২ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৩:১৮

প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্বলতা

বাস্তবায়নে দক্ষতার প্রকট ঘাটতি ও অসক্ষম ঠিকাদার

১০১টি প্রকল্পে কোনো কাজ হয়নি এক বছরে

 প্রকল্প বাস্তবায়নে কর্মকর্তাদের দক্ষতার প্রকট ঘাটতি, প্রকল্পের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জাবাবদিহিতার অভাব, ক্রয় কার্য প্রক্রিয়াকরণে দীর্ঘসূত্রতা, একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সক্ষমতার অতিরিক্ত কাজ দেয়া এবং অনেক ক্ষেত্রে মূল ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ ছোট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়ে থাকে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি কাজের গুণগত মান ঠিক থাকছে না। এ ছাড়া বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেও প্রকল্পগুলোর সময় ও খরচ বাড়ছে। সম্ভাব্যতা যাচাইও সঠিকভাবে করা হয় না বলে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন (আইএমই) বিভাগের কাছে ধরা পড়েছে। এক হাজার পাঁচ কোটি টাকার ৯৪টি প্রকল্পের কোনো আর্থিক অগ্রগতি নেই। আর বাস্তবে কোনো কাজ হয়নি এমন প্রকল্পের সংখ্যা হলো ১০১টি।

বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন (আইএমই) বিভাগ সম্প্রতি গত অর্থবছরের এডিপির প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দুর্বলতাগুলো প্রকাশ করেছে।

প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আওতায় বাস্তবায়নাধীন এক হাজার ৮৩৬টি প্রকল্পের মধ্যে ৭৫১টি প্রকল্পের (মোট প্রকল্পের ৪০.৯০ শতাংশ) আর্থিক এবং ৭৮১টি প্রকল্পের (মোট প্রকল্পের ৪২.৫৪ শতাংশ) বাস্তব অগ্রগতি প্রশংসনীয় বা শতভাগ। ৪৭৩টি প্রকল্পের (মোট প্রকল্পের ২৫.৭৬ শতাংশ) আর্থিক এবং ৩৫১টি প্রকল্পের (মোট প্রকল্পের ১৯.১২ শতাংশ) বাস্তব অগ্রগতি সন্তোষজনক। ২০৭টি প্রকল্পের (মোট প্রকল্পের ১১.২৭শতাংশ) আর্থিক এবং ২২৭টি প্রকল্পের (মোট প্রকল্পের ১২.৩৬ শতাংশ) বাস্তব অগ্রগতি মোটামুটি সন্তোষজনক। ২৪৪টি প্রকল্পের (মোট প্রকল্পের ১৩.২৯%) আর্থিক এবং ৩০৭টি প্রকল্পের (মোট প্রকল্পের ১৬.৭২%) বাস্তব অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়।

আর ৯৪টি প্রকল্পে আর্থিক অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। এসব শূন্য আর্থিক অগ্রগতিসম্পন্ন প্রকল্পে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ এক হাজার চার কোটি ৯১ লাখ টাকা। বলা হচ্ছে, অর্থ ছাড় না হওয়া বা দেরিতে অর্থ ছাড় হওয়া, ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়া, দরপত্র আহ্বানে বিলম্ব, দরপত্র রেসপন্সিভ না হওয়া, প্রকল্পের ঋণ না পাওয়া, অপ্রতুল বরাদ্দ, মামলাজনিত সমস্যা, ডিপিপি সংশোধন, আরডিপিপি অনুমোদনে বিলম্ব হওয়া, দাতা সংস্থার সাথে চুক্তি সম্পাদনে বিলম্ব, কোভিড-১৯-এর প্রভাব ইত্যাদির কারণে কোনো অগ্রগতি হয়নি। অপর দিকে অর্থবছরে শূন্য বাস্তব অগ্রগতিসম্পন্ন প্রকল্পের সংখ্যা ১০১টি। ৫৩টি প্রকল্পের অনুকূলে এক লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা ছিল, যার বিপরীতে ১২টি প্রকল্প ব্যতীত কোনো আর্থিক অগ্রগতি হয়নি। বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনার তথ্য থেকে জানা গেছে, কর্মপরিকল্পনা এবং ক্রয় পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। মাঠপর্যায়ে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। প্রকল্পের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব বিদ্যমান। প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য নিয়মিত পিআইসি ও স্টিয়ারিং কমিটির সভা করা হয় না।

দেখা যায়, প্রকল্পের ক্রয় কার্য প্রক্রিয়াকরণে দীর্ঘসূত্রতা প্রায় সব প্রকল্পের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য। যার ফলে আবশ্যিকভাবে অবকাঠামো উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোয় ক্ষেত্রভেদে ক্রয় কার্য প্রক্রিয়াকরণে প্রায় দুই থেকে চার বছর অতিরিক্ত সময় লাগছে। এ ছাড়া স্বজনপ্রীতির কারণে একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সক্ষমতার অতিরিক্ত কাজ পাওয়ায় সময়মতো কাজ শুরু ও শেষ করতে পারে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ ছোট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়ে থাকে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হচ্ছে। কার্যাদেশ প্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্যাকেজের কাজ শেষ না করে বারবার সময় বৃদ্ধির আবেদন করে, যা বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি করে।

আইএমইডি বলছে, অবকাঠামো উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের কাজে অবকাঠামোর গুণগতমান নিশ্চিতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগার ও যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা রয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা সাধারণ বিষয়। কিছু ক্ষেত্রে অধিগ্রহণকৃত জমি বন বিভাগের হওয়ায় সমন্বয়ের দুর্বলতার কারণে গাছ কাটায় জটিলতা রয়েছে। ইউটিলিটি স্থানান্তরে দীর্ঘসূত্রতা এবং রিসেটেলমেন্ট ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কাজে জটিলতা এবং বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত করছে। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন সংস্থার জনবল সঙ্কট। অনেক সংস্থার নিজস্ব কোনো নকশা ডিজাইন ইউনিট না থাকায় অনেক সমস্যা হচ্ছে (যেমন : বাংলাদেশ রেলওয়ে)। অনেক সংস্থার আলাদা কোনো উন্নয়ন বা প্রকল্প পরিবীক্ষণ ইউনিটও নেই।

জানা গেছে, প্রকল্প অনুমোদনের পর প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে বিলম্ব হচ্ছে। একজন কর্মকর্তা একাধিক প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব পালন, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন করা এবং প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্প বাস্তবায়নে জড়িত জনবলের পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় অনেকসময় প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতার ঘাটতি প্রকট। বেশির ভাগ প্রকল্প পরিচালক এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাবের কথা জানিয়েছেন। প্রণোদনা না থাকায় তাদের কাজ করার উৎসাহ কম।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/731448