৩১ মে ২০১৭, বুধবার, ১১:০৬

দ. এশিয়ার পৌত্তলিক ধর্মের দেশগুলোতেও সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে গ্রিক দেবী মূর্তি নেই!

সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত সাম্প্রদায়িক ও বিতর্কিত গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি অপসারণের পর অ্যানেক্স ভবনের সামনে পুনঃস্থাপনে সর্বস্তরের মুসলমানদের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার পৌত্তলিক ধর্মের দেশগুলোতেও সুপ্রিম কোর্টে এ ধরনের গ্রিক দেবী মূর্তি নেই। আর এক হাতে তরবারি, অন্য হাতে ন্যায়দণ্ড রাখা আমাদের সুপ্রিম কোর্টের বিচারনীতির সাথে সাজুর্য্যপূর্ণ নয়। দেশের আলেম সমাজ ছাড়াও সাধারণ মুসুল্লীরা পবিত্র মাহে রমযানের পবিত্রতা বিনষ্টের অভিযোগ তুলেছেন। তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মদীনার সনদ অনুযায়ী দেশ পরিচালনার অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে মুখচেনা ইসলামবিদ্বেষীরা সরকারকে বিপদে ফেলতে চায়। উক্ত স্বার্থান্বেষীমহলটি ভাষ্কর্য নাম দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আইনাঙ্গনে কথিত ‘জাস্টিশিয়া’ মূর্তিটি বহালের অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে।

গ্রিক পৌরাণিক কাহিনি মতে, খৃস্টপূর্ব অষ্টম শতকে থেমিস ছিলেন প্রাকৃতিক নিয়মকানুন নিয়ন্ত্রণকারিণী দেবী। তিনি ইউরেনাসের ঔরসে গেইয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বংশের বিচারে থেমিস ১২ জন টাইটানের (উত্তরসূরী) একজন। ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা পেয়েছিলেন গেইয়ার কাছ থেকে। পরে এই ক্ষমতা ফিবিকে প্রদান করেছিলেন। রোমান পুরাণে থেমিসেরই আরেক নাম ‘জাস্টিশিয়া’। প্রাচীন গ্রিক পৌরাণিক কাহিনির দেবতা ও স্বর্গের প্রথম রাজা ‘ইউরেনাস’ প্রতি রাতে পৃথিবী ও উর্বরতার দেবী গেইয়ার সাথে মিলিত হতেন। থেমিস ইউরেনাসের ঔরসজাত হলেও গেইয়া বহুগামিনী ছিলেন। থেমিসের জন্মদাত্রী গেইয়া তার গর্ভজাত পোন্টাস ছাড়াও টার্টারাস, পোসেইডোন, ওসিনাস, জিউস, হেফ্যাস্টাস, ঈথার ও অজ্ঞাত পুরুষের সঙ্গে যৌনসঙ্গম করতো বলে গ্রিক পূরাণে বর্ণিত হয়েছে।
উইকিপিডিয়ায় আরো বলা হয়েছে, থেমিস ছিলেন জিউস এর স্ত্রী। তিনি ছিলেন আইন-শৃঙ্খলার দেবী। তৎকালীন আইনে সেই প্রথম মানবজাতির পক্ষে মানবতাকে সামগ্রিক আইন এবং ন্যায় হিসেবে উপস্থাপন করে। খৃস্টীয় ১ম শতকে এসে রোমানরা ন্যায় বিচারের এ দেবীর নাম দেয় ‘জাস্টিশিয়া’ বা ‘লাস্টিশিয়া’। খৃস্টীয় ২২ সালে রোমান মুদ্রায় দেবী জাস্টিশিয়ার মূর্তি অংকিত হয়। ন্যায়বিচারের গ্রিক দেবী দেবী থেমিসের ডান হাতে আছে একটি তরবারি। বাম হাত আছে একটি দাঁড়িপাল্লা। তার চোখ দুটো খোলা। ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসাবে দাঁড়িপাল্লার ধারণা আরো অনেক পুরনো। প্রাচীন মিশরের দেবী মাত বা আরো পরে দেবী উরুস এর হাতে ছিল ন্যায়ের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা। প্রাচীন মিশরের দাঁড়িপাল্লা গ্রিসে এসে দেবী থেমিসের হাতে উঠে। তার হাতে কালো কাপড় বোঝায় বিচারকালে সে অন্ধ (পরিবার-স্বজনদের প্রতি), হাতের দাঁড়িপাল্লার দুটি পাল্লা হলো তার কাছে সবাই সমান, এবং অন্য হাতের তলোয়ার হলো অপরাধীর জন্য কঠোর শাস্তির প্রতীক। তাছাড়া দ্য এডিটরস’র অব এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় বলা আছে, থেমিস হলো, গ্রিক ধর্মে ন্যায় বিচার, প্রজ্ঞা ও সৎ উপদেশ এবং দেবতাদের ইচ্ছার দেবী।
