২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শুক্রবার, ১২:২৯

হুমকিতে রফতানিমুখী শিল্প

গণপরিবহন ও জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে রফতানিমুখী ছোট ছোট শিল্প বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। বন্ধ হয়ে যেতে পারে অনেক শিল্প-কারখানা। কারণ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে; যা প্রতিযোগী দেশের তুলনায় রফতানিমুখী শিল্পের সক্ষমতা হ্রাস করবে। রফতানির ওপর নেতিবাচক এই প্রভাবের কারণে বাজার হাতছাড়া হওয়ার আশংকাও রয়েছে। ফলে সরকার ঘোষিত ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানি লক্ষ্য অর্জন ব্যাহত হবে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ব্যবসায়ী নেতারা যুগান্তরকে এসব কথা বলেছেন। এদিকে সিএনজি ফিলিং স্টেশন ও পরিবহন সেক্টরের নেতারা জানিয়েছেন, গ্যাসের দাম বাড়ার সরাসরি প্রভাব পড়বে গণপরিবহনে। এতে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে ভাড়া বেড়ে যাবে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে। যার মাশুল গুনতে হবে সাধারণ নাগরিকদের।

ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসন ও ব্রেক্সিটের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে অ্যাপারেল খাতে মন্দা চলছে। ২০১৫ সালের পর থেকে বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের বাজার ছোট হয়ে আসছে। ৪৮৩ বিলিয়ন ডলারের বাজার কমে ৪৪৫ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে অন্যান্য দেশ যেখানে রফতানি খাতকে চাঙ্গা করতে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করছে, সেখানে বাংলাদেশে প্রতি বছর গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। সঙ্গে মজুরি বৃদ্ধি তো আছেই। সামগ্রিকভাবে চাপে রয়েছে দেশের রফতানিমুখী শিল্প। অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান টিকতে না পেরে বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোয় রফতানিমুখী শিল্প খাত চরম ক্ষতির মুখে পড়বে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে। প্রতিযোগী সক্ষমতা হারাবে রফতানি খাত। যতদিন না শিল্পে সঠিক মূল্যে কোয়ালিটি বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে, ততদিন গ্যাসের দাম স্বাভাবিক রাখা উচিত ছিল। এখন যেহেতু দাম বাড়ানোই হল তাই রফতানিকারকদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাড় অথবা ইনসেনটিভ দিতে হবে; যাতে তারা আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে।

তিনি বলেন, এলএনজি ও এলপিজি এলে এমনিতেই জ্বালানির দাম বাড়ানো হবে। এই অল্প সময়ের জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি। অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ হাজার মেগাওয়াট থাকলেও সঞ্চালন লাইনের অভাবে ৮ হাজার মেগাওয়াট ব্যবহৃত হচ্ছে। অচিরেই বেসরকারি খাতকে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে যুক্ত করা উচিত। তাহলে সরকারের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে। পাশাপাশি শিল্পেও কোয়ালিটি বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত সম্ভব হবে।

বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অ্যাপারেলে চাহিদা কমছে। তার ওপর ক্রেতারা পোশাকের দাম কমিয়েছে, আরও কমাতে চাপ দিচ্ছে। অপরদিকে বিভিন্ন কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোয় প্রতিযোগী সক্ষমতা কমবে। এ অবস্থায় প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, বর্তমানে রফতানি খাতে মূল চ্যালেঞ্জ হল- সক্ষমতা কমেছে। অন্যদিকে মুদ্রার অবমূল্যায়ন, ব্রেক্সিট, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তেলের দামের সমন্বয় ও নিজ নিজ দেশ নীতি সহায়তা দেয়ায় প্রতিযোগী দেশগুলোর সক্ষমতা বেড়েছে। এই অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ানোয় রফতানিমুখী শিল্প আরও ঝুঁকির মুখে পড়ল।

তিনি আরও বলেন, ২০১৫ সালে বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের বাজার ছোট হয়েছে। ৪৮৩ বিলিয়ন ডলারের বাজার কমে ৪৪৫ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্য দেশগুলো মার্কেট শেয়ার ধরে রাখতে নানা নীতি সহায়তা ও ইনসেনটিভ প্যাকেজ ঘোষণা করছে। আমাদের দেশে হচ্ছে এর উল্টো।

বিকেএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি আসলাম সানি বলেন, বর্তমানে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাওয়া যায় না। দিনে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা প্রেসার থাকে না। এক কথায় বলতে গেলে, উদ্যোক্তারা এ সময় গ্যাসের বদলে বাতাস পাচ্ছেন, অথচ বিল ঠিকই দিতে হচ্ছে। এতে শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসন ও ব্রেক্সিটের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যেই ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের দাম ১৯ শতাংশ কমেছে, ইউরোর দাম কমেছে ৮ থেকে ১০ শতাংশ। এ অবস্থায় ইউরোপের ক্রেতারা তৈরি পোশাকের দাম ৭ থেকে ৮ শতাংশ কমাতে চাপ দিচ্ছে। নতুবা অন্য বাজার থেকে পণ্য কেনার হুমকি দিচ্ছে। সব মিলিয়ে উভয় সংকটে রয়েছে রফতানিকারকরা। এ অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ানোয় রফতানিমুখী শিল্পের অস্তিস্ব হুমকিতে পড়েছে।

বিটিএমএ’র সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, দেশের শিল্প এগিয়েছে দুই কারণে। প্রথমত, সস্তা শ্রম ও দ্বিতীয়ত, নিজস্ব গ্যাস। এ দুটি ছাড়া বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ নেই। শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারিসহ সবই আমদানি করতে হয়। গত কয়েক বছরে মজুরি ৩ দফা বাড়ানো হয়েছে। এতে প্রথম ধাক্কা খায় উদ্যোক্তারা। এরপর গত বছর গ্যাসের দাম ১০০ ভাগ বাড়ানো হয়। এখন আবার গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছল।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, স্পিনিং মিলে বছরে ৭০ লাখ বেল তুলার প্রয়োজন। এর বিপরীতে দেশে ১ লাখ বেল তুলা উৎপাদন হয়। বাকিটা আমদানি করতে হয়। এই তুলা থেকে সুতা উৎপাদনে খরচ হতো ১৮ সেন্ট। গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে সেটি আরও বাড়বে। এভাবে চলতে থাকলে শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা হ্রাস পাবে। ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানির যে লক্ষ্য সরকার নির্ধারণ করেছে সেটিও অর্জন করা সম্ভব হবে না।

গণপরিবহনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে : গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে গণপরিবহনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। সিএনজি স্টেশনের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন ও কনভারশন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর বলেছেন, দেশে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো উল্লেখযোগ্য মুনাফাসহ ব্যবসা করছে। সেখানে সিএনজির মূল্যবৃদ্ধি করে গণপরিবহনে নৈরাজ্য সৃষ্টির সুযোগ তৈরির কোনো যৌক্তিকতা নেই। সিএনজির দাম বৃদ্ধির কারণে গণপরিবহনের ভাড়া এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে, যা জনজীবনকে বিপর্যস্ত করবে। তিনি বলেন, দাম বৃদ্ধির ফলে সিএনজির ব্যবহার কমবে এবং সেই সঙ্গে ডিজেল ব্যবহার বাড়বে। এতে বায়ুদূষণের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছবে। সিএনজির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি।

ক্যাবের প্রতিক্রিয়া : কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানো অযৌক্তিক। এখানে ভোক্তাস্বার্থ মূল্যায়ন করা হয়নি। কোন সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে তা বিইআরসির প্রকাশ করা উচিত। তিনি বলেন, মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে উৎপাদক ও ভোক্তার স্বার্থ দুটো সংরক্ষণ করতে হয়। এ জন্য আইনের আওতায় রেগুলেশন আছে। তার ভিত্তিতে বিইআরসির কর্মকর্তারা দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা খুঁজে পায়নি। শুনানির ৯০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত দেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু নতুন কমিশন ভোক্তাস্বার্থ বিবেচনায় না নিয়ে মূল্যবৃদ্ধি করেছে। এ সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে কোনো গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠানের উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। ক্যাবও যেতে পারে। তবে তার আগে অভ্যন্তরীণভাবে আলোচনা করা হবে।

প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বাড়তি দাম দুই ধাপে কার্যকর করা হবে। প্রথম ধাপ ১ মার্চ থেকে আর দ্বিতীয় ধাপ ১ জুন থেকে কার্যকর হবে। নতুন দাম অনুযায়ী, শিল্পে ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৬ টাকা ৭৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ২৪ পয়সা করা হয়েছে। এটি ১ মার্চ থেকে কার্যকর হবে। আর ১ জুন থেকে শিল্পোদ্যোক্তাদের দিতে হবে ৭ টাকা ৭৩ পয়সা। বাণিজ্যিক ইউনিট মার্চে ১৪ দশমিক ২০ টাকা এবং জুনে ১৭ দশমিক ০৪ টাকা হবে। ক্যাপটিক পাওয়ার ১ মার্চ থেকে প্রতি ঘনমিটার ৯ ইউনিট ৯৮ এবং ১ জুন থেকে ৯ দশমিক ৬২ টাকা করা হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের গ্যাসের দাম মার্চ থেকে ২ দশমিক ৯৯ টাকা ও জুন থেকে ৩ দশমকি ১৬ টাকা করা হয়েছে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/02/24/103635