২ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৩:০৯

সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ে ধারাবাহিক খড়গ!

সামনে রমজান, গরমের মৌসুম। স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। কিন্তু সরকার যেভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে, তাতে কিছুদিন পর পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। রাজধানীর মিরহাজিরবাগের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী তাহমিনা বেগম এই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন।

দুই মাসে তিন বার এবং এক মাসে দুই ধাপে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করেছে সরকার। যার প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক ব্যয়ে। শুধু তাহমিনা নন, তার মতো অবস্থা রাজধানীর অধিকাংশ নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের।

যেমন ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, দফায় দফায় সরকার যে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে, একবারও কি সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করছে? বাজারে এখন সবকিছুর দাম বাড়তি। প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতেই সব টাকা চলে যাচ্ছে, বাড়তি বিদ্যুৎ বিলের বোঝা কীভাবে সামাল দেব?

পেশায় ব্যাংকার শামসুল আরেফিন পরিবার নিয়ে বসবাস করেন ধানমন্ডির সোবহানবাগে। তিনি বলেন, গত এক বছর ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে বাড়িভাড়া, গাড়িভাড়া। পাইপলাইনের গ্যাসের দাম বেড়েছে, এলপিজি গ্যাসের দাম বেড়েছে, সর্বশেষ বাড়ল বিদ্যুতের দাম। কিন্তু সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়েনি। অনেক কাটছাঁট করে চলার পরও হাতে টাকা থাকছে না। আর বিদ্যুতের দাম বাড়া মানে সবকিছুর দাম আবার বাড়বে। যা জনগণের ওপর চাপ ছাড়া আর কিছু নয়।

তিনি বলেন, নির্বাহী আদেশে প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তার মানে সব মাসেই দাম বাড়বে। এ দফায় দাম বৃদ্ধির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর আরেক দফা দাম বৃদ্ধির ঘোষণা আসবে। কাজেই দাম বৃদ্ধির এ চক্র সহসা থামছে না। মঙ্গলবার নির্বাহী আদেশে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে সরকার। এ নিয়ে গত ১৪ বছরে ১২ বার এবং গত দুই মাসে তিনবার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হলো। এমন একটি সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো, যখন মূল্যস্ফীতির প্রভাবে সাধারণ মানুষ দিশেহারা।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এবারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে আবাসিক খাতে বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ বাড়বে ১০ থেকে ২০ শতাংশ। সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে কম বিদ্যুৎ (৫০ ইউনিটের কম) ব্যবহারকারী গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম ৪.১৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪.৩৫ টাকা করা হয়েছে।

এছাড়া ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যমান দর ৪.৬২ থেকে বাড়িয়ে ৪.৮৫ টাকা, দ্বিতীয় ধাপে ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যমান দর ৬.৩১ থেকে বাড়িয়ে ৬.৬৩ টাকা, ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যমান দর ৬.৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬.৯৫ টাকা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের বিদ্যমান দর ৬.৯৯ থেকে বাড়িয়ে ৭.৩৪ টাকা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যমান দর ১০.৯৬ থেকে বাড়িয়ে ১১.৫১ টাকা, সর্বশেষ ধাপ ৬০০ ইউনিটের ঊর্ধ্বে ব্যবহারকারীদের বিদ্যমান দর ১২.৬৩ থেকে বাড়িয়ে ১৩.২৬ টাকা করা হয়েছে।

ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এক অদূরদর্শী পরিকল্পনায় চলছে। যার দায়ভার পড়ছে সাধারণ জনগণের ওপর। বিদ্যুতের এভাবে মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। আগে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, গণশুনানি করে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। এখন নির্বাহী আদেশে সরকার সরাসরি সেটা করছে। সরকার কোনোরকম জবাবদিহিতা ছাড়া মূল্যবৃদ্ধি করে যাচ্ছে। যা মূল্যস্ফীতি আর জনগণের বোঝা দুটোই বাড়িয়ে চলেছে।

দেশে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের খুচরা দাম পাঁচ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক নির্বাহী আদেশে ১ জানুয়ারি থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর এমন সিদ্ধান্ত ভোক্তার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত ভর্তুকি কমাতে কিছুটা সাহায্য করলেও মূল্যস্ফীতিকে আর এক দফা বাড়িয়ে দেবে। আবার বিদ্যুৎ দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে মন্দের ভালো বলছেন কেউ কেউ।

গোলাম রহমান বলেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি অপ্রত্যাশিত কিছু ছিল না। পাইকারি পর্যায়ে যখন দাম বৃদ্ধি করা হয়েছিল, তখনই আশঙ্কা করেছিলাম খুচরা পর্যায়েও দাম বৃদ্ধি পাবে। এর আগে আমরা প্রতিবাদ করেছি। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি কমিটি ১৫ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিল, এখন ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটাকে স্বাগত জানানোর প্রশ্নই আসে না। তবে আমি বলব মন্দের ভালো।

