২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শনিবার, ১২:২৯

মংলা বন্দরের জন্য তেল অপসারণকারী জাহাজ ক্রয়

বিশেষ কোম্পানিকে কাজ দিতে ক্রয়নীতি লংঘন

রহস্যজনক কারণে ‘চুপ’ নৌ মন্ত্রণালয়

তেল অপসারণকারী জাহাজ কিনতে টেন্ডারে বিশেষ শর্ত জুড়ে দিয়ে নির্দিষ্ট একটি কোম্পানিকে কাজ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। বিশেষ ওই শর্তে বলা হয়, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে তেল অপসারণকারী অথবা দূষণ নিয়ন্ত্রণকারী জাহাজ সরবরাহের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এ কারণে অনেক কোম্পানি টেন্ডারে অংশ নিতে পারেনি। কারণ এ পর্যন্ত বাংলাদেশে একটি কোম্পানি এ ধরনের যান সরবরাহ করেছে। ক্রয় প্রক্রিয়ায় এমন শর্ত পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলের (পিপিআর-২০০৮) পরিপন্থী বা লংঘন বলে তথ্য-উপাত্ত পেয়েছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় ও মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ কয়েক দফা চিঠি চালাচালিও করে। একপর্যায়ে বিশেষ ওই কোম্পানিকে ওয়ার্ক অর্ডার দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরপরই রহস্যজনক কারণে চুপ হয়ে যায় নৌ মন্ত্রণালয়। মংলা বন্দর ও নৌ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব অশোক মাধব রায় যুগান্তরকে বলেন, ‘টেন্ডারে একটি কোম্পানিকে কাজ দেয়ার জন্য শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে বলে আমরাও অভিযোগ পেয়েছিলাম। খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওই অভিযোগ সত্য নয়। এ কারণে বিষয়টি নিয়ে পরে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।’

তবে জাহাজ সরবরাহের কাজ পাওয়া ফিনল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান ‘লেমর কর্পোরেশন’-এর বাংলাদেশ এজেন্ট জেনারেল সায়েন্টিফিক কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমএ সালাম যুগান্তরকে বলেন, ‘একমাত্র চট্টগ্রাম বন্দরের তেল অপসারণকারী জাহাজ রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো সংস্থার কাছে এ ধরনের জাহাজ নেই, যেটি পানি থেকে তেল আলাদা এবং নদীর পানি দূষণমুক্ত করে। চট্টগ্রাম বন্দরকে ওই জাহাজটি আমরাই (লেমর কর্পোরেশন) সরবরাহ করেছিলাম। বাংলাদেশের ওয়েস্টার্ন মেরিন জাহাজটি নির্মাণ করে। যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে লেমর কর্পোরেশন। এবার মংলা বন্দরের জাহাজ সরবরাহের কাজও টেন্ডারের মাধ্যমে আমাদের কোম্পানি পেয়েছে।’

জানা গেছে, ২০১৪ সালে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে নৌ-দুর্ঘটনায় তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় সারা বিশ্বে হৈচৈ হয়। ওই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি মংলা বন্দরের জন্য তেল অপসারণকারী জাহাজ সংগ্রহের সুপারিশ করে। এরপরই জাহাজ সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ জন্য সম্প্রতি লেমর কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। জাহাজটির মূল্য ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নৌ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, কাজটি নিয়ে বিশেষ একটি মহল শুরু থেকেই তৎপর ছিল। এরই অংশ হিসেবে টেন্ডার প্রক্রিয়ার অভিযোগসংক্রান্ত ফাইলটি কয়েক কর্মকর্তার দফতরে দীর্ঘসময় আটকে ছিল। অভিযোগ তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিয়ে ওয়ার্ক অর্ডার দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। আইন ও বিধি অনুযায়ী, ওয়ার্ক অর্ডার দেয়ার পর টেন্ডার পুনরায় আহ্বানের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায় বলেও জানান তিনি।

নথিপত্র পর্যালোচনা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, জাহাজ ক্রয় প্রক্রিয়া নিয়ে নৌ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনিয়মের অভিযোগ করে তিনটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান- ফাইভ আর অ্যাসোসিয়েটস, ইকমট্রেড হোল্ডিংস পিটিই ও প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনাল। কোম্পানি তিনটির পৃথক অভিযোগে বলা হয়, একটি কোম্পানিকে কাজ দিতে টেন্ডারে বিশেষ শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া টেন্ডারের অন্যত্র কঠিন শর্ত দেয়া হয়েছে। টেন্ডারের আইটিটি ২১.১ (কিউ) ধারায় বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে তেল অপসারণকারী জাহাজ অথবা দূষণ নিয়ন্ত্রণকারী জাহাজ সরবরাহের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ক্রয় প্রক্রিয়ায় এ ধরনের শর্ত আরোপ পিপিআর-২০০৮-এর পরিপন্থী বলেও উল্লেখ করে কোম্পানিগুলো। তারা জানায়, এ শর্তের ফলে কোনো বিদেশী প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করেনি।

নৌ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ক্রয় প্রক্রিয়া নিয়ে অভিযোগ ওঠায় টেন্ডার ডকুমেন্ট এনে পরীক্ষা করে নৌ মন্ত্রণালয়। এতে অভিযোগের সত্যতাও মেলে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি ৩টির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে মতামত চাওয়া হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ মন্ত্রণালয়কে জানায়, কোম্পানিগুলো পিপিআর অনুয়ায়ী অভিযোগ না করায় তা আমলে নেয়া সমীচীন হবে না। এমন জবাবে ক্ষুব্ধ মত দিয়ে মন্ত্রণালয় জানায়, নির্দিষ্ট বিষয়ে জবাব না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ তুলে ধরেছে সংস্থাটি। মতামতে আরও বলা হয়, অভিযোগগুলো পিপিআর অনুুযায়ী না হলেও সেগুলো আমলে নেয়ার যোগ্য। এরপরই টেন্ডারের দুটি উপদফায় সংশোধনে নির্দেশনা পাঠানোর উদ্যোগ নেয় মন্ত্রণালয়। নির্দেশনায় আইটিটি ২১.১(কিউ)(এ) উপদফা থেকে ‘শুধু বাংলাদেশে ওই জলযান সংগ্রহের’ শর্তটি বাদ দিয়ে টেন্ডার ডকুমেন্টের সংশোধনী প্রকাশ বা পুনঃটেন্ডার আহ্বানের জন্য নির্দেশ দেয়ার কথা বলা হয়। এ ছাড়া আইটিটি ২১.১(কিউ)(এ)(বি) উপদফা থেকে ‘দূষণ নিয়ন্ত্রণকারী জলযান’ শব্দ বাদ দেয়ার জন্যও বলা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে নিজেদের ওই নির্দেশনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ আটকে যায় খোদ নৌ মন্ত্রণালয়েই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক বলেন, পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল সাজানো। আন্তর্জাতিক টেন্ডার হলেও বিশেষ শর্তের কারণে একটি কোম্পানি কাজ পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হয়। বিষয়টি নৌ মন্ত্রণালয়কে জানানো হলেও কোনো প্রতিকার পাইনি।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে নিঃসৃত তেল অপসারণকারী জাহাজ সংগ্রহ প্রকল্পের পরিচালক ও বন্দরের হারবার মাস্টার এম অলিউল্লাহ বলেন, নৌ মন্ত্রণালয় থেকে যেসব তথ্য-উপাত্ত চেয়েছিল তা দিয়েছি। বিশেষ একটি কোম্পানিকে কাজ দিতে শর্ত দেয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পিপিআর মেনেই ওয়ার্ক অর্ডার দিয়েছি।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/02/25/103956