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্টের সামনে এ যাবৎকাল পর্যন্ত ইসলামী পরিভাষা অনুযায়ী ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ অংকিত ছিল। এতে কারো কোন সমস্যা হয়নি বা কেউ এর সমালোচনাও করেনি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী ‘দাঁড়িপাল্লা’র প্রতি বিরুপ ছিলেন বলে জানা যায় না। উপরন্তু শেষ বিচারের দিন সকল মানুষের বেলায় ন্যায়ভিত্তিক বিচারের উপমা বুঝাতেও ‘দাঁড়িপাল্লা’ সমধিক ব্যবহৃত। অথচ কে বা কারা কী উদ্দেশ্যে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয় করে জাতীয় ঈদগাহকে সামনে রেখে সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি স্থাপন করে। তাও আবার মূর্তিটি ছিল আরেক দফা বিকৃত এবং শিল্পমান নিয়েও প্রশ্ন তুলে সংশ্লিষ্ট শিল্পীরা। তবে সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ উঠে আলেম সমাজের পক্ষ থেকে।
অরাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ তীব্র ভাষায় আপত্তি জানিয়ে বলে, সুপ্রিম কোর্ট হলো জাতীয় গুরত্বপূর্ণ স্থান। এটা বিশেষ কোনও ব্যক্তি বা ধর্মাবলম্বীদের জন্য নয়। সেখানে একটি মূর্তি বসানো হয়েছে। বলা হচ্ছে- এটা ন্যায় বিচারের প্রতীক। সেই মূর্তি হচ্ছে গ্রিক দেবী থেমিসের অনুরূপ। আমাদের জাতীয় সত্ত্বা, ইসলাম, ঐতিহ্যে ন্যায় বিচারের অনেক কিছু আছে। সংগঠনটির ভাষায়, গ্রিক দেবী থেমিসের অনুরূপতো বানানো হয়েছেই। এটাকে আবার শাড়ি পরিয়ে বাঙালিয়ানা করার চেষ্টা করা হয়। যাতে অদূর ভবিষ্যতে এটা আমাদের বাংলাদেশি ঐতিহ্য হিসেবে স্থান পায়। প্রায় ৯৫ শতাংশ মুসলমানের দেশে মসজিদের নগরী ঢাকাকে মূর্তি/ ভাস্কর্যের নগরীতে পরিণত করার ষড়যন্ত্র কোনোভাবেই বাস্তবায়িত হতে দেয়া হবে না।
হেফাজতে ইসলাম সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনের দাবির মুখে পবিত্র মাহে রমযানের প্রাক্কালে দেবী থেমিসের মূর্তিটি সরানো হলে প্রধান বিচারপতি ও সরকারকে সবাই ধন্যবাদ জানায়। কিন্তু মূর্তি পুনর্বহালের দাবিতে বাম-রামসহ কিছু মুখচেনা ইসলামবিদ্বেষী সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গণে অরাজকতা সৃষ্টি করলে আইনশৃংখলা বাহিনী শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখার স্বার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। থেমিসের মূর্তিটি সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে ফের স্থাপন করা হলে হেফাজতের আমীর আল্লামা শফী ‘দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেন। মূর্তিপন্থীরা দাবি করে, পশ্চিমা দেশগুলোর প্রায় সব আদালতের সামনে যে ভাস্কর্য রয়েছে, তা দেখতে একইরকম। লেডি জাস্টিস বা জাস্টিশিয়া নামের এই ভাস্কর্য সেসব দেশে ন্যয়বিচারের প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।
