২ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৩:৪২

মোবাইল নেই আরিফুলের, পেলেন না ট্রেনের টিকিট

নতুন নিয়মে বুধবার থেকে ট্রেনের টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে। নিয়ম বুঝতে না পেরে কমলাপুর রেলস্টেশনের হেল্প ডেস্কে যাত্রীর ভিড় সমকাল

সায়েদাবাদ মাদ্রাসায় পড়েন ১৯ বছর বয়সী আরিফুল ইসলাম। সিরাজগঞ্জের গ্রামের বাড়ি যাবেন। ট্রেনের টিকিটের জন্য গতকাল বুধবার বিকেলে আসেন কমলাপুরে। কিন্তু টিকিট পাননি। কারণ, টিকিট কাটতে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে নিবন্ধন করেননি। অনেকেই অন্যদের সহায়তায় নিবন্ধন করলেও আরিফুল অসহায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। কারণ, তাঁর মোবাইল ফোন নেই।

গতকাল থেকে নতুন নিয়মে বিক্রি হচ্ছে ট্রেনের টিকিট। যাঁরা আগাম নিবন্ধন করেছেন, তাঁরা সহজেই টিকিট পেয়েছেন। যাঁদের নিবন্ধন নেই, আরিফুলের মতো এমন হাজারো মানুষ দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে কাউন্টার থেকে খালি হাতে ফিরেছেন। হাজারো মানুষ কমলাপুরের ৭ নম্বর কাউন্টারের হেল্পডেস্কে লাইন ধরে নিবন্ধন করেন। যাঁরা প্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শী, তাঁরা মিনিটেই করেছেন। যাঁরা অজ্ঞ, তাঁরা ছিলেন মহাদুর্ভোগে। নিবন্ধন পদ্ধতি জানতে স্টেশনের চত্বরে ছুটে বেড়িয়েছেন। সারাদেশেই ছিল এই চিত্র।

টিকিট পদ্ধতি আগের চেয়ে কঠিন হলেও একে কালোবাজারি বন্ধের মহৌষধ বলছে রেলওয়ে। কর্মকর্তাদের ভাষ্য, মোবাইল ফোন নেই এমন মানুষ দেশে নেই। রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গতকাল সকালে কমলাপুরে নতুন পদ্ধতির উদ্বোধন করে বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট রেলওয়ে গড়তেই ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’ নিয়ম কার্যকর করা হয়েছে। এতে কালোবাজারি বন্ধ হবে।

মন্ত্রী জানান, এনআইডি দিয়ে নিবন্ধন ছাড়া টিকিট আর মিলবে না। অন্যের টিকিটে ভ্রমণ করলে বিনা টিকিটের যাত্রী হিসেবে গণ্য করে জরিমানা করা হবে। টিকিট পরিদর্শকদের পস মেশিন দেওয়া হচ্ছে। বিনা টিকিটের যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকা সরাসরি সরকারি কোষাগারে জমা হবে। টাকা ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ বন্ধ।

গত বছরের ২৬ মার্চ সহজ লিমিটেড রেলের টিকিট বিক্রি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পায়। এর পর এক বছরে ২০ লাখ যাত্রী নিবন্ধন করেছেন বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির মুখপাত্র ফারহাদ আহমেদ। তিনি জানান, ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে এনআইডি ভেরিফাই করেছেন প্রায় ৫ লাখ যাত্রী।

এ হিসাবে ৭৫ ভাগ যাত্রীই নিবন্ধন ভেরিফাই করেননি। রেল সূত্রের তথ্য, গত মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত অনলাইনে ৩ লাখ ২৪ হাজার ১৭ জন এবং মোবাইলের এসএমএসের মাধ্যমে ৭ হাজার ১৩ জন নিবন্ধন করেছেন।

এ পদ্ধতিতে যাত্রীর দেওয়া এনআইডি নম্বর ও জন্মতারিখ নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে রক্ষিত তথ্যের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেলানো হয়। মিললে নিবন্ধন সম্পন্ন হয়। আগে যে কোনো নাম, এনআইডি ও ফোন নম্বর নিবন্ধন করা যেত। সত্যতা যাচাই হতো না। কালোবাজারি একাধিক অ্যাকাউন্ট খুলে টিকিট কাটত। ডোনাল্ড ট্রাম্প, জো বাইডেন, ভ্লাদিমির পুতিনের নামেও নিবন্ধন করা হয়। নতুন পদ্ধতিতে তা সম্ভব নয় বলে রেলের দাবি।

এতে স্বচ্ছতা এলেও ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠী এবং মোবাইল ব্যবহারে অজ্ঞ গরিব ও স্বল্প শিক্ষিতরা মহাদুর্ভোগে পড়েছেন। তেমনই একজনই ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের মাসুদ রানা। তিনি বুধবার বিকেলে আধা ঘণ্টা লাইন ধরে কমলাপুরের ১১ নম্বর কাউন্টারে পৌঁছান। কিন্তু নিবন্ধন না করায় টিকিট পাননি। গফরগাঁওয়ের আরেক যাত্রী ফজলু মিয়ারও একই দশা হয়।

