২ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৩:৩১

দীর্ঘ হচ্ছে মানুষের সারি, বিশৃঙ্খলা

 দফায় দফায় তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। এক বছরের ব্যবধানে নিত্যপণ্য ও সেবার দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। এর বিপরীতে বাড়েনি মানুষের আয়। জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকে বাধ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছেন ওএমএস’র লাইনে। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে কিনছেন সাশ্রয়ী মূল্যের পণ্য। দিন দিন বড় হচ্ছে ওএমএস’র ট্রাকে দাঁড়ানো মানুষের সারি। কিন্তু সেখানে আরেক যুদ্ধ। শৃঙ্খলা না থাকায় চাহিদা অনুযায়ী পণ্য মিলছে না। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর খালি হাতে ফিরছেন অনেকে।
এদিকে ওএমএস’র পণ্য কিনতে ক্রেতার জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি (এনআইডি) নিচ্ছেন কোনো কোনো ডিলার। অন্যথায় তাদের পণ্য দেয়া হচ্ছে না।

তাই বাধ্য হয়ে এনআইডি কার্ডের ফটোকপি জমা দিচ্ছেন ক্রেতারা। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা প্রতিরোধে কার্ডের মাধ্যমে ওএমএস’র (খোলাবাজারে বিক্রি) চাল ও আটা বিক্রির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভুক্তভোগীরা জানান, পণ্য নিতে এনআইডি কার্ড জমা দেয়া লাগছে।

ওএমএস’র এলাকা রেশনিং কর্মকর্তা (ডি-৪) মনিরুল ইসলাম জানান, ওএমএস’র পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতাদের এনআইডি কার্ড নেয়া বাধ্যতামূলক নয়। আমরা ডিলারদের বলে দিয়েছি এনআইডি কার্ড নিতে হবে না। কিন্তু কোনো কোনো ডিলার হয়তো নিচ্ছে। এনআইডি কার্ড ছাড়া অনেককে পণ্য দেয়া হয় না- এই সুযোগ নিচ্ছে ডিলারা। এটা অনুচিত।

মুগদা ও বাসাবোসহ বেশ কয়েকটি এলকায় ওএমএস’র চাল তদারকের দায়িত্বে থাকা আবু আহমেদ বলেন, এনআইডি কার্ড নিয়ে পণ্য দেয়া হচ্ছে। এনআইডি কার্ড নিচ্ছি লাইন ঠিক করার জন্য। ভোটার ছাড়া যারা তাদের আমরা দেই না। দেয়া নিষেধ। ভোটার ছাড়া কেন পণ্য দেয়া হয় না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক সময় লাইনে একই পরিবারের অনেকেই দাঁড়ায়। বাবা-মায়ের সঙ্গে তার সন্তানও লাইনে দাঁড়ায়। তখন এক পরিবারে ৩ জন পণ্য নেয়। তাই একটা পরিবার থেকে যাতে ১ জন পণ্য নিতে পারে সেজন্য আমরা এনআইডি নিচ্ছি।

বাসাবো খেলার মাঠ সংলগ্ন ওএমএস’র ট্রাক ডিলার এনামুল হক বলেন, আমরা এনআইডি কার্ড নিচ্ছি আটার জন্য। চালের জন্য লাগে না। অফিস থেকে নির্ধারণ করে দিচ্ছে আমাদের। আমাদের থেকে পণ্যটা যে নিলো সেটার প্রমাণ। এটা অফিসে জমা থাকে।

রাজধানীর মুগদা বিশ্বরোডে ওএমএস’র ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে এসে উষ্মা প্রকাশ করেন মো. ফিরোজ। বলেন, ডিলাররা ভোটার আইডি নিচ্ছে। ওএসএস’র পণ্য নেয়ার জন্য ভোটার আইডি নেয়ার তো কোনো প্রয়োজন নেই। নিয়মিত ক্রেতা হিসেবে কার্ড করার জন্য এনআইডি নিতে পারে। কিন্তু প্রতিদিন পণ্য কেনার জন্য এনআইডি কার্ড নেয়া তো ঠিক না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দরিদ্র মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য সরকার খাদ্য অধিদপ্তরের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ওএমএস’র ট্রাকের মাধ্যমে সুলভমূল্যে চাল ও আটা বিক্রি করছে। কিন্তু ওএমএস’র চাল-আটা পেতে সাধারণ মানুষকে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও অনেকেই চাল পাচ্ছেন না। অনেকে চাল-আটার জন্য আগের দিন রাত থেকেও লাইনে দাঁড়ানোর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। ওএমএসে চাল-আটা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। ফলে শত শত দরিদ্র মানুষ ওএমএস’র চাল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন ফিরোজ। তার মাসিক আয় ৩০ হাজার টাকা। ৪ জনের পরিবার তার একার আয়েই চলে। প্রতিমাসে ১২ হাজার টাকা ঘরভাড়া ও বাজার খরচের জন্য আরও ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়। তার ২ ছেলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। তাদের জন্য মাসে ৩ হাজার টাকা খরচ হয়। ফিরোজ জানান, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে খুবই টানাপড়েনে সংসার চালাতে হচ্ছে তার। তাই প্রথমবারের মতো ওএমএস’র পণ্য নিতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন, ট্রাকের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। লজ্জা করছে। কিন্তু তাও বাধ্য হয়ে কিনতে হচ্ছে।

