১ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ৭:৫৮

আবার বাড়ল বিদ্যুতের দাম

আদানি ও অন্যদের দেয়া সুবিধার দায় জনগণের ওপর!

এক মাসের ব্যবধানে আবার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। সরকারের নির্বাহী আদেশে গতকাল মঙ্গলবার রাতেই বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এবার ভোক্তাপর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। মার্চ মাসের বিল থেকেই নতুন এ দাম কার্যকর হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, গতকাল রাতেই এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে।

এর আগে গত জানুয়ারিতে দুই দফায় বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এটি জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দুই ভাগে কার্যকর হয়েছে। সর্বশেষ ৩০ জানুয়ারির প্রজ্ঞাপনে খুচরা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ও পাইকারি পর্যায়ে ৮ শতাংশ বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ সামলাতে এ বছর প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করছে সরকার। গতকাল বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ানোর ফলে ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হলো।
এর আগে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করত এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আইন সংশোধন করে এ ক্ষমতা হাতে নিয়েছে সরকার। এরপর থেকে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়াচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

দেশের সরকারি-বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত দামে বিদ্যুৎ কিনে নেয় পিডিবি। এরপর তারা উৎপাদন খরচের চেয়ে কিছুটা কম দামে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার কাছে বিক্রি করে। ঘাটতি মেটাতে পিডিবি সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নেয়। তবে বিতরণ সংস্থাগুলো কোনো ভর্তুকি পায় না। তারা নিয়মিত মুনাফা করছে। গত অর্থবছরেও মুনাফা করেছে বিতরণ সংস্থাগুলো।

এবারের আগে সর্বশেষ দুই দফায় গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের খুচরা দাম প্রায় ১১ শতাংশ বাড়ানো হয়। পাইকারি বিদ্যুতের দাম ফিডার ভেদে সাড়ে ছয় থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এরই মধ্যে ১৭ জানুয়ারি শিল্পকারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি মানুষের জীবনযাত্রার ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে।

সাধারণ মানুষ কিভাবে এই বোঝা সামলাবে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকারের কাছে বিকল্প কোনো উপায় নেই। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিক্রির মধ্যে ভর্তুকি পুরোপুরি তুলে দেয়া হবে। বিতরণ কোম্পানিগুলো যে হিসাব দিয়েছে, তাতে নতুন করে ৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হলেও তারা লোকসানে থাকবে। আরো অন্তত ২ শতাংশ দাম বাড়ালে বিতরণ কোম্পানিগুলো কিছুটা লাভ করতে পারবে। এ কর্মকর্তা শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এ বছর গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যাবে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ আছে সরকারের মধ্যে। কারণ ডলার সঙ্কটে চাহিদা অনুযায়ী তেল, গ্যাস, কয়লা আমদানি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

সর্বশেষ জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী লাইফলাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৯৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ১৪ পয়সা, শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৬২ পয়সা এবং ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৩১ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ৩০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৬২ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৬৬ পয়সা থেকে বেড়ে ৬ টাকা ৯৯ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের জন্য ১০ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বেড়ে ১০ টাকা ৯৬ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ১২ টাকা ০৩ পয়সা থেকে বেড়ে ১২ টাকা ৬৩ পয়সা করা হয়েছে। নতুন করে ৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হলে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবহারকারীদের আরো ৫ শতাংশ দাম বাড়বে।
আদানির জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে জনগণকে

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ পেতে যে বাড়তি অর্থ সরকারকে ব্যয় করতে হয়েছে তার চেয়েও অনেক বেশি জাতীয় সম্পদের রক্তক্ষরণ হওয়ার মতো চুক্তি করা হয়েছে ভারতের আদানি গ্রুপের মালিকানাধীন গোড্ডা পাওয়ারের সাথে। ২৫ বছর ধরে এই রাষ্ট্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে যদি কোনো বিদ্যুৎ নাও নেয়া হয়। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক আদানি ওয়াচ বাংলাদেশের সাথে যে বিদ্যুৎ চুক্তি করা হয়েছে তার বিস্তারিত পর্যালোচনা করেছে। প্রতিষ্ঠানটি আদানি পাওয়ারের কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা বলেছে। যদিও তাদের সব প্রশ্নের জবাব কর্তৃপক্ষ দেয়নি।

ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে ২০১৭ সালে সরকার এই চুক্তি করেছে। চলমান বিদ্যুৎসঙ্কট থেকে উত্তরণে সরকার এই বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করছে বলে উল্লেখ করা হলেও আদানি ওয়াচ ও যুক্তরাষ্ট্রের হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভিন্ন কিছু। আদানি ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে ভারতের ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার দাম বেশি পড়বে, যা দিতে হবে বাংলাদেশকে। এ ছাড়া ভারতের উচ্চ করপোরেট ট্যাক্স, কয়লার পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় এই বিদ্যুতের দাম দেশের অন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে বেশি হবে। ভারত থেকে আমদানি করা অন্য বিদ্যুতের চেয়ে তিন গুণ আর পায়রা কেন্দ্রের চেয়ে দ্বিগুণ দাম হবে আদানির বিদ্যুতের।

