২ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৩:৩৭

মূল্যস্ফীতির খড়্গ ভোক্তার ঘাড়ে

বিদ্যুতের দাম বাড়ালে একজন ভোক্তার শুধু প্রতি মাসে বাড়তি বিল দিলেই হয় না, বাড়ে তার বাজারের খরচ, জীবনযাত্রার ব্যয়। বিদ্যুতের দাম বাড়া মানে উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় বাড়তি খরচ যুক্ত হওয়া। কৃষি উৎপাদন থেকে শুরু করে শিল্প—সব খাতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বারবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব হবে বহুমুখী। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে, যার মাসুল দিতে হবে সাধারণ ভোক্তাদের।

গত দুই মাসের মধ্যেই গ্রাহক পর্যায়ে তিনবারে মোট ১৫ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার নির্বাহী আদেশে গ্রাহক পর্যায়ে ৫ শতাংশ বাড়িয়ে বিদ্যুতের নতুন মূল্যহার নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। বিদ্যুতের নতুন দাম গতকাল বুধবার থেকে কার্যকর হয়েছে। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম দাঁড়িয়েছে আট টাকা ২৫ পয়সা, যা আগে ছিল সাত টাকা ৮৬ পয়সা।

এতে আবাসিক গ্রাহক, বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের পাশাপাশি ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প-কারখানাগুলোর উদ্যোক্তারা আরো চাপের মধ্যে পড়লেন। পাশাপাশি বৃহৎ শিল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে একই হারে গ্যাসের দাম নির্ধারণ এবং তিন দফায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও বড় সংকটের মুখে পড়বেন।

২০২০ সালে জাতীয় পর্যায়ের পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পিপলস ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার গুডসের স্বত্বাধিকারী রেজবিন বেগম। তিনি চামড়াজাত পণ্য জুতা, ব্যাগ, মানিব্যাগ ও বেল্ট উৎপাদন করে বাজারজাত করছেন। গত দুই মাসে চার দফা গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কারখানা সচল রাখা নিয়ে বড় ধরনের সংকটের মধ্যে আছেন এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা।

রেজবিন বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমাদের উৎপাদন খরচ এরই মধ্যে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। এখন নতুন করে আবার ৫ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ায় আবারও উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। বাড়বে সব ধরনের কাঁচামালের দামও। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টি চিন্তা করে আমরা খরচের তুলনায় পণ্যের দাম সেভাবে বাড়াতে পারছি না। উৎপাদন ব্যয় সামাল দিতে না পেরে অনেক উদ্যোক্তাই কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে এই খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বেকার হয়ে যাবেন লাখো উদ্যোক্তা ও এ খাতের শ্রমিকরা।’
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের টিকিয়ে রাখতে এ খাতের জন্য ভর্তুকি দিয়ে নতুন করে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য পুনর্নির্ধারণ করার দাবি জানিয়েছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা।

বসুন্ধরা ফুডের বিভাগীয় প্রধান (বিক্রয় ও বিতরণ) রেদোয়ানুর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কারখানাগুলো শতভাগ বিদ্যুিভত্তিক, যার কারণে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি উৎপাদনে পড়ে যাচ্ছে। আরেক দফা উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় রমজানের আগেই আবার বাড়তে পারে পণ্যের দাম। আমাদের উৎপাদন খরচ বাড়লেও ভোক্তার কথা চিন্তা করে আমরা পণ্যের দাম বাড়াতে পারছি না। ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন উদ্যোক্তারা।’

ডলার সংকটে কাঁচামাল আমদানি করতে না পেরে এমনিতেই ক্ষতির মুখে আছেন স্টিল শিল্পের উদ্যোক্তারা। তার মধ্যে গত দুই মাসে তিন দফা বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে এ খাতের উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএম) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও শাহরিয়ার স্টিল মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সম্প্রতি গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এরই মধ্যে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এখন নতুন করে আরো ৫ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানোতে উৎপাদন খরচ বাড়ায় আরেক দফা বাড়বে রডের দাম। দাম বাড়ানোর পরও এখনো কারখানাগুলোতে রেশনিং করে এক দিন বন্ধ রাখা হচ্ছে। দাম বাড়ানোর পরও যদি লোডশেডিং হয় তাহলে তো আমাদের উৎপাদন খরচ আরো ১০ শতাংশ বেড়ে যাবে, যা ভোক্তার ওপর গিয়েই পড়বে।’ তিনি বলেন, ‘গ্যাসের দাম বাড়িয়েও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দিচ্ছে না। আমাদের কারখানার তিনটি ইউনিটের মধ্যে দুটিই বন্ধ রাখতে হয় গ্যাসের সংকটে। আর যে ইউনিট চালু আছে সেটিও দিনের বেলা চালানো যায় না, শুধু রাতের বেলা চালাতে হয়। দাম বাড়ার কারণে এখন ভালো গ্রেডের রডের মিল রেট হচ্ছে ৯৫ থেকে ৯৮ হাজার টাকা।’

বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিদ্যুতের দাম বাড়া মানেই হলো উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া। এমনিতেই গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে আমাদের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু সে তুলনায় আমরা পণ্যের দাম বাড়াতে পারছি না। এরই মধ্যে আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে পণ্যের দাম কিছুটা হলেও বাড়বে, যার প্রভাব ভোক্তার ওপর গিয়েই পড়বে।’
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘গত এক বছরে সব ধরনের কাঁচামালের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে বারবার বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। এতে আমাদের উৎপাদনের সক্ষমতা কমছে এবং আমরা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতাও হারাচ্ছি।’

জানতে চাইলে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যদিও এভাবে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে, তার পরও বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের এই উদ্যোগ মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।’

অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এমনিতেই এখন মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। বারবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। ফলে চাপে থাকা ভোক্তারা আরো চাপে পড়বে।’

উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার বিদ্যুতের ৫ শতাংশ দাম বাড়ার আগে গত ৩০ জানুয়ারি ও ১২ জানুয়ারিতে গ্রাহক পর্যায়ে আরো দুই দফা বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। দুই মাসে তিন দফায় ১৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে এই সময়ে পাইকারি পর্যায়েও ৮ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়, যা যথাক্রমে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ থেকে কার্যকর হয়। গত ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বিদ্যুতের পাইকারি দাম ১৯.৯২ শতাংশ বাড়িয়েছিল। সেটি গত ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। এদিকে গত ১৮ জানুয়ারি শিল্প, বাণিজ্যিক ও বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটারে সর্বোচ্চ ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। গ্যাসের বর্ধিত দরও ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। আগে কখনোই এত কম সময়ের মধ্যে ঘন ঘন গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়েনি।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/03/02/1257138