রায়েরবাজার মেরী স্টোপসের সামনে সকাল থেকে ওমএসএস’র চাল-আটা দেয়া হচ্ছে। লম্বা লাইনে কোনো কাগজপত্র ছাড়াই পণ্য মিলছে। তবে দীর্ঘ লাইন হওয়ায় বেশ বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে। নারীদের লাইনে বারবার ধাক্কাধাক্কি লক্ষ্য করা গেছে। লাইনে টিকে থাকতে নারীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। বৃদ্ধদের ধাক্কা মেরে লাইন থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে। ডিলাররা নানা চেষ্টায়ও লাইন ঠিক করতে পারছেন না।

কমেলা বেগম নামের এক নারী জানান, আমি সকালে আসছি। কয়েকবার লাইনে দাঁড়িয়ে নিতে পারিনি। ধাক্কা খেয়ে ফেরত আসছি। তিনি বলেন, অনেকে প্রতিদিন এসে চাল নেয়। আর আমরা একদিন এসেই পাই না। খালি হাতে ফিরে যাই। আসলে এরা মুখ চিনে চিনে চাল দেয়। কেউ কেউ একদিনে দু’বার করেও নিতেছে। কিন্তু আমি সেই সকাল থেকে এসে বসে আছি, এখনো নিতে পারিনি।

এদিকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একাধিক নারী-পুরুষ জানান, তাদের কেউ কেউ সকাল ৭-৮ থেকে অপেক্ষা করছেন। নির্ধারিত স্থানে ট্রাক দেরিতে পৌঁছায়। লাইনে দাঁড়ালেও সবার ভাগ্যে চাল-আটা জোটে না। কেউ কেউ চাল পেলেও অনেকে আটা পাননি। প্রতিদিনই অনেককে খালি হাতে ফিরতে হয়। তবে বিক্রয়কর্মীদের কিছু বাড়তি টাকা দিলেই বেশি পণ্য দেয়া হয় বলে অভিযোগও রয়েছে। এ ছাড়া পরিচিত লোকদের কাছে কৌশলে পণ্য বিক্রি করে দেন ডিলারের কর্মীরা এমন তথ্য দিয়েছেন ক্রেতারা।

চাল নিতে আসা রাবেয়া বেগম মানবজমিনকে বলেন, আমি দু’বার এসে ফেরত গেছি। গত বৃহস্পতিবার রোববার দুই দিন লাইনে দাঁড়িয়েও কিনতে পারিনি। আজকে সকাল ৭টা থেকে এখানে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। তবে ট্রাক আসতে দেরি হয়েছে। প্রায় পৌনে ৪ ঘণ্টা অপেক্ষার পর পণ্য কিনতে পেরেছেন বলেও জানান তিনি।

এনআইডি কার্ড লাগছে কি-না জানতে চাওয়া হলে মকবুল শেখ নামের এক বৃদ্ধ বলেন, আমগো খবর দিছে আমরা চলে আসছি। কিছু লাগবে এমন কিছু জানানো হয়নি। তবে এসে দেখি কিছুই লাগছে না। লাইনে দাঁড়াইছি টিপসই নিয়ে ৫ কেজি চাল আর ৩ কেজি আটা দিচ্ছে। সব জায়গায় কথা বলে জানা যায়, ৩০ টাকা কেজি দরে জনপ্রতি ৫ কেজি করে চাল দেয়া হচ্ছে। ২৫ টাকা কেজি দরে জনপ্রতি ৫ কেজি খোলা আটা ও প্রতি প্যাকেট আটা ৫৫ টাকা দরে জনপ্রতি ৪ প্যাকেট আটা দেয়া হচ্ছে।
মগবাজার নয়াটোলা এলাকায় টিসিবি’র একটি দাঁড়ানো গাড়ির কাছে এক রিকশাচালক নিজে নিজেই বেশকিছুক্ষণ ক্ষোভ ঝাড়লেন। পাশে দাঁড়ানো আরেক রিকশাওয়ালা খায়রুল বলেন, দুপুর থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে পাইছি ৪৭০ টাকা। এরমধ্যে মালিককে দিতে হবে ১২০ টাকা। পরিবারে সদস্য ৬ জন। তিনবেলা খেতে দিনে চাল লাগে ৩ কেজি। দিনকে দিন চালের দাম বাড়ছে। ৫০-৬০ টাকার কমে কোনো তরকারি পাওয়া যায় না। ডাল, তেল, পিয়াজ সবকিছুরই বাজার চড়া।

