১০ জুলাই ২০২৪, বুধবার, ১:৫৫

খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যে দিশাহারা ভোক্তা

কয়েক বছর ধরেই খাদ্যপণ্যের দাম লাগামছাড়া। এক অর্থবছরেই পেঁয়াজ, চাল, রসুন, আলু ও এলাচ—এই পাঁচ পণ্যের দাম সর্বোচ্চ ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। সে তুলনায় সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। খাদ্যপণ্যের এই উচ্চমূল্যে দিশাহারা সাধারণ ভোক্তা।
খাদ্য মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সরকার এর মধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। দাম বেঁধে দিয়ে এবং শুল্ক কমিয়ে বাজারদর নিয়ন্ত্রণে সরকারের চেষ্টা যে কাজে আসেনি, তা খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিই বলে দেয়। গত অর্থবছরের মতো নতুন অর্থবছরের বাজেটেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে সরকার।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৪২ শতাংশ। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বর্তমানে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি বিবিএসের তথ্যের চেয়ে বেশি।

গত ৯ মে বিআইডিএসের সম্মেলনকক্ষে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। তিনি বলেন, ‘বাড়তি এই মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ অসুবিধায় রয়েছে।

সম্প্রতি বিআইডিএসের পক্ষ থেকে দেশের সব জেলা থেকে তথ্য নিয়েছি। এরপর একটি পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৫ শতাংশ।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন ব্যয় ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি। মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধিতে এই দুটি বড় ভূমিকা রেখেছে বলেও তাঁরা জানান।

গত রবিবার বিবিএসের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও তিন মাস ধরে তা ১০ শতাংশের বেশি আছে। জুন মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০.৪২ শতাংশ। আর সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ৯.৭২ শতাংশ হয়েছে। এর আগে মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৮৯ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। মূল্যস্ফীতি এক ধরনের কর; ধনী-গরিব-নির্বিশেষে সবার ওপর চাপ সৃষ্টি করে মূল্যস্ফীতি। আয় বৃদ্ধির তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার বেশি হলে গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষ সংসার চালাতে ভোগান্তিতে পড়ে। কয়েক অর্থবছর ধরে চলা এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। প্রভাব পড়ছে মানুষের যাপিত জীবনে।

রাজধানীর রামপুরা এলাকার বাসিন্দা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মো. কামরুল আহসান। বেতন থেকে মাসে তাঁর আয় ৩২ হাজার টাকা। কালের কণ্ঠকে কামরুল বলেন, ‘গত তিন বছরে আমার বেতন বেড়েছে মাত্র দুই হাজার টাকা। কিন্তু ব্যয় বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এতে বাসাভাড়া, বাজার খরচ, দুই সন্তানের পড়াশোনার খরচ দিয়ে সংসার চালানো যাচ্ছে না। ব্যয় কাটছাঁট করেও সামলাতে পারছি না।’
কামরুল আহসানের মতো এমন আরো অনেকে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে দৈনন্দিন জীবনযাপনে হিমশিম খাচ্ছেন, যা
ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভলান্টারি কনজ্যুমারস ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস সোসাইটির (ভোক্তা) নির্বাহী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান সজল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেড়েছে। তবে খাদ্যপণ্যের দাম গত কয়েক বছরে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য নিম্নবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষ খুব কষ্টে আছে। একদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ, অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়নে আমদানীকৃত পণ্যের দাম বেড়েছে। ব্যয় বাড়লেও মানুষের আয় তো বাড়েনি, বরং প্রকৃত আয় আরো কমেছে মূল্যস্ফীতিজনিত কারণে। সমন্বয়ের কথা বলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল ও পানির দামও বাড়ানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভোক্তাদের জন্য বিপর্যকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।’

খলিলুর রহমান আরো বলেন, ‘ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে হলে অবশ্যই নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে বড় কারসাজিও রয়েছে। এই কারসাজি রোধে তদারকি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে আমদানিনির্ভর পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানি পয়েন্টের মনিটর করতে হবে, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে তদারক করতে হবে। দেশে উৎপন্ন পণ্যের ক্ষেত্রেও কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সব পর্যায়েই মনিটরিং থাকতে হবে, যাতে কেউ কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াতে না পারে। দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানার জন্য সরকারের দায়িত্বশীল যেসব সংস্থা আছে, সব সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।’

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ২০২৩ সালের জুলাই মাসের বাজারদর ও চলতি জুলাই মাসের বাজারদর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এক অর্থবছরের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৪৩ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়ে মানভেদে ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চালের বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন মোটা চাল ব্রি-২৮ বা পাইজাম ৬ থেকে ৯ শতাংশ দাম বেড়ে মানভেদে ৫৩ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি রসুন ৫০ থেকে ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে মানভেদে ২০০ থেকে ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৪৭ থেকে ৬২ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে প্রতি কেজি আলু ৫৬ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক অর্থবছরের ব্যবধানে বেশি দাম বেড়েছে শতভাগ আমদানীকৃত মসলাজাতীয় পণ্য এলাচের। পণ্যটির দাম ৫২ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে তিন হাজার ২০০ থেকে তিন হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

যদিও রাজধানীর রামপুরা, বাড্ডা ও মহাখালী কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, টিসিবির বাজারদরের সঙ্গে বাস্তবে পণ্যের দরের কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। এই পাঁচটি পণ্যই টিসিবির প্রকাশিত দরের চেয়ে কিছুটা বাড়তি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খাদ্যপণ্যের এই ঊর্ধ্বগতি নামিয়ে আনার প্রধান শর্ত হলো, পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। কয়েক বছর ধরে আমাদের খাদ্যশস্যের উৎপাদন খুব বেশি বাড়েনি। যে পণ্যের ঘাটতি থাকবে সেই পণ্য দ্রুত আমদানি বাড়িয়ে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। সরকার যে খাদ্যশস্যের মজুদ রাখে, সেই মজুদ সামনে বোরো মৌসুমেই বাড়িয়ে ২৫ লাখ মেট্রিক টন করা দরকার। যখনই বাজারে ধান-চালের দাম বেড়ে যাবে, তখনই প্রয়োজন অনুযায়ী ছাড়তে হবে। শুধু বাজার মনিটরিং দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। মনিটরিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে মজুদও বাড়াতে হবে।’ টিসিবিকে দেশ থেকে পণ্য না কিনে আমদানি করে এনে সরবরাহ করারও পরামর্শ দিয়েছেন এই কৃষি অর্থনীতিবিদ।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2024/07/10/1405093