তাঁরা স্টেশন চত্বরে ঘুরছিলেন কীভাবে নিবন্ধন করা যায় জানতে। একজন বললেন, খুব সোজা। ইজ লিখে স্পেস দিয়ে এনআইডি নম্বর এবং জন্মতারিখ দিয়ে ২৬৯৬৯ নম্বরে এসএমএস করলেই হবে। কিন্তু মাসুদ রানা ও ফজলু মিয়ার তা বোধগম্য হলো না। মুখভঙ্গি বলছিল, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে।

ফজলু মিয়া কাঁচুমাচু মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এসএমএস কীবা করে!।’ এই প্রতিবেদক তাঁর ফিচার ফোন থেকে এসএমএস করে দিলেন। ফিরতি মেসেজ এলো, নিবন্ধন সফল হয়েছে। ফজলু মিয়া ফের কাউন্টারে গিয়ে টিকিট হাতে ফিরে এলেন। বললেন, ‘মোবাইল নম্বরডা কইতেই টিকেট দিছে।’

ওই দিকে মাসুদ রানার জটিলতা তখনও কাটেনি। কারণ, তাঁর ফোনে টাকা নেই। এসএমএস করতে পারছেন না। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করলেও শেরপুরের সাজু মিয়াও বুঝতে পারছেন না কীভাবে এসএমএস করতে হয়। জামালপুরের আবদুল খালেকের আরও দিশেহারা অবস্থা। সঙ্গে এনআইডি নেই। যখন জানলেন অন্যের কেনা টিকিটে ট্রেন চড়লে জরিমানা হবে, ভয় আরও বাড়ে। বললেন, ‘ঢাকা আইছিলাম ডাক্তারের কামে। এ রুম বিপদে পড়াম কেঠা জানত। আমরা কী লেহাপড়া জানি! কীবা করাম লেইসস্টেশন (নিবন্ধন)।’

রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী সমকালকে বলেছেন, যাত্রীদের অভ্যস্ততার জন্য প্রথম পাঁচ দিন শিথিলতা থাকবে। এর পর নতুন পদ্ধতি পুরোপুরি প্রয়োগ করা হবে। এর পর থেকে টিকিট যাঁর তিনিই ভ্রমণ করবেন।

জামালপুরের যাত্রী শাহনাজ বেগম যিনি এসেছেন যমুনা এক্সপ্রেসের টিকিটের জন্য। তিনি আরেকজনের সহায়তায় এসএমএস করেন। কিন্তু নিবন্ধন সফল হওয়ার ফিরতি মেসেজ আসেনি। এর মধ্যেই বিকেল পৌনে ৫টা বেজে যায়। চলে যায় যমুনা এক্সপ্রেস। ‘ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস’ ধরতে বিকেল সাড়ে ৫টায়ও ছিলেন ফিরতি মেসেজের আশায়।

তবে সবার অভিজ্ঞতা এক নয়। সাইদুল ইসলাম নয়ন ই-টিকিটের ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করেছেন। গতকাল স্টেশনে আসেন ৫ মার্চের দিনাজপুরের পার্বতীপুরের টিকিটের জন্য। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী জানালেন, আগে পাঁচ দিন আগে সকালেই শেষ হতো। কালোবাজারি বন্ধ হওয়ায় এবার পেয়েছেন।

ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গতকাল ঈশ্বরদী জংশনে এসে বিপাকে পড়েন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার হরিণা গ্রামের আনসার আলী, জহুরুল ইসলামসহ ১১ জন কৃষক। কীভাবে নিবন্ধন করতে হবে তা তাঁরা বোঝেন না। এনআইডি সঙ্গে না থাকায় টিকিট পাননি। গরিব ও অশিক্ষিত যাত্রীরা গণহারে ভুগছেন। আশপাশের কম্পিউারের দোকানে রাতারাতি নিবন্ধন করে দেওয়ার ব্যবসা চালু হয়েছে। সেখানে নেওয়া হচ্ছে টাকা। স্টেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, টিকিট বিক্রি কমেছে। মঞ্জরুল ইসলাম বললেন, রেল তো আগে শিখায়নি কীভাবে টিকিট কাটতে হয়।

ঈশ্বরদী জংশনের টিকিট বুকিং কাউন্টার সূত্রে জানা যায়, ট্রেন চলাচল করে ৩৬টির মতো। টিকিট বিক্রি কমেছে। পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) মো. নাসির উদ্দিন জানান, রেলওয়ে টাস্কফোর্সের বিশেষ অভিযান চলছে। যাঁরা নিবন্ধন করে টিকিট কাটতে পারছেন না, তাঁদের সহযোগিতা করা হচ্ছে। যেহেতু এটা নতুন পদ্ধতি, মানুষের বুঝতে একটু সমস্যা হতে পারে। তবে আশা করি, খুব শিগগিরই যাত্রীরা তা আয়ত্ত করতে পারবেন।

https://samakal.com/bangladesh/article/2303159846