আদানি ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি বিশ্লেষণ করে ওয়াশিংটন পোস্টের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম যত বেশিই হোক না কেন, নির্দিষ্ট পরিমাণ ছাড় পায় বাংলাদেশ। কিন্তু আদানির সাথে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ কয়লার দাম আন্তর্জাতিক দর অনুযায়ী দিতে হবে। আদানির অস্ট্রেলীয় কয়লাখনি থেকে এই কয়লার সরবরাহ আসায় এর মূল্য ঠিক করবে আদানি নিজে। এতে জ্বালানি খরচ বেশি পড়বে।

ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানি ভারতে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালায়, এগুলো অধিকাংশই সমুদ্রের কাছে; যাতে সড়ক অথবা রেলে কয়লা পরিবহনের খরচ কমানো যায়। কিন্তু গোড্ডার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্দর থেকে বেশি দূরে হওয়ায় কয়লা পরিবহনে বাড়তি ব্যয় বিদ্যুতের দাম বাড়াবে। এতে আদানির ব্যবসা হলেও বাংলাদেশের জন্য তা বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এতে আদানির প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১৬-১৭ টাকায় কিনতে হবে বাংলাদেশকে। যদিও আমদানি করা কয়লা দিয়ে উৎপাদিত পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ৮-৯ টাকা।

অন্য বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির ক্যাপাসিটি চার্জও বেশি। বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন দি এক্সটার্নাল ডেট ও ভারতভিত্তিক গ্রোথওয়াচের এক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ নেয়া না গেলে এর বিপরীতে বড় অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে বাংলাদেশকে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে বার্ষিক ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪২ কোটি ৩২ লাখ ৯০ হাজার ডলারে। টাকার অঙ্কে যা দাঁড়াবে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো। ২৫ বছর ধরে এভাবে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হলে লাখ কোটি টাকা দাঁড়াবে, যা হবে প্লান্টের খরচের প্রায় চার গুণের সমান।
ক্যাপাসিটি চার্জের খড়গ

পিডিবির তথ্য অনুসারে, ২০০৮-০৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১৪ বছরে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপিগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় প্রায় ৮৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। তিনটি পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের সমান অর্থ গেছে এ খাতে। যদিও এ সময় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হয়নি। এমনকি কোনো কোনো বছর সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হয়নি। অথচ বসিয়ে রেখেই প্রতি বছরই ক্যাপাসিটি চার্জের পুরোটা পরিশোধ করা হয়।

২০০৮-০৯ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছর তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ আরো বেড়ে হয় দুুই হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছর তা এক লাফে পাঁচ হাজার কোটি টাকায় ওঠে। এরপর কয়েক বছর ক্যাপাসিটি চার্জ পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকার ঘরেই ছিল। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় পৌনে ৯ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ তা অনেকটাই বেড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছায়। ২০২০-২১ অর্থবছর তা আরো বেড়ে অতিক্রম করে ১৩ হাজার কোটি টাকা। আর সর্বশেষ অর্থবছর (২০২১-২২) তা দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জের বৃদ্ধির এ ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে বলে প্রাক্কলন করেছে পিডিবি। চলতি অর্থবছর তা ১৫ হাজার কোটি টাকা ছুঁতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।

গত ১৪ বছরে সামিটের পকেটে ক্যাপাসিটি চার্জ ঢুকেছে প্রায় ১০ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা, যা মোট ক্যাপাসিটি চার্জের প্রায় ১২ শতাংশ। ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি অ্যাগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল। গত ১৪ বছরে কোম্পানিটির জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে সাত হাজার ৯৩২ কোটি টাকা, যা এ খাতে ব্যয়ের প্রায় ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে মালয়েশিয়াভিত্তিক চীনা কোম্পানি এরদা পাওয়ার হোল্ডিংসের। ১৪ বছরে এরদা পাওয়ার ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে সাত হাজার ৫২৩ কোটি টাকা, যা এ খাতে ব্যয়ের ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ। ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে সার্বিকভাবে চতুর্থ তবে দেশীয় কোম্পানির মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইউনাইটেড গ্রুপ। সব মিলিয়ে ১৪ বছরে গ্রুপটি ছয় হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে, যা মোট ক্যাপাসিটি চার্জের ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। পরের পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল)। ১৪ বছরে এ কোম্পানির পকেটে গেছে পাঁচ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, যা মোট ক্যাপাসিটি চার্জের ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/731213