এই উপমহাদেশে এটাই হচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত প্রথম মূর্তি, গ্রিক-রোমান দেবী মূর্তি। ভারত, নেপালের মতো পৌত্তলিক ধর্মের দেশেও এ ধরনের কোন মূর্তি স্থাপন করা হয়নি। শ্রীলংকা ও মিয়ানমারেও করা হয়নি। করা হয়েছে বাংলাদেশে। এটি কোন সাধারণ মূর্তি নয়- এটি দেবী মূর্তি। স্থাপন করা হয়েছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রবেশ মুখে। আলেম সমাজের দাবিকে আপাত গুরুত্ব দিয়ে মূর্তিটি অপসারন করলেও ফের তা অ্যানেক্স ভবনের সামনে প্রতিস্থাপন করায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনায় আঘাত লেগেছে। এতদিন ধরে যে আদালতে এ মূর্তি ছিল না তখনকি ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল যা দেবী মূর্তি স্থাপন করে দূর করা হলো। মুসলিম নামধারী ‘বিশিষ্ট জনদের’ অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই গ্রিক মূর্তির পক্ষে। তারা এর কারন হিসেবে হাস্যকর যুক্তি ও ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে।
মূর্তিপন্থীদের মনগড়া ব্যাখ্যা : যে কোন প্রাণীর মূর্তি সব সময়ই মূর্তি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার একত্ববাদ পরিপন্থী ধর্মগুলো মূর্তিকে সমর্থন করলেও ইসলাম বরাবরই তাকে অগ্রাহ্য করে। ইসলামে কোন প্রাণীর মূতি কখনো সমর্থন পায়নি। আরো বিশেষভাবে কাকেও দেবতা বা দেবী কল্পনা করে অথবা দেবতা বা দেবী বলে পরিচিত কারো মূর্তি নির্মাণকে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় নিষিদ্ধ করেছে। এসব কর্মকান্ড মূলত শিরক্ বা ¯্রষ্টার সঙ্গে শরিকানা বুঝায় যা অমার্জনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত। তবে কোন বস্তু বা উদ্ভিদের ছবি বা ভাস্কর্য নির্মাণ ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি।
প্রাথমিককালের বৌদ্ধ ও খৃস্টান ধর্মে কোন মানবীয় মূর্তি বা ভাস্কর্য গৃহীত হয়নি। অবশ্য পরবর্তীতে তা গৃহীত ও চালু হয়েছে। যদিও ইস্টার্ন অর্থডক্স চার্চ কোন ধরনের মূর্তি বা ভাস্কর্যকে মেনে নেয়নি। ১৯ শতকের পূর্ব পর্যন্ত ইহুদী ধর্মে ও সমাজে কোন মূর্তি বা ভাস্কর্য স্বীকৃত হয়নি। কিন্তু মূর্তিপন্থীরা যেন ভাষ্কর্য নামের মোড়কে মূর্তিকে জায়েয করার সর্বশেষ মিশন নিয়ে নেমেছে।
অ্যাটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, কথিত জাস্টিশিয়া মূর্তি নয়, স্কাল্পচার (ভাষ্কর্য)।
বিতর্কিত ‘জাস্টিশিয়া’র ভাষ্কর মৃণাল হক দাবি করেন, এই আদল বিশ্বজুড়ে ন্যায়বিচারের প্রতীক। বিদেশে বেশিরভাগ নারীরূপী ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে গাউন ও মেক্সি পরা দেখা যায়। আমাদের দেশে নারীদের পোশাক শাড়ি বলে সেটিই ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে ধর্মীয় ব্যাখ্যা আসছে কীভাবে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি (ঘাদানিক) এক বিবৃতিতে বলেছে, সুপ্রিম কোর্টে স্থাপিত ভাস্কর্যকে হেফাজতিরা মূর্তি বা প্রতিমা বলছে, যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক নির্জলা মিথ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। এই ভাস্কর্য জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বহু দেশের উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এর সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। যে ইরানে ইসলামি হুকুমত ও শরিয়া আদালত বিদ্যমান রয়েছে, সেখানেও উচ্চতর আদালতের দেয়ালে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘জাস্টিসিয়া’ ভাস্কর্য খোদাই করা রয়েছে।’
