১০ জুলাই ২০২৪, বুধবার, ১:৫৪

প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সবাই কোটিপতি

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) প্রশ্ন ফাঁস চক্রের আরো ১৪ জনকে খুঁজছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মাস্টারমাইন্ড রয়েছেন। কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই প্রশ্ন ফাঁস করে অর্থ লোপাটে মেতে উঠত সংঘবদ্ধ চক্রটি। এভাবে গত ১২ বছরে চক্রের বেশির ভাগ সদস্য কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

ব্যাংকের মাধ্যমেও তাঁদের অর্থ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। চক্রে রয়েছেন শতাধিক সদস্য। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে সৈয়দ আবেদ আলীসহ ছয়জন গতকাল মঙ্গলবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অন্য ১১ জন জবানবন্দি দেননি।
পরে সবাইকে কারাগারে পাঠানো হয়। গতকাল সিআইডি সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

এদিকে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া পিএসসির পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
সিআইডির ভাষ্য, গত ১২ বছরে বিসিএসসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গ্রেপ্তারকৃতরা প্রাথমিকভাবে কিভাবে প্রশ্ন ফাঁস করেন, কারা তাঁদের সহযোগিতা করে, কিভাবে তাঁরা অর্থ লেনদেন করেন, সেসব টাকা কিভাবে তাঁরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন, তার অনেক তথ্য এরই মধ্যে তারা জানতে পেরেছে। সেসব তথ্য যাচাই করছে তারা।
গ্রেপ্তার হওয়া ১৭ জনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডি সূত্র বলছে, প্রশ্ন ফাঁস করে এঁদের বেশির ভাগ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি টাকার মালিক হয়েছেন আবেদ আলী। তাঁর ঢাকায় বাড়ি, ফ্ল্যাট, নগদ টাকাসহ অন্তত ৫০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।

অবৈধভাবে হাতিয়ে নেওয়া এই টাকায় অন্যদেরও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি, ফ্ল্যাট রয়েছে। গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের কাছ থেকে অনেক ব্যাংক চেক উদ্ধার করা হয়েছে। চক্রের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণ করে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁরা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ করেছেন কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।

পিএসসির ৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী সাময়িক বরখাস্ত
প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার পিএসসির পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গতকাল বিকেলে কমিশনের জরুরি সভায় অভিযুক্তদের বিষয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর সন্ধ্যায় কমিশনের ওয়েবসাইটে আদেশ জারি করা হয়।
সাময়িক বহিষ্কার হওয়া পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারী হলেন পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফর, উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক এস এম আলমগীর কবির, ডেসপাচ রাইডার খলিলুর রহমান এবং অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম।
আদেশে বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র প্রকাশ ও বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকা এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী কর্তৃক অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করার অভিযোগে সিআইডি কর্তৃক গ্রেপ্তার করে জেলে রাখায় এই সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। বরখাস্তকালীন বিধি অনুযায়ী তাঁরা খোরপোশ ভাতা পাবেন।

আরো ১৪ জনের নাম পেয়েছে সিআইডি
গত সোমবার রাতে পল্টন থানায় বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন আইনে সিআইডির উপপরিদর্শক নিপ্পন চন্দ্র বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় ৩১ জনের নাম উল্লেখসহ ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়। এজাহারনামীয় আসামিদের মধ্যে ১৭ জনের বাইরে আরো ১৪ জন হলেন পিএসসির সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়সহ শরীফুল ইসলাম ভূঁইয়া, দীপক বনিক, মো. খোরশেদ আলম খোকন, কাজী মো. সুমন, এ কে এম গোলাম পারভেজ, মেহেদী হাসান খান, গোলাম হামিদুর রহমান, মুহা. মিজানুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, এ টি এম মোস্তফা, মাহফুজ কালু, আসলাম ও কৌশিক দেবনাথ। এঁরাও বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে তথ্য পেয়ে যাচাই চলছে।

যেভাবে প্রশ্ন ফাঁস করেন তাঁরা
সিআইডি বলছে, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার মূলে ছিলেন তিনজন। তাঁরা পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির। এই তিনজনই মূলত প্রশ্ন ফাঁসে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। চক্রের অন্য সদস্যরা কেউ চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহ করতেন, কেউ প্রশ্নপত্র পেয়ে তার সমাধান করতেন, আবার কেউ অর্থের লেনদেন করতেন।

সিআইডি সূত্র বলছে, পিএসসির মতো কঠিন জায়গায়ও চক্রের সদস্যরা প্রশ্ন ফাঁস করে সফল হয়েছেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে প্রশ্নের তথ্য আদান-প্রদানের পাশাপাশি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের তথ্য আদান-প্রদান করেন বলে জানা গেছে। চক্রের সদস্যরা ওই পরীক্ষার আগের রাতে তাঁদের চুক্তি করা শিক্ষার্থীদের অজ্ঞাত স্থানে রেখে ওই প্রশ্নপত্র এবং তার উত্তর দিয়ে দেন। এ ছাড়া গুজব ছড়িয়ে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিভ্রান্ত করার ক্ষেত্রেও চক্রের সদস্যদের ভূমিকা পাওয়া গেছে।

অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) বিশেষ পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, দুই দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এই ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা গত ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ে উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত ছিলেন। তাঁরা একাধিক নন-ক্যাডার পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসেও জড়িত।
প্রশ্ন ফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ডসহ যাঁরা জড়িত তাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে জানিয়ে সিআইডি সূত্র বলছে, এই চক্রে পিএসসির অনেক শীর্ষ কর্তা রয়েছেন। এঁরা নানা কায়দায় প্রশ্ন ফাঁস করেন।

সিআইডি সূত্র বলছে, সিআইডির একটি সাইবার টিম আগের ও বর্তমান মামলা পর্যালোচনা করে প্রশ্ন ফাঁস চক্রটি ধরতে তৎপর রয়েছে। এসএসসি, এইচএসসি, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসে জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে তৎপর রয়েছে সিআইডি।

শিক্ষিত লোকজন এই চক্রে জড়িত জানিয়ে সিআইডি সূত্র বলছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের বেশির ভাগ সদস্য শিক্ষিত। পিএসসির কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই এই চক্রের সদস্যরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অর্থ নিতেন।

গতকাল ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়া ছয় আসামি হলেন পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী, অফিস সহায়ক (পিএসসির ডেসপাচ রাইডার) খলিলুর রহমান, অফিস সহায়ক (ডেসপাচ) সাজেদুল ইসলাম, সাখাওয়াত হোসেন, সায়েম হোসেন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লিটন সরকার।

কারাগারে পাঠানো ১১ আসামি হলেন পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুন হাসান, সাবেক সেনা সদস্য নোমান সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র প্রিয়নাথ রায়, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশিদ, মো. জাহিদুল ইসলাম, আবু সোলায়মান মো. সোহেল এবং আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম।

আবেদ আলীসহ ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ
বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে পিএসসির ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এঁদের মধ্যে পিএসসির চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীও রয়েছেন। গতকাল তাঁদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) একটি সূত্র।
বিএফআইইউ সূত্র জানায়, ব্যাংক হিসাব জব্দ সংক্রান্ত চিঠি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর কাছে পাঠানো হয়েছে। এসংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংক হিসাব জব্দ থাকবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ রযেছে।

মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামি ৬০
সর্বশেষ গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে গত সোমবার রাতে পল্টন থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলাটি করে। এ মামলায় ৩১ জনকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়। পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। তাঁদের মধ্যে বিপিএসসির উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক এবং আবেদ আলীর ছেলে ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম রয়েছেন। গত রবিবার দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া এই মামলায় আরো ৬০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে।

যেভাবে তথ্য ফাঁস
সিআইডি বলছে, বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে পিএসসির বিরুদ্ধে একটি গণমাধ্যমে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর ফেসবুকে সৈয়দ আবেদ আলীর পোস্টগুলো ভাইরাল হতে থাকে। এ ঘটনায় গত সোমবার রাতে পুলিশ বাদী হয়ে পল্টন মডেল থানায় বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন আইনে মামলা করে। মামলায় ১৭ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

অন্তত ১০ বার মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস
সিআইডি জানায়, ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে অন্তত ১০ বার এই চক্র মেডিক্যালের প্রশ্ন ফাঁস করেছে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে পাঁচজন বিএনপি এবং একজন জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে বিভিন্ন সময় যুক্ত ছিলেন। এর আগে মালিবাগে সিআইডি সদর দপ্তরে রবিবার সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিআইডিপ্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া। তিনি বলেন, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। মানি লন্ডারিং মামলায় এসবের তদন্ত চলছে।

১৬ বছরে চক্রের কয়েক শ সদস্য গ্রেপ্তার
সিআইডিসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, ১৬ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। এই চক্রের কয়েক শ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষকও রয়েছেন। এ ছাড়া রয়েছেন বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এর মাধ্যমে কয়েক শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন চক্রটির সদস্যরা।

সিআইডি জানায়, ২০২৩ সালের ৩০ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ ও বরিশালে অভিযান চালিয়ে এই চক্রের ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে আটজন তাঁদের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন, যাতে শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম উঠে এসেছে। তাঁরা প্রশ্ন পেয়ে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। এর মধ্যে অনেকে পাস করে চিকিৎসকও হয়েছেন।
সিআইডি জানায়, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের দেওয়া বিপুলসংখ্যক ব্যাংকের চেক ও অ্যাডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে এই চক্রের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/07/10/1405083