ওএমএস’র বিক্রয়কেন্দ্রের সামনে কথা হয় চাল কিনতে আসা বিলকিস বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, সকাল ৯টা থেকে বিক্রয়কেন্দ্রর সামনে দীর্ঘ লাইন। দু-ঘণ্টা অপেক্ষা করে তিনি ৫ কেজি চাল কিনেছেন। তাতে তার ১০০ টাকা সাশ্রয় হয়েছে। তিনি জানান, ওএমএস’র চাল তিনি প্রতি সপ্তাহে কেনেন। কখনো কখনো বরাদ্দ কম থাকায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েও চাল পান না। তখন বাধ্য হয়ে বাজার থেকে চড়াদামে কিনে খেতে হয়।

মীরবাগ এলাকার বাসিন্দা নাজিমুল মধুবাগ বাজারে একটি চায়ের দোকান চালান। টিসিবি’র লাইনে কেন জবাবে নাজিমুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, কী করবো বলেন, চাল-আটা কিনলেই তো পকেটে টাকা থাকে না। নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে মানুষের আয় বাড়ছে না, অথচ ব্যয় হু হু করে বাড়ছে।

কথা হয় অটোরিকশাচালক হাবিবের সঙ্গে। কিছু টাকা বেশি আয়ের জন্য আগে আগে বের হন তিনি। ৭ সদস্যের সংসার তার। অটোরিকশার আয়ে পুরো সংসার চলে তার। কয়েক মাসের ব্যবধানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কয়েক দফা বাড়ায় চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি। হাবিব বলেন, সারাদিন অটোরিকশা চালিয়ে যখন বাজারে যাই, তখন চোখে পানি চলে আসে। সারাদিনে যা ইনকাম হয় তার মধ্যে অটোরিকশার চার্জ হিসেবে দিতে হয়। সারাদিন রাস্তায় থাকলে, আরও কিছু খরচ হয়। দিন শেষে ৫০০ টাকার মতো হাতে থাকে। এই টাকা নিয়ে বাজারে শাকসবজি কিনতেই ২০০ টাকা চলে যায়। বাকি টাকায় কীভাবে চাল ও ডাল কিনবো। তিনি বলেন, চাল-ডাল থেকে তেল-নুন সব কিছুর দাম বেশি। যা আয় করি তা দিয়ে এখন চলা যায় না। কাজ শেষে যাওয়ার সময় রাস্তায় কমদামে যে সবজি পাই তাই কিনে নেই।

মধুবাগ বাজারের পাশে বিক্রয়কেন্দ্র ফারুক ট্রেডার্সের মালিক ফারুক জানান, আগে মানুষ এসব এতো বেশি কিনতো না। কিন্তু এখন প্রচুর বিক্রি বেড়েছে। সে তুলনায় বরাদ্দ না পাওয়াতে সমস্যা হচ্ছে। অনেকে এসে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমার এখানে কেউ একবারের বেশি দুই বার নিতে পারে না। কারণ আঙুলের ছাপ নেয়া হয়। নিলে অ্যাপে ধরা পরে। আর জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া কাউকে পণ্য দেয়া হয় না। কারও না থাকলে সেক্ষেত্রে পরিবারের যে কোনো একজনের হলেই পণ্য দেয়া হয়। তবে বর্তমানে একজন ডিলার সর্বোচ্চ দেড় টন চাল ও এক টন আটা বরাদ্দ পান। যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম।
সরজমিন দেখা গেছে, অনেকেই ওএমএস’র চাল ও আটা বিক্রি শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই নির্ধারিত স্থানে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। ডিলার অথবা ট্রাকসেল সবখানেই এখন দীর্ঘ লাইন দিয়ে বিক্রি হচ্ছে পণ্য। অনেক জায়গায় পণ্য নিতে হুড়োহুড়ি করছে মানুষ। এরপরও চাল কিনতে পারলে খুশি তারা। আরজিনা নামের একজন বয়স্ক নারী বলেন, এখান থেকে চাল কিনতে পারলে ১০০ টাকা কম দাম পড়ে, আটায় ৬০ টাকা। আমরা গরিব মানুষ। এটা আমাদের জন্য অনেক।

https://mzamin.com/news.php?news=44918