২ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৩:২৩

চাপে পড়বে ভোক্তা উৎপাদক ও রপ্তানিকারক

মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে

এমনিতেই দেশের অর্থনীতি চাপে রয়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয়ে নাভিশ্বাস মানুষ। এরপর বিদ্যুতের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ পুরো অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বাড়বে বিভিন্ন পণ্য ও সেবামূল্য। রমজান সামনে রেখে এ সিদ্ধান্তে মানুষ আরও বেশি বিপদে পড়বে। অর্থাৎ ভোক্তা, উদ্যোক্তা, উৎপাদক, রপ্তানিকারক-সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এসব কথা বলেন।

তাদের মতে, বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে এ খাতে দুর্নীতি কমানো জরুরি। এছাড়াও অর্থনৈতিক কৌশল, নীতি এবং ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে।

প্রসঙ্গত, খুচরা পর্যায়ে আবারও বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। আর এ নিয়ে চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে তিন দফায় দাম ১৫ শতাংশ বাড়ল। এর আগে ৩১ জানুয়ারি এবং ১২ জানুয়ারি দাম বাড়ানো হয়। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত বাস্তবায়নে এ সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এছাড়াও গত বছরের ২১ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানো হয়। ওই সময়ে ইউনিটপ্রতি ৫ দশমিক ১৭ টাকা থেকে বেড়ে ৬ দশমিক ২০ টাকায় নির্ধারিত হয়। সামগ্রিকভাবে সবকিছুরই প্রভাব পড়ছে সাধারণ ভোক্তার ওপর। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, কিন্তু কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। একই সঙ্গে সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপের সৃষ্টি হয়েছে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ এমন একটি পণ্য, যার সঙ্গে দেশের সব মানুষ জড়িত। আর এই পণ্যটির দাম বাড়ালে সবকিছুর ওপর প্রভাব পড়ে। তিনি বলেন, এমনিতেই দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে। এরপর বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে নিু-আয়ের মানুষের সক্ষমতা আরও কমবে। তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে সরকারের ভর্তুকি হয়তো কিছুটা কমতে পারে; কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বাড়বে। এছাড়াও বাড়বে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন খরচ। এ কারণে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। মির্জ্জা আজিজ বলেন, এতে আরেকটি সমস্যা হবে। পণ্যের উৎপাদন খরচ যতটা বাড়বে, ব্যবসায়ীরা দাম এর চেয়ে আরও বাড়িয়ে দেবে। তিনি বলেন, এমনিতেই ক্ষুদ্র আয়ের মানুষ বিপদে রয়েছে। নতুন সিদ্ধান্তে আরও বিপদে পড়বে। মির্জ্জা আজিজ মনে করেন, বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে বিকল্প পদক্ষেপ নেওয়া যেত। সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা এবং দুর্নীতি কমালে দাম সমন্বয় হতো। সেটি না করে জনগণের ওপর দায় চাপানো হয়েছে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এমন একসময় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো, যখন মূল্যস্ফীতি চাপে রয়েছে। তিনি বলেন, গত দুই মাসে বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশ বাড়ানোয় অবশ্যই ভোক্তারা চাপে পড়বে। তবে এ খাতে ভর্তুকি ও দায়দেনা পরিস্থিতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকার যে ভর্তুকি কমানোর কথা বলেছে, সেটি তাৎক্ষণিক কৌশল হতে পারে। কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হওয়া উচিত নয়। তার মতে, জ্বালানির ক্ষেত্রে কৌশল, ব্যবস্থাপনা ও পলিসি-সবকিছুতেই পরিবর্তন আনতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা বাড়ানো এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানির কার্যকর পলিসি দরকার। না হলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাও দুর্বল হয়ে যাবে। ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভোক্তা, উদ্যোক্তা, উৎপাদক ও রপ্তানিকারক-সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় বাড়িয়ে ভতুর্কি দেওয়ার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়িয়ে উৎপাদন ব্যয় কমানো জরুরি। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় বাড়িয়ে ভর্তুকি দেওয়ার সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার মেনুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে বলেন, ইতোমধ্যে বিদ্যুতের দাম যেভাবে বাড়ানো হয়েছে, তা বহন করা আমাদের জন্য কঠিন। কারণ, এই ব্যয় আমাদের সক্ষমতার বাইরে। তিনি বলেন, এর আগে যখন ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল, তখন আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। ওই সময়ে বলেছিলাম, এই দাম বৃদ্ধি যেন এখানেই সীমাবদ্ধ থাকে। প্রতিমাসে যেন ৫ শতাংশ করে বাড়ানো না হয়। কিন্তু বর্তমানে সেটিই হচ্ছে। প্রতিমাসেই ৫ শতাংশ করে বাড়ানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়লে এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক সবকিছুর দাম বাড়ে। সামগ্রিকভাবে যা পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেয়। ফলে সবাইকে এর মূল্য পরিশোধ করতে হয়।

জানতে চাইলে দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইখতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, এভাবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি কাম্য নয়। তবে দাম আরেক দফা বাড়ানো হলেও অবাক হব না। কারণ, বিদ্যুৎ খাতটি দেশি-বিদেশি কিছু মানুষের কাছে জিম্মি। তিনি বলেন, এখানে বিনিয়োগকারী, উৎপাদক এবং আইএমএফ-এই তিনের সংমিশ্রণে সরকারও নিরুপায়। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান উৎপাদনক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এজন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে আইএমএফ থেকে সরকার সাম্প্রতিক সময়ে যে ঋণ নিয়েছে, এর অন্যতম শর্ত হলো বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমাতে হবে। এজন্য দাম না বাড়িয়ে উপায় নেই। আর এর সবকিছুর মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

জানা যায়, বর্তমানে নানা ধরনের চাপে রয়েছে দেশের অর্থনীতি। করোনার প্রভাব শেষ না হতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হয়। এ কারণে একদিকে আমদানি ব্যয় বেড়েছে, অপরদিকে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমেছে। যে কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যা জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধিসহ পুরো অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে। এর মধ্যে রমজানের আগেই বিদ্যুতের আরেক দফা দাম বাড়ানো হলো, যা ভোক্তা, উৎপাদক ও রপ্তানিকারক-সবাইকে চাপে ফেলবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/650358