তিনি বলেন, কেন মন্দের ভালো বললাম...কারণ প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি কমানোর কথা বলেছেন। উৎপাদনের জন্য যে ব্যয় হয়, সে ব্যয় ভোক্তাদেরকেই দিতে হবে। সেই প্রেক্ষাপটে আমার মনে হয় বিইআরসি যথেষ্ট সুবিবেচনার পরিচয় দেয়নি।

ক্যাব সভাপতি বলেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। আমরা আশা করবো ব্যবসায়ীরা অন্যান্য সেক্টরে ব্যয় সংকোচন করে পণ্য মূল্য ঠিক রাখবেন। আমরা আশা করব যতটুকু বৃদ্ধি হয়েছে, সে কারণে যেন পণ্যের মূল্যের ওপর প্রভাব পড়বে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কৃষিখাতে সোলার বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।

এদিকে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ভোক্তার ওপর বাড়তি চাপ তৈরির পাশাপাশি বাজার পরিস্থিতিকে জটিল করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমরা উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। মূল্যস্ফীতির এই কাঠামোর মধ্যে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা ভোক্তার দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে পরিস্থিতি জটিল করবে। এর মাধ্যমে সহজেই অনুমেয় উৎপাদন ব্যয় যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনিভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পাবে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে হয়তো সরকারের ভর্তুকি ব্যয় আংশিকভাবে কিছুটা কমিয়ে আনা যাবে। কিন্তু বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করে সরবরাহ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়ানো ভূমিকা ন্যূনতম। এর ফলে ভোক্তার ওপর চাপ বৃদ্ধি পাবে।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমার কাছে মনে হয়েছে আইএমএফের সঙ্গে ঋণ চুক্তি ইস্যুতে উদ্যোগের অংশ হিসেবেই সরকারের এমন সিদ্ধান্ত হতে পারে। অর্থাৎ ভর্তুকি কমানোই ছিল মূল লক্ষ্য। এর বাইরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর এই উদ্যোগের তেমন কোনো গুরুত্ব আছে বলে মনে হয় না। বরং সরকার যদি প্রকৃত অর্থেই বড় আকারে ভর্তুকি কমাতে চাইতো, তাহলে কুইক রেন্টালের মতো বিদ্যুৎকেন্দ্রে অবসায়ন করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ দীর্ঘমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর জোর দিতো। এক্ষেত্রে সরকারের ভর্তুকি কমার পাশাপাশি ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা হতো। এর পাশাপাশি সরকারের অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজতর হতো।

ক্যাবের এক জরিপে দেখা গেছে, ১০ বছরে জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১২৫ শতাংশ, কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় সেভাবে বাড়েনি। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম যেভাবে হু হু করে বেড়ে গিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে, সেখানে ১৭ কোটি সাধারণ জনগণের স্বার্থ চিন্তা না করে বিদ্যুতের আর এক দফা মূল্য বৃদ্ধি প্রস্তাব অযৌক্তিক।

আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, ভর্তুকি হ্রাসের অজুহাতে আকস্মিকভাবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, পাইকারি পর্যায়ে ১৯.৯২ শতাংশ দাম বাড়ানোর ঘোষণা, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি চলমান জীবনযাত্রার মূল্য বৃদ্ধি মধ্যবিত্তসহ সাধারণ জনগণের জীবন যাপনে নিত্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্য সামগ্রী ও জীবন যাত্রার উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা নিত্য প্রয়োজনীয় সবো ধরনের দ্রব্যসমাগ্রী ও সেবা সার্ভিসের আরেক দফা আগুন ধরাবে।

বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি পাগলা ঘোড়া বাজারে আগুন ছড়াচ্ছে যা মধ্যবিত্ত জনগণসহ সর্বস্তরের সাধারণ নাগরিকদের জীবন যাত্রা ভয়াবহ দুর্বিষহ করছে, সাধারণ মানুষ এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের সীমাহীন মূল্য বৃদ্ধি, গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি, বাড়িভাড়া বৃদ্ধি ইত্যাদি যন্ত্রণায় কাতর, সেখানে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি এই যন্ত্রণা বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে।

এদিকে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির কারণে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। শিল্প কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন এবং ফিনিশিড প্রোডাক্টস’র মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ কার্যকর ভূমিকা রাখে বিধায় এসব উৎপাদিত পণ্যের ভোক্তা পর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি যেভাবে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকায় মারাত্মক নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে, ঠিক একইভাবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণেও জনজীবনে অস্থিরতা বাড়াবে।

কিন্তু বিদ্যুতের দাম ফের বৃদ্ধি মধ্যবিত্তসহ সব মানুষের জন্য আরেকটি আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একদিকে বেশ কিছুদিন ধরেই মানুষ বিদ্যুৎ ঠিকমতো পাচ্ছে না। আবার নতুন করে দাম বাড়ানোর কারণে সাধারণ মানুষের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আর্বিভূত হবে এই দাম বৃদ্ধি।

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি যেভাবে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকায় মারাত্মক নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে, ঠিক একইভাবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণেও জনজীবনে অস্থিরতা বাড়াবে।

https://dailysangram.com/post/518167