মূর্তি ও ভাস্কর্য বৈধ প্রমাণের বিভ্রান্তিমূলক চেষ্টা : কুরআন-সুন্নাহর ভুরি ভুরি প্রমাণ মূর্তি নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে কিছু মিথ্যা গল্প, অস্পষ্ট বিবরণ আর রহিত বিধানের উপর ভিত্তি করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। ভাস্কর্য বা মূর্তিকে ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ প্রমাণ করার জন্য মোটামুটি চারটি বিষয় পেশ করা হচ্ছে।
এক. হযরত আয়েশা রা. রাসুলুল্লাহ সা. এর ঘরে পুতুল নিয়ে খেলা করতেন। সেই পুতুলগুলোর মধ্যে একটা ডানাবিশিষ্ট ঘোড়ার পুতুলও ছিল। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সা. এগুলো দেখেছেন কিন্তু নিষেধ করেননি। বুখারি-মুসলিমসহ অনেক হাদিসগ্রন্থে এ বিষয়টি উল্লেখ আছে।
দুই. রাসুল সা. পবিত্র বাইতুল্লাহ শরিফের ভিতর ও আশপাশ থেকে যখন সকল মূর্তি অপসারণ করেন তখন বাইতুল্লাহর ভিতরে হযরত ঈসা (আ.) এবং হযরত মরিয়াম (আ.) এর প্রতিকৃতি ভাঙতে নিষেধ করেন। সিরাতে ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশামের বরাতে উপরোক্ত বর্ণনাটি তারা উল্লেখ করে থাকেন।
তিন. পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হজরত সুলায়মান (আ.) এর ঘটনা। যেখানে বলা হয়েছে নবী সুলায়মান (আ.) এর নির্দেশে জিনরা আকৃতি নির্মাণ করত।
চার. মুসলিম খলিফাদের শাসনকাল থেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অমুসলিমদের দেশ বিজয়ের পর সেখানকার মূর্তি অপসারণ করা হয়নি। বর্তমানেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভাস্কর্য স্থাপিত রয়েছে।
হোক তব ভ্রান্তি ভঙ্গ : মূর্তিপন্থী বুদ্ধিজীবীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কুরআন-হাদিস কিছু ঘাটাঘাটি করে তার অপব্যাখ্যা দিয়ে চলেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কেই বলা হয়েছে ‘আল্লাহ কুরআনের দ্বারা অনেককে সঠিক পথ দেখান, আবার অনেককে ভুল পথে চালান। আর যারা অপরাধী কেবল তাদেরকেই কুরআনেরর দ্বারা বিভ্রান্ত করেন। [সুরা বাকারা]
হজরত আয়েশা (রা.) এর পুতুল সংক্রান্ত বিবরণগুলোর প্রকৃত সত্য হচ্ছে, নয় দশ বছরের এক বালিকার খেলার জন্য স্বহস্তে বানানো ছিল পুতুলগুলো। পুতুল বলতে হুবহু মানুষ বা কোনো প্রাণীর আকৃতি ছিল না সেগুলো। বরং শিশুদের কঁচি হাতে কাপড় চোপড় দিয়ে তৈরি ছিল এবং নিঃসন্দেহে তাতে কোনো মুখায়বয়ব ছিল না। যদি পুতুলগুলোতে প্রাণীর আকৃতি দৃশ্যমান থাকত তবে তা কস্মিনকালেও নবীজি (সা.) এর ঘরে থাকতে পারত না। পূর্ণাকৃতির পুতুলতো দূরের কথা, কাপড়ে অঙ্কিত প্রাণীর দৃশ্যও তো রাসুল সা. বরদাশত করেননি। খোদ হজরত আয়েশা (রা.) কে এ জন্য কড়া শাসনের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
হজরত আয়েশা রা. প্রাণীর আকৃতি যুক্ত একটি চাদর ক্রয় করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ সা. তা দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন, ঘরে ঢুকলেন না। আয়েশা রা. নবীজির সা. চেহারায় ক্ষোভ লক্ষ্য করলেন। তিনি বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি আল্লাহ ও তার রাসুলের নিকট তওবা করছি, আমার থেকে কী অপরাধ প্রকাশ পেয়েছে? নবীজি সা. বললেন, এ চাদরের কী দশা? আয়েশা রা. বললেন, আমি এটা কিনেছি আপনার বসার ও হেলান দেয়ার জন্য। তখন রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, এই আকৃতি অঙ্কনকারীদেরকে কেয়ামতের দিন কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। [বুখারি : ৫৯৬১]
পবিত্র বাইতুল্লাহ শরিফের দেয়ালে হজরত ঈসা ও মরিয়ম আ. এর অঙ্কিত ছবির বিষয়ে মূর্তিপন্থীদের প্রচারণাকে সত্যের অপলাপ বলছেন ইসলামী চিন্তাবিদগণ। প্রথমত, সিরাতে ইবনে ইসহাক বা ইবনে হিশামের বরাতে যা কিছু বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে তা আদৌ সঠিক তথ্য নয়। বরং প্রকৃত সত্য হচ্ছে, ঈসা ও মরিয়মের ছবি বাইতুল্লাহর দেয়ালে রেখে দেয়ার কল্পিত যে কাহিনীটি তারা বর্ণনা করেছেন, সেটা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রেস থেকে প্রকাশিত ইংলিশ লেখক আলফ্রেড গিয়োম অনূদিত ‘দি লাইফ অব মোহাম্মদ’ গ্রন্থের বর্ণনা। [প্রকাশকাল ২০০৬, পৃষ্ঠা ৫৫২] আলফ্রেড গিয়োম সিরাতে ইবনে ইসহাকের সংক্ষেপিত রূপ সিরাতে ইবনে হিশামের অনুবাদ করেছেন ঠিক, কিন্তু তাতে অনেক সংযোজন-বিয়োজন করেছেন। এমন অনেক বর্ণনা তিনি এই গ্রন্থে সংযুক্ত করেছেন যা মূলগ্রন্থ সিরাতে ইবনে ইসহাকেও নেই। সিরাতে ইবনে হিশামের কোনো পান্ডুলিপি বা মুদ্রিত সংস্করণেও নেই। ঈসা আ. ও মেরির ছবি রেখে দেওয়ার বর্ণনাটিও আলফ্রেড গিয়োমের সংযোজন, যা তিনি আযরাকি কৃত ‘আখবারু মক্কা’ থেকে সংগ্রহ করে ইবনে ইসহাকের নামে চালিয়ে দিয়েছেন এবং বর্ণনাটির সূত্রও যাচাই করে দেখা গেছে সেটি সবৈর্ব ভুয়া ও জাল। এখানে প্রশ্ন, বিশুদ্ধ বর্ণনার অগণিত হাদিস হাতের নাগালে থাকতে আলফ্রেড গিয়োমের এই বর্ণনাটি বুদ্ধিজীবীদের কেন পছন্দ হলো? এটাকে অজ্ঞতা নাকি জ্ঞানপাপ?
কুরআন মজিদ ও হাদিস শরিফে প্রতিমা ও ভাস্কর্য দুটোকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজিদের স্পষ্ট নির্দেশ ‘তোমরা পরিহার কর অপবিত্র বস্তু অর্থাৎ মূর্তিসমূহ এবং পরিহার কর মিথ্যাকথন।’ [সুরা হজ্জ : ৩০] এই আয়াতে পরিষ্কারভাবে সবধরনের মূর্তি পরিত্যাগ করার এবং মূর্তিকেন্দ্রিক সকল কর্মকা বর্জন করার আদেশ দেয়া হয়েছে। হাদিস শরিফেও নবী (সা.) মূর্তি ও ভাস্কর্য সম্পর্কে পরিষ্কার বিধান দান করেছেন।
হজরত আমর ইবনে আবাসা রা. থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন ‘আল্লাহ তায়ালা আমাকে প্রেরণ করেছেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার, মূর্তিসমূহ ভেঙ্গে ফেলার এবং এক আল্লাহর ইবাদত করার ও তার সঙ্গে অন্য কোনো কিছুকে শরিক না করার বিধান দিয়ে। [সহিহ মুসলিম : ৮৩২]

http://www.dailysangram.com/post/286052-%E0%A6%A6-