিবহনের ব্যয়ও বাংলাদেশকে বহন করতে হবে। তাছাড়া পরিবহন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যাবতীয় ব্যয়ভারও বাংলাদেশকে বহন করতে হবে। অথচ ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে বাংলাদেশের ব্যয় অনেক কমে আসতো।

আদানি বিদ্যুতের চুক্তি অনুযায়ী এর পরীক্ষামূলক সঞ্চালনের কোনো ব্যবস্থা নেই। সে ক্ষেত্রে তিনশ মাসের মধ্যে ত্রুটি ধরা পড়লে তার মেরামতের ব্যয়ভার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানেরই মেরামত করার কথা। কিন্তু আদানি সেগুলো বাংলাদেশের উপর চালিয়ে দিয়েছে। তাই আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি এক হাতে সামান্য কিছু দিয়ে তার অপর হাতে বহুগুন তুলে নেয়া।

আর সে কারণেই সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা এই চুক্তি সম্পর্কে বলেছেন, এই চুক্তিটি অত্যন্ত গোপনীয়, প্রকাশ করা যাবে না। আমরা জানি সংবিধান অনুযায়ী এ দেশের মালিক দেশের জনগণ। দেশের স্বার্থ অনুযায়ী কারো সঙ্গে চুক্তি করলে তা কেন প্রকাশ করা যাবে না? সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। এই চুক্তিতে নরেন্দ্র মোদির খাজাঞ্চী বলে পরিচিত গৌতম আদানি তথা ভারতের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ সম্পূর্ণ বিকিয়ে দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ চাইলেও এটি আর সংশোধন করতে পারে না। তবে চুক্তিটি রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের নয়। তাই আমরা মনে করি সরকার পরিবর্তিত হলে কোনো দেশপ্রেমিক সরকার ক্ষমতায় এলে এই চুক্তি ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেয়া হবে।

https://dailysangram.com/post/518210