১ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ৭:৫৫

নিত্যপণ্য ও সেবার মূল্য উল্লম্ফনে জনগণ দিশেহারা

-আবদুল লতিফ মন্ডল

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক বছরের ব্যবধানে নিত্যপণ্য ও সেবার দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। গত এক বছরে নিত্যপণ্য ও সেবার মূল্য কী পরিমাণে বেড়েছে তার একটি তুলনামূলক বিবরণ প্রতিবেদনে রয়েছে।

এতে দেখা যায়, গত এক বছরে প্রোটিন ও শর্করাজাতীয় খাদ্যের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ২০.৫৫ ও ৩৫.৫১ শতাংশ হারে। ৩৬.০৫ ও ১৮.৫০ শতাংশ হারে বেড়েছে যথাক্রমে শিশুখাদ্য ও ভোজ্যতেলের দাম। অন্যদিকে সেবা খাতে বিদ্যুৎ, গ্যাস, গণপরিবহণ ও চিকিৎসায় ব্যয় বেড়েছে যথাক্রমে ১০, ১০০, ১০০ ও ২০ শতাংশ হারে। বিবরণী থেকে আরও জানা যায়, গত এক বছরে যখন মজুরি বেড়েছে ৭ শতাংশ, তখন জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৮.৫৭ শতাংশ। প্রশ্ন হচ্ছে, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে সংসার চলবে কীভাবে?

দেশে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে ভাত। চাল থেকে রূপান্তরিত ভাত দেশের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষের প্রধান খাদ্য, যা আমাদের ক্যালরির প্রধান উৎস। যুগান্তরের উপর্যুক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক বছরে দেশের অধিকাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য মোটা চালের দাম বেড়েছে ১৭.৯৫ শতাংশ। সরু চাল নাজির শাইলের দাম ২০.২৯ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসিক মোট ব্যয়ের ৫৪.৮১ শতাংশ খরচ হয় খাদ্যে। আবার মাসিক মোট খরচের ৩৫.৯৬ শতাংশ ব্যয় হয় চাল কেনায়। চালের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ও অতিদরিদ্ররা চরম দুর্ভোগে পড়েছে। চালের দামে উল্লম্ফনে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও বিপদে পড়েছে। চালের অতি উচ্চমূল্যের কারণে এসব পরিবারকে আমিষজাতীয় খাবার কেনা কমিয়ে দিতে হচ্ছে। এতে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর মতো নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারেও, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের মধ্যে পুষ্টি সমস্যা দেখা দিয়েছে।

গত এক বছরে আমাদের দ্বিতীয় খাদ্য গমের আটার দাম বেড়েছে ৬৪.২৯ শতাংশ। বিবিএসের সর্বশেষ হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিউচার সার্ভে (হায়েস)-২০১৬ অনুযায়ী, দেশে জাতীয় পর্যায়ে মাথাপিছু দৈনিক গমের ব্যবহার ১৯.৮ গ্রাম। ২০০৫ সালের হায়েসে জাতীয় পর্যায়ে মাথা পিছু দৈনিক খাদ্য হিসাবে গমের ব্যবহার ছিল ১২.১ গ্রাম। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য সচেতনতা, মোটা চালের তুলনায় আটার কম দাম, গমের আটা-ময়দা থেকে তৈরি বিস্কুট, কেক ইত্যাদির বিদেশে রপ্তানি-এসব কারণে গমের ব্যবহার বাড়তে থাকে।

গমের চাহিদার ৯০ শতাংশ পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের অনিশ্চয়তা, সম্প্রতি শস্য রপ্তানিতে রাশিয়ার বিধিনিষেধ আরোপ, ভারতের গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বৃদ্ধি, পরিবহণ ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে পণ্যটির আমদানি যে আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে, তা অনেকটা জোর দিয়ে বলা যায়। এতে দেশের বাজারে আটার দাম আরও বেড়ে যাবে। উচ্চহারে খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি ছাড়াও উচ্চহারে বেড়েছে প্রোটিনজাতীয় খাদ্যের। মাছ, মাংস, ডিম, ডালসহ প্রোটিনের জোগান আসে এমন খাদ্যের দাম গত এক বছরে বেড়েছে ২০.৫৫ শতাংশ।

উল্লম্ফন ঘটেছে আমদানিনির্ভর চিনি, গুঁড়া দুধ, ভোজ্যতেল, মসলা ইত্যাদির দামে। যুগান্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক বছরে এক কেজি চিনির মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে ৪৩.৫৩ শতাংশ। সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ১৮ শতাংশ। গুঁড়া দুধের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫০ থেকে ১১০ টাকা। দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উৎপাদিত তরল দুধের দাম বেড়েছে ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ। দারুচিনি, জিরা, গোলমরিচ, লবঙ্গ ও এলাচির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় মসলার দাম কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। উচ্চহারে বেড়েছে সবজির দাম। এক কেজি করলা বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৮০ টাকায়। কাঁচামরিচের কেজি ২০০ টাকা। কেজিতে আলুর দাম বেড়েছে ১২ শতাংশ।

গত এক বছরে খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও অত্যাবশ্যকীয় সেবার দাম বেড়েছে। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, বাড়ি ভাড়া ও জ্বালানি খাতে ব্যয় বৃদ্ধির হার ৭.৭১ শতাংশ। চিকিৎসা খাতে ব্যয় বৃদ্ধির হার ১৯.৭৮ শতাংশ। অত্যাবশ্যকীয় সেবার মধ্যে বিদ্যুতের দাম দুই দফায় বেড়েছে ১০ শতাংশ। গ্যাসের দাম দুই দফায় ১০০ শতাংশ বেড়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অন্যসব পণ্য ও সেবার দামও বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গণপরিবহণের ভাড়া প্রায় শতভাগ। এসব মিলে জীবনযাত্রার ব্যয় লাগামহীনভাবে বেড়েছে।

জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির বিপরীতে মজুরি বেড়েছে খুবই সামান্য। বৃদ্ধির হার যখন ৭ শতাংশ, তখন ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। ঘাটতি থাকছে দেড় শতাংশ। এ ঘাটতি মেটাতে খাবারসহ বিভিন্ন খাতে খরচ কমানোর পাশাপাশি ঋণগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। অনেকে সঞ্চয় ভাঙছেন। যাদের কোনো সঞ্চয় নেই অর্থাৎ দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ অতি উচ্চমূল্যে বাজার থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করতে না পারায় তাদের খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত খাদ্যনিরাপত্তার সংজ্ঞানুযায়ী তখনই খাদ্যনিরাপত্তা বিরাজমান, যখন সবার কর্মক্ষম, স্বাস্থ্যকর ও উৎপাদনমুখী জীবনযাপনের জন্য সবসময় পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ ও পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্যে লভ্যতা ও প্রাপ্তির ক্ষমতা বিদ্যমান থাকে।

আয়ের চেয়ে ব্যয় বৃদ্ধির ফলে দেশে বাড়ছে দারিদ্র্যহার। বর্তমানে দেশে দারিদ্র্যহার কত তা সরকারিভাবে জানানো হচ্ছে না। অর্থমন্ত্রীর ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় আওয়ামী লীগের একটানা এক যুগের শাসনামলের অর্জন নিয়ে একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘দারিদ্র্যের হার ৪১.৫ থেকে কমে ২০.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।’ অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় ব্যবহৃত এ তথ্য পুরোনো। এ তথ্য করোনাভাইরাসের প্রকোপকালের আগের। এর সত্যতা মেলে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (জুলাই ২০২০-জুন ২০২৫) থেকে। এতে বলা হয়েছে, ‘২০১৯ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশে নেমেছে বলে হিসাব করা হয়।’ এদিকে দেশের কয়েকটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান/সংস্থা যেমন-সিপিডি, পিপিআরসি, বিজিডির মতে, করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ থেকে ৪২ শতাংশে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান/সংস্থাগুলোর গবেষণার ফলাফলে প্রাপ্ত দারিদ্র্যহারের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও করোনাকালীন তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে সরকার এখন পর্যন্ত জনগণকে জানায়নি দেশে বর্তমানে দারিদ্র্যহার কত।

খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানে আরও অবনমন ঘটেছে। বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক ২০২২ অনুযায়ী, বিশ্বের ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। গত বছর এ অবস্থান ছিল ৭৬তম। অর্থাৎ গতবারের তুলনায় বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক ২০২২-এ বাংলাদেশ ৮ ধাপ পিছিয়েছে। এমনিতে অনেক বছর ধরে বিশ্ব খাদ্য সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। ক্রমান্বয়ে তলানির নিচে নেমে যাচ্ছে।
আয়ের তুলনায় জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিতে দেশে সামাজিক স্তরবিন্যাসে বিবর্তন ঘটতে পারে। এতে মধ্যবিত্তরা নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তরা দরিদ্র এবং দরিদ্ররা অতি দরিদ্রের স্তরে নেমে যেতে পারে।

এ অবস্থায় স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে-ক. খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি জোরদার করা; খ. মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি বিবেচনায় নিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা; গ. বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি ভূমিকা জোরদার করা, যাতে সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছানুযায়ী নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে না পারেন; ঘ. আইএমএফের চাপে অত্যাবশ্যকীয় সেবা খাতে ভর্তুকি আগ্রাসী হারে হ্রাস না করা। দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাদির মধ্যে রয়েছে-১. জনগণের, বিশেষ করে নিম্নবিত্তের আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা; ২. কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা; ৩. কৃষি খাতের নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী করা; এজন্য কৃষিজমি অকৃষি খাতে স্থানান্তর যথাসম্ভব বন্ধ করা এবং হেক্টরপ্রতি চাল উৎপাদন কমপক্ষে ভারত ও চীনের পর্যায়ে নিয়ে আসা; ৪. অর্থনৈতিক উন্নয়নে আঞ্চলিক বৈষম্য যথাসম্ভব কমিয়ে আনা; ৫. ধনী-গরিবের আয়-বৈষম্য হ্রাসে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

 

latifm43@gmail.com https://www.jugantor.com/todays-paper/window/650024