২ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৩:১৬

নীরব চাঁদাবাজি দেশজুড়ে

নারায়ণগঞ্জের এক অটোরিকশাচালক মেহেদি। যাত্রী নিয়ে আশপাশের প্রায় সব উপজেলা ও পৌরসভাতেই তার যাতায়াত। যাত্রী নিয়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে গিয়ে প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন এই চালক। শুধু মেহেদিই নয়; তার মতো হাজার হাজার গাড়িচালক প্রতিদিন চাঁদাবাজির শিকার।

রাজধানীর ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার এলাকার আলতাফ জানালেন আরো ভয়ঙ্কর তথ্য। স্টাফ কোয়ার্টার থেকে একটি অটোরিকশা যাত্রাবাড়ীর মৃধাবাড়ি এলাকায় আসতে পথে চার স্থানে চাঁদা দিতে হয়। ৪-৫ কিলোমিটার এই পথটুকুতে প্রথমে ৩০ টাকা চাঁদা দিতে হয় স্টাফ কোয়ার্টার স্ট্যান্ডে, মাঝে বামইলে ৩০ টাকা, কোনাপাড়ায় ৩০ টাকা, আর সর্বশেষ মৃধাবাড়িতে দিতে হয় ৩০ টাকা। লাইনম্যান নামধারী কিছু লোক এই চাঁদা উত্তোলন করলেও এই টাকার ভাগ নাকি অনেক ওপরে যায়!

মেহেদি বলেন, গাড়ি নিয়ে তিনি নারায়ণগঞ্জের বাইরে সোনারগাঁও, রূপগঞ্জ, পাগলা, ফতুল্লা এমনকি নরসিংদীর মাধবদী, শিবপুর পর্যন্ত যান। কিন্তু কোথাও গিয়ে তিনি চাঁদা না দিয়ে আসতে পারেননি। এক এলাকায় চাঁদা দিয়ে আরেক এলাকায় প্রবেশ করেই চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন। পৌরকর, যানবাহন পার্কিংকর ইত্যাদির নামে এই চাঁদাবাজি চলে। তিনি বলেন, ১০-২০ টাকা হারে এই চাঁদা নেয়া হয়। চাঁদা নিয়ে রসিদও দেয়া হয় বৈধতার জন্য। মেহেদি বলেন, একটি গাড়ি যখন এভাবে ৫-১০ স্থানে চাঁদাবাজির শিকার হয় তখন চালকরা কিভাবে চলবে? কত টাকাই না তারা ইনকাম করে? তিনি বলেন, শুনতে মনে হয় ১০-২০ টাকা। কিন্তু একজন চালক যদি ১০টি স্থানে চাঁদাবাজির শিকার হয়; তবে তার পকেট থেকে যাবে ১০০-২০০ টাকা, যা দিয়ে দিনের চালের টাকা হয়ে যায় একজন চালকের।

রাজধানীর ডেমরা থেকে যাত্রাবাড়ী রুটে যাতায়াতকারী বেশির ভাগ লেগুনার পেছনে কোনো নম্বর প্লেট নেই। কোনো কোনোটির সামনে নম্বর প্লেট ঝুললেও তা কারো চোখে পড়ার মতো নয়। এমনই একটি গাড়ি যার নম্বর ঢাকা মেট্রো ছ-১১-৩২০২। গাড়িটির পেছনে কোনো নম্বর প্লেট নেই। সামনে তাকাতে দেখা যায় আবছা লেখায় একটি নম্বর প্লেট রয়েছে। চালক জানালেন, এই রুটে গাড়ি চালাতে কোনো নম্বর প্লেট লাগে না। টাকা দিয়ে তারা গাড়ি চালান, নম্বর প্লেট লাগবে কেন? ওই চালক বলেন, এই রুটে যে লেগুনাগুলো চলে তার অধিকাংশই চলাচলের উপযুক্ত নয়। নারায়ণগঞ্জ, নরসংদী এমনকি, সিলেট মেট্রোর গাড়িও চলছে। যেগুলো ঢাকায় প্রবেশেরই কথা নয়। নাম প্রকাশে অনিচচ্ছুক একাধিক চালক বলেন, এই রুটের লেগুনা, সিএনজি ও অটোরিকশা থেকে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার কিছু মানুষ নিয়মিত চাঁদা নেয়।

‘গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান’ এই স্টিকারের আড়ালে পোস্তগোলা এলাকায় টোকেন চাঁদাবাজি চলছে। প্রতিটি স্টিকার বাবদ নেয়া হচ্ছে দুই হাজার টাকা। এই এলাকায় প্রায় তিন হাজার সিএনজি অটোরিকশা রয়েছে। এই গাড়িগুলো রাস্তায় চলতে গেলেই এই স্টিকার লাগবে। এই স্টিকার না থাকলে কোনো গাড়ি রাস্তায় চলতে দেয় না সঙ্ঘবদ্ধ চাঁদাবাজরা। চালকদের করা হয় মারধর। আলম ওরফে দিগম্বর আলম নামের এক ব্যক্তি এই চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে জানা যায়। তিনি বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতুর ইজারাদার ছিলেন। সম্প্রতি ওই ব্রিজের ইজারা তুলে দেয়া হয়। কিন্তু সরকারিভাবে ইজারা তুলে নেয়া হলেও যানবাহন মালিক-চালকরা ঠিকই ব্রিজের উপরে ও নিচে চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন বলে একাধিক চালক জানিয়েছেন। ইজারাদার থাকাকালীনই আলম টোকেন দিয়ে সিএনজি অটোরিকশা থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেন।

ভুক্তভোগীরা বলেন, সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে পরিবহন সেক্টর। রাজধানীসহ সারা দেশের ফুটপাথগুলোতেও চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি আবুল কাসেম বলেন, ফুটপাথের চাঁদাবাজি আরো বেপরোয়াভাবে শুরু হয়েছে। আগে ছোটখাটো চাঁদাবাজরা ফুটপাথ থেকে চাঁদা তুলত। এখন প্রকাশ্যে রাঘববোয়ালরা রাস্তা থেকে চাঁদা নেয়। এমনকি, আদালত কর্তৃক নিষিদ্ধ সংগঠনের নামেও চাঁদাবাজি চলছে। আবুল হোসেন, হারুনুর রশিদ ও সাইফুল মোল্লাসহ অনেকেই এই চাঁদাবাজির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, চাঁদাবাজদের কারণে দিশেহারা হকাররা। তিনি চাঁদাবাজি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ দাবি করেন। ঢাকা জেলা হকার্স লীগের সাধারণ সম্পাদক আজহারুল ইসলাম বলেন, চাঁদাবাজির কারণে হকাররা দিশেহারা। হকারদেরকে বাধ্য করা হচ্ছে চাঁদা দিতে।

রোড সেইফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, সড়ক সেক্টরে গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রধান বাধা হচ্ছে চাঁদাবাজি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতার কারণে এই সেক্টরে ব্যাপক চাঁদাবাজি চলছে। সরকারকেই এই চাঁদাবাজি বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে; যদি সড়ক সেক্টরে তারা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চায়।

তেজগাঁও সড়ক ও জনপদ সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফের কক্ষ থেকে তুলে নিয়ে জহির নামের এক ঠিকাদারকে গত মঙ্গলবার বিকেলে মারধর করা হয়। জাফর ও স্বপনের নেতৃত্বে চাঁদার জন্য তাকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ দিকে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা চাঁদাবাজির বিষয়ে বলেন, যেসব ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসছে সেসব বিষয়গুলো তারা দেখছেন, ব্যবস্থা নিচ্ছেন। অভিযোগ না পেলে তাদেরতো কিছু করার নেই।

এ দিকে চট্টগ্রাম নগরে পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। সড়কে প্রকাশ্যে লাঠি হাতে গাড়ি আটকিয়ে তারা চাঁদাবাজি করছে। চাঁদা না পেয়ে মারধরও করছে এসব লাঠিয়াল বাহিনী। নগরের কাপ্তাই রাস্তার মোড়, চকবাজার, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, বন্দর, নিউ মার্কেট এলাকায় চাঁদাবাজির স্পট দখল-বেদখল নিয়ে চলে চাঁদাবাজ গ্রুপগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ ও সঙ্ঘাত। সড়কপথে এমন বিশৃঙ্খলা ঠেকানোর যেন দায় নেই কারো।

অভিযোগ রয়েছে, নগরের কাপ্তাই রাস্তার মোড়ে লাঠি হাতে সড়কের পাশে বসে থাকেন আজাদ, মুজিব, হাতপোড়া আরিফ ও রাসেল। ট্রাক, পিকআপ, সিএনজি বা ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোরিকশা আসতে দেখলেই সড়কে নেমে পড়ে। এরপর যানবাহনগুলোর গতিরোধ করে একটি নির্দিষ্ট টিকিট দিয়ে চাঁদা নেন। কেউ সেই টাকা দিতে না চাইলে বা অপারগতা প্রকাশ করলে আটকে রাখা হয় গাড়ি, দেখানো হয় ট্রাফিক পুলিশ দিয়ে মামলা দেয়ার ভয়। এই চাঁদা আদায় করা হয় চট্টগ্রাম অটোরিকশা অটোটেম্পো চালক সমন্বয় পরিষদ নামের শ্রমিক সংগঠনের ব্যানারে। এর একটি অংশ ট্রাফিক পুলিশ, থানা পুলিশ, স্থানীয় যুবলীগ, শ্রমিক লীগের নেতা, সন্ত্রাসী ও সড়ক সংশ্লিষ্টদের পকেটে যায়।

চট্টগ্রাম নগরের উল্লেখযোগ্য চাঁদাবাজি হয় চকবাজার এলাকায়। চকবাজার কাঁচাবাজারের পাশেই টমটম গাড়ির স্ট্যান্ড। সেখান থেকে বাকলিয়া রাহাত্তারপুল ও আন্দরকিল্লায় যায় গাড়ি। প্রতিটি গাড়ি থেকে দৈনিক ৪০০ টাকা করে নেয়া হয়। সেখান থেকে ২০০ টাকা ভাগ নেন চকবাজারের চসিক কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা নুর মোস্তফা টিনুর সহযোগীরা। এ ছাড়া চকবাজার থেকে শতাধিক মাহিন্দ্র ও লম্বা টেম্পো আগ্রাবাদ বারেক বিল্ডিং মোড় পর্যন্ত চলাচল করে। কাপ্তাই রাস্তার মোড় থেকে বহদ্দারহাট মোড় হয়ে শতাধিক গাড়ি আমতল শাহ আমানত মার্কেট এলাকায় যায়। এসব গাড়িপ্রতি দৈনিক সাড়ে ৪ শত টাকা করে নেন কাউন্সিলর টিনুর অনুসারী নূরুল হাকিম, আলমগীর মিয়া, শহিদুল ইসলাম জায়েদ, এস এম সামাদ, রবিউল ইসলাম রাজু, মোহাম্মদ শাকিল, মোহাম্মদ রাকিব, সাইফুল ইসলাম, হানিফ, মোরশেদ, রাশেদুল ইসলামসহ ১৫ জনের একটি সিন্ডিকেট। তারা সবাই নিজেদের ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মী পরিচয় দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক গাড়িচালক বলেন, টিনুর অনুসারী চাঁদাবাজদের কারণে সারা দিন গাড়ি চালিয়ে দিন শেষে খালি পকেটে বাসায় ফিরতে হয়। তারা বলেন, প্রতিবাদ করলে নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। নগরের মুরাদপুর এলাকায় যুবলীগ নেতা পারভেজ ও জামাইকে চাঁদা না দিয়ে ট্যাক্সি, টেম্পো ও মাহিন্দ্র এবং ম্যাক্সিমা গাড়িগুলো চলাচল করতে পারে না। প্রতিবার ওই স্পটে গেলে ১০ টাকা হারে চাঁদা দিতে হয়। নগরের বন্দর থানার টোল প্লাজা রোডে গাড়ি রাখলেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ-যুবলীগ নেতাদের তিনটি সিন্ডিকেটকে দিতে হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। নতুন ব্রিজ টু নিউ মার্কেট সড়কে রুট পারমিটবিহীন দুই শতাধিক মাহিন্দ্র, ম্যাক্সিমা ও পিয়াজু গাড়ি চলাচল করে। ওই গাড়িগুলো থেকে চট্টগ্রাম অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের নামে প্রতিদিন ২৫০ টাকা হারে চাঁদা নেন জানে আলমের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীচক্র।

চট্টগ্রাম অটোরিকশা অটোটেম্পো চালক সমন্বয় পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ আজাদ এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, গতিরোধ করা বা ভয়ভীতি দেখানোর বিষয়টি মিথ্যা। যেকোনো সংগঠন চালাতে গেলে কিছু ব্যয় হয়। সেই ব্যয় মেটাতেই যানবাহন থেকে অল্প পরিমাণে ইজারা নেয়া হয়।

সড়কপথে চাঁদাবাজদের সাথে ট্রাফিক পুলিশদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সিএমপির টিআই অ্যাডমিন অনিল চাকমা বলেন, পুলিশের নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজির সুযোগ নেই। ট্রাফিক প্রশাসন এ ব্যাপারে কঠোর মনোভাব পোষণ